বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী? এই প্রশ্ন হয়তো আমাদের অনেককেই ভাবায়। এর আপাতত সহজ কোনও উত্তর নেই। জনআন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পরে আমরা ভেবেছিলাম, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে দেশে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে। আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতিবাজ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সুবিচার নিশ্চিত করবে, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ নেবে, এবং নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।
সংস্কার ও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে খানিকটা অগ্রগতি হয়েছে। শুরুর দিকে নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করলেও শেষ পর্যন্ত সরকার নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেছে এবং নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়েছে। যদিও সংশয় রয়েছে নির্বাচন কতটা অংশগ্রহণমূলক হবে তা নিয়ে।
সরকারের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা দেখা দিয়েছে বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের প্রথম ভুল ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিতর্কিত নিয়োগ। ন্যায়বিচারকে কঠিন পথ ধরে এগোনোর পরিবর্তে সরকার সহজ পথ, প্রতিশোধের রাজনীতি নিয়ে খেলতে দিয়েছে। ফলে ন্যায়বিচারের পরিবর্তে “victor’s justice” বা বিজয়ীর ন্যায়বিচারের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, প্রতিশোধের রাজনীতি শুধু রাষ্ট্রকে দুর্বল করে না, বরং সমাজে মব-রাজনীতির বৈধতা তৈরি করে। আন্তোনিও গ্রামশির “hegemony” তত্ত্ব এই ধরনের ফেনোমেনন ব্যাখ্যা করতে বেশ কাজের। গ্রামশির ফ্রেমে আমরা বলতে পারি, রাষ্ট্র যখন ন্যায়বিচার দিতে ব্যর্থ হয়, তখন রাজনৈতিক শক্তিগুলো নিজেদের প্রতিরোধকেই বৈধতা দিতে শুরু করে এবং তা ধীরে ধীরে সামাজিক হেজিমনি তৈরি করে।
এই প্রতিশোধের স্পৃহা আমরা রাজনীতির মাঠে স্পষ্ট দেখতে পারছি। ন্যায়বিচার কঠিন পথ, কিন্তু প্রতিশোধ সহজ পথ। দুঃখজনক হলো, সরকার যেমন নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে জনগণকে আস্থায় আনতে পারেনি, তেমনি কিছু রাজনৈতিক শক্তি বিচারের তোয়াক্কা না করে প্রতিশোধের পথ বেছে নিয়েছে। এই ক্ষেত্রে মব সন্ত্রাস হয়ে উঠেছে তাদের হাতিয়ার। আর এই প্রতিশোধের স্পৃহা থেকেই জন্ম নিচ্ছে নব্য ফ্যাসিবাদ।
উল্লেখ্য, ফ্যাসিবাদ হলো এমন এক রাজনৈতিক অবস্থা যেখানে জনগণের মতামত বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অগ্রাহ্য করে রাষ্ট্র ও সমাজকে একনায়ক নেতা বা একটি শক্তিশালী গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত করা হয়। এখানে বিরোধী মত দমন করতে ভয়, সহিংসতা ও প্রোপাগান্ডার আশ্রয় নেওয়া হয়।
উমবের্তো একো ফ্যাসিবাদের ১৪টি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। এর মধ্যে অন্তত দুটি বৈশিষ্ট্য আমাদের সমাজে এখন খুব শক্তিশালীভাবেই বিদ্যমান। একটি হলো শত্রু তৈরির প্রবণতা এবং অন্যটি হলো মব-ভিত্তিক সহিংসতা। ৫ আগস্টের পূর্বে ফ্যাসিবাদের প্রতীক ছিলেন শেখ হাসিনা ও তার সরকার, যারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ভিন্নমত দমন করতেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পরে নব্য ফ্যাসিবাদ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া একাধিক রাজনৈতিক গোষ্ঠী, যাদের অনেকেই নিজেদের ‘জুলাইযোদ্ধা’ পরিচয় দিয়ে নন-স্টেট অ্যাক্টর হিসেবে আইন হাতে তুলে নিচ্ছেন। এদের পেছনে রয়েছে একাধিক রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন।
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) গোলটেবিল আলোচনায় মব-আক্রমণের এই নব্য ফ্যাসিবাদের প্রতীকী প্রকাশ ঘটে। ডিআরইউতে ‘মঞ্চ ৭১’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম ‘আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের সংবিধান’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে। আলোচনার সময় একদল ব্যক্তি নিজেদের ‘জুলাইযোদ্ধা’ পরিচয় দিয়ে অংশগ্রহণকারীদের ওপর চড়াও হয়। প্রথম আলো ও ডয়চে ভেলে-এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জামায়াতের এক নেতা উপস্থিত থেকে ওই আলোচনায় অংশ নিতে আসা ব্যক্তিদের অবরুদ্ধ করে রাখেন এবং পরবর্তীতে তাদের মধ্যে ১৬ জনকে পুলিশের হাতে তুলে দেন।
এখানে আমরা স্পষ্টভাবেই দেখতে পাচ্ছি, একদল মব সন্ত্রাস চালিয়েছে এবং তার নেতৃত্বে ছিল ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলের নেতা। সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টগুলোতেও দেখা যাচ্ছে, এনসিপির কয়েকজন শীর্ষ নেতা এই ঘটনাকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছেন। তাদেরই একজন নিজের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে লিখেছেন—“আওয়ামী লীগ খেদানোতে এই ঐকমত্য সুপ্রতিষ্ঠিত থাকুক”। “আওয়ামী লীগকে যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই প্রতিহত করা হবে”—এমন লেখাও আমরা দেখলাম। ভিন্ন এক পোস্টে আরেক এনসিপি নেতা লিখেছেন, “এত রক্ত ঝরার পরে একটা স্বীকৃত আওয়ামী প্রতিষ্ঠান আওয়ামী খুনি এবং এর সমর্থক ও বয়ান উৎপাদকদের নিয়ে প্রোগ্রাম করবে, আর কেউ এর প্রতিবাদ/প্রতিরোধে বাধা দেবে না?” তা কেমন করে হয়।
এই বক্তব্যগুলো ও ঘটনাকে আমরা হান্না আরেন্টের “banality of evil” ধারণার আলোকে পড়তে পারি। আরেন্ট বলেছিলেন, ফ্যাসিবাদ কেবল রাষ্ট্রের শীর্ষে নয়, বরং সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের অংশগ্রহণের মাধ্যমেও টিকে থাকে। এখানে আমরা দেখছি, রাজনৈতিক নেতারা সহিংসতাকে বৈধতা দিচ্ছেন এবং “প্রতিরোধ গ্রুপ” বা “প্রেসার গ্রুপ” নামের আড়ালে আইনের শাসনকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের হাতে বিচার তুলে নিচ্ছেন।
প্রশ্ন হলো, যদি ‘প্রেসার গ্রুপ’ কিংবা ‘প্রতিরোধ গ্রুপই’ সব কাজ করে দেয় তবে সরকারের কি দরকার? সরকার কি আদৌ আছে, নাকি সরকার শুধু এই “প্রেসার গ্রুপ” ও “প্রতিরোধ গ্রুপের” তাঁবেদারি করবে, আইনের শাসনের তোয়াক্কা না করে?
এনসিপি ও জামায়াতের একাধিক নেতার পোস্ট দেখে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, কোনও কোনও আওয়ামী লীগ নেতা এই আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন, যাদের প্রতিরোধ করতে এমন মব তৈরি করতে হলো?
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান (কার্জন), এবং সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম। সেখানে কয়েকজন প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। এর থেকে আমরা বলতে পারি এই আলোচনায় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদধারী কোনও নেতা ছিলেন না। এদের কারও কারও আওয়ামী লীগের সাথে সংশ্লিষ্টতা ছিল না এমন দাবি বস্তুনিষ্ঠ হবে না। তবে এই লেখার উদ্দেশ্য সে বিষয়ে মন্তব্য করা নয়। তবে গ্রেফতারের পূর্ব পর্যন্ত অন্তত তাদের বিরুদ্ধে কোনও ফৌজদারি মামলা ছিল বলে কোনও পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়নি। কিংবা তারা যে জুলাই আন্দোলনের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এমন প্রমাণও কোনও সংবাদমাধ্যম উল্লেখ করেনি। ভবিষ্যতে করলে না হয় সেই আলোকে বিচার করা যাবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি কেউ কোনও ফৌজদারি অপরাধে জড়িত না থাকে, কিংবা জুলাই আন্দোলনের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে সম্পৃক্ত না থাকে, তবে শুধু আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্টতার সন্দেহেই কি এখন তাকে প্রতিহত করতে মব তৈরি করা হবে? আর সেই মবের প্রতি রাজনৈতিক দলের নেতারা সমর্থন দেবেন এবং ভবিষ্যতে এমন মব ঘটবে বলে হুমকি দেবেন?
সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, সরকার এই মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি; বরং যাদের ওপর হামলা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দিয়েছে। এটি স্পষ্টতই রুল অব ল’ পরিপন্থি এবং রাষ্ট্রকে একটি selective justice system-এ পরিণত করছে। এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কীভাবে নন-স্টেট অ্যাক্টররা “জুলাই যোদ্ধা” পরিচয়ে নব্য ফ্যাসিবাদী শক্তি হিসেবে সমাজে আবির্ভূত হয়েছে। সরকার হয় তাদের কাছে অসহায়, অথবা সরকার তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। যদি সরকার অসহায় হয় তবে রাষ্ট্র তার মৌলিক দায়িত্ব, নাগরিক সুরক্ষা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। আর যদি সরকার তাদের প্রশ্রয় দেয় তবে সরকার নিজেই নব্য ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার অংশীদার হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এক মৌলিক প্রশ্নের ওপর। প্রশ্নটি হলো রাষ্ট্র কি ন্যায়বিচারের পথে হাঁটবে নাকি প্রতিশোধ ও মব-রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেবে? প্রতিশোধ গণতন্ত্রের শত্রু। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একমাত্র কার্যকর অস্ত্র হলো আইনের শাসন এবং অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি।
যদি রাষ্ট্র নন-স্টেট অ্যাক্টরদের মব রাজনীতিকে দমন করতে না পারে, তবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র আর পুনর্গঠিত হবে না। “জুলাইযোদ্ধা” নামের নতুন ফ্যাসিবাদ আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
লেখক: পিএইচডি স্কলার, আমেরিকার জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন