মিয়ানমার বা বার্মার গৃহযুদ্ধ গত অক্টোবর ২০২৩ থেকে একেবারে নতুন পর্যায়ে মোড় নিয়েছে। জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে মিয়ানমার পরিস্থিতি। বার্মার গৃহযুদ্ধের কথা ভাবতে মনে পড়ছে বার্মার ঘটনা নিয়ে লেখা অমিতাভ ঘোষের ‘দ্য গ্লাস প্যালেস’ উপন্যাসটির কথা। দেশটির বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে সীমান্তবর্তী প্রদেশ বা স্টেটে সামরিক বাহিনীর (তাতমাদো) লড়াই এখন তুঙ্গে। এই সংঘাতের আঁচ মিয়ানমারের সীমান্ত ছাপিয়ে বাংলাদেশেও লাগছে বেশ কয়েকদিন ধরে। মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ১৪ জন সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এক অভ্যুত্থানে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে হঠিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল মিন অং হ্লাইং। এর পর তিন বছর পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় রয়েছে জান্তাপ্রধান।
‘দ্য গ্লাস প্যালেস’ (২০০০) হলো বার্মার শেষ রাজার ঘটনা দিয়ে শুরু হওয়া তিন প্রজন্মের কাহিনি নিয়ে লেখা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় লেখক অমিতাভ ঘোষের একটি বিখ্যাত উপন্যাস। পরিবারের সঙ্গে কয়েক বছর ঢাকায় বেড়ে ওঠা লেখক অমিতাভ ঘোষকে আমি ১৯৯৩ সালে কম্বোডিয়ার নমপেনে প্রথম দেখি। ২০২৩-এর জানুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘লিট ফিস্ট’ বা সাহিত্য উৎসবে তাকে আবার দেখলাম। ঢাকায় কাছ থেকে অমিতাভ ঘোষকে দেখেও ভক্ত ‘জনতার’ ভিড়ে আর কথা বলা সম্ভব হলো না। জানা হলো না, রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার নিয়ে তার সাম্প্রতিক ভাবনার কথা।
‘দ্য গ্লাস প্যালেস’ বইটির ঘটনা শুরু হয়েছে বার্মার শেষ রাজা থিবাও মিনের রাজধানী মান্দালয় থেকে ভারতের রতনাগিরি (১৮৮৫ সাল) যাত্রা দিয়ে। তবে পরবর্তীকালে তিন প্রজন্মের কাহিনি এগিয়েছে ১৯৯৬ পর্যন্ত। কাহিনির অন্যতম চরিত্র হলো চট্টগ্রামের এক বাঙালি হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ‘রাজকুমার’। মাত্র ১১ বছরের অনাথ রাজকুমার ভাগ্যের খেলায় আরাকান হয়ে রাজধানী মান্দালয় এসে পৌঁছে। রাজপ্রাসাদে রানির পরিচারিকা শান রাজ্যের বালিকা ‘ডলির’ সঙ্গে তার দেখা হয়।
রাজকুমার আর ডলির জীবন সংগ্রাম, ভালোবাসার নাটকীয় কাহিনি নিয়ে মহাকাব্যিক এই উপন্যাসের কাহিনি এগিয়ে যায়। যার বিস্তৃতি হয় বার্মা-ভারত-মালয়জুড়ে। ‘গ্লাস প্যালেস’খ্যাত সেই মান্দালয় শহরটির আশপাশে এখন গেরিলাদের তৎপরতা। রাজকুমার আর ডলির স্মৃতিবিজড়িত আরাকান ও শান রাজ্য সবচেয়ে বেশি যুদ্ধকবলিত। আসলে আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে জান্তা সরকারের ‘কাচের প্রাসাদ’...।
১৯৪৯ সালের ৩০ জানুয়ারি ‘ক্যারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের’ বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে বার্মায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই সময়ে বার্মা কমিউনিস্ট পার্টিও সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। সে সময় রেঙ্গুনের বাইরে মাত্র ৬ মাইল পর্যন্ত এলাকা সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মিয়ানমারের এই গৃহযুদ্ধ হলো বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘদিন (৭৫ বছর) চলমান গৃহযুদ্ধ।
উল্লেখ্য, বার্মায় নিযুক্ত পাকিস্তানের প্রথম (১৯৪৮-৪৯) রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আলী বগুড়া রেঙ্গুনের রাস্তায় কারেন বিদ্রোহীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, এই বাঙালি রাজনীতিবিদ পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৩-৫৫) হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তরুণ নেতা হিসেবে ১৯৫২ সালে চীনে যাওয়ার পথে (পিকিং শান্তি সম্মেলন) রেঙ্গুনে প্রায় ১৫-১৬ ঘণ্টা যাত্রাবিরতি করেছিলেন। সেই সময় বার্মার চলমান গৃহযুদ্ধের কথা তার বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’-এ চমৎকারভাবে উল্লেখিত হয়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে কারেন, কাচিন, কায়াহ, মন, শান, রাখাইন ও চিন প্রদেশে অসংখ্য জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী মিয়ানমার কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারির পর থেকে গৃহযুদ্ধ নতুন পর্যায়ে মোড় নিয়েছে। ২০২১ সালেই জান্তা সরকারের নৃশংস দমনমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য দল-মত নির্বিশেষে সরকারবিরোধী ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ ঐক্যের মধ্য থেকেই অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন এনএলডি নেতারা সমান্তরালভাবে জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) গঠন করে। তারা ২০২১ সালে ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স’ গড়ে তোলে, যা মূলত বামারদের নিয়ে গঠিত।
২০২৩-এর অক্টোবরের শেষ ভাগে জাতিগত সংখ্যালঘু ৩টি গোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠন নিয়ে ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ নামে জোট গঠন করে ২৭ অক্টোবর জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত অভিযান শুরু করে। তাদের এ অভিযান শুরুর দিন স্মরণীয় করে রাখতে নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন ১০২৭’।
মিয়ানমারের ম্যাপের দিকে তাকালে একে অনেকটা ঘুড়ির মতো দেখায়। মিয়ানমারের মধ্যস্থলে (বামার ন্যাশনাল হার্টল্যান্ড) বাস করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার বা বর্মী জাতিগোষ্ঠী যা জনসংখ্যার প্রায় ৬৫%। বামার প্রধান কেন্দ্রীয় এলাকাগুলোকে রিজিয়ন (৭টি) বলা হয়। অন্যদিকে মুখ্যত বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিসত্তা অধ্যুষিত সীমান্তবর্তী অ-বামার এলাকাগুলোকে স্টেট (৭টি) বলা হয়।
তবে চলতি গৃহযুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো বামার-জনতার একাংশও তাতমাদোর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। তাই সশস্ত্র বাহিনী এই প্রথম তাদের ঐতিহাসিক নিরাপদ এলাকায়ও (ন্যাশনাল হার্টল্যান্ড) বেশ মুশকিলে আছে।
উত্তরাঞ্চলে ‘অপারেশন ১০২৭’-এর শুরুর পর থেকে মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে তাতমাদোর লড়াই ছড়িয়ে পড়েছে। চীন সীমান্তের কাছে লুয়াক্কাই নামের শান স্টেটের এক গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করেছে গেরিলারা। এখানে ৬ ব্রিগেডিয়ার ও ২৩৮৯ সেনাসহ গোটা আঞ্চলিক অপারেশন কমান্ড আত্মসমর্পণ করেছে। এটি মিয়ানমারের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণ। এর আগে পুরো এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। কয়েক হাজার সৈন্য সেনাবাহিনী ছেড়ে পালিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে গেরিলারা অন্তত ৩৫টি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। তাতমাদো অপরাজেয় বাহিনী বলে যে মিথ ছিলÑ তা একেবারে ভেঙে গেছে।
গৃহযুদ্ধে ভেঙে পড়তে পারে মিয়ানমার... এ ধরনের আলোচনা মিডিয়ায় চলছে। তবে এখনই হয়তো নেপিদোকেন্দ্রিক জান্তা সরকার ভিয়েতনামের সায়গণ (১৯৭৫) অথবা কাবুলের (২০২১) মতো পতন হবে না। ভৌগোলিক হিসেবে দেশটির ৬০-৭০ ভাগ এলাকায় সংঘাত ছড়িয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় অঞ্চলে (বামার হার্টল্যান্ড) তাতমাদোর নিয়ন্ত্রণ এখনো নিরঙ্কুশ।
তবে নেপিদোর একেবারে পতন না হলেও তাতমাদোর পরাজয় শুরু হয়েছে। গণহত্যাকারী এই নিষ্ঠুর বাহিনী আর মোটেই অপরাজেয় নয়। ভবিষ্যতে প্রদেশগুলো ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন পেতে পারে। কাবুলের মতো পতন না হলেও এক পর্যায়ে হয়তো আলোচনার মাধ্যমে জান্তা সরকারের পরিবর্তন বা নেতৃত্বের পরিবর্তন হতে পারে।
আরাকানে এখন ‘আরাকান আর্মির’ সঙ্গে তাতমাদোর প্রচণ্ড লড়াই চলছে। এর ফলে নতুন করে বাংলাদেশে ‘রোহিঙ্গা ঢল’ নামতে পারে। এমনকি সেখান থেকে রাখাইন অধিবাসীরাও উদ্বাস্তু হিসেবে বাংলাদেশে আসতে পারে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভাবনা আরও কঠিন হয়ে পড়ল।
আরাকান বা মিয়ানমারকেন্দ্রিক ভূরাজনৈতিক সাইক্লোনের কেন্দ্রে আমরা আছি। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হতে পারে বাংলাদেশেরই। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় হুমকি রাখাইন থেকেই এসেছে। আরাকানে গৃহযুদ্ধের এমতাবস্থায়, বাংলাদেশে এর প্রভাব ও করণীয় কীÑ এসব নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে ও ব্যবস্থা নিতে হবে। ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল’ গঠন, ‘আরাকান আর্মি’ ও ‘এনইউজি’ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগÑ এগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আশিয়ান দেশসমূহ এমনকি পশ্চিমের রাজধানীগুলোতেও মিয়ানমারের যুদ্ধ নিয়ে যত কথা হচ্ছে, ঢাকায় সম্ভবত এমনটি খুব বেশি নয়। ঢাকার সিকিউরিটি কমিউনিটিতেও এ নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা চোখে পড়ছে না। তবে মিডিয়া মিয়ানমারের বিষয়গুলো কাভার করছে।
দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে ঝড় ধেয়ে আসছে দেখে সতর্কতা ও প্রস্তুতি প্রয়োজন। বলা হয়, মিয়ানমার একটি খোলা বই, যা বাঙালি খুব কমই পাঠ করেছে। গত ৫০ বছরে বিভিন্ন সময়, আরাকান তথা মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক-সামরিক ঘটনার বিস্ফোরণের আগে (যেমন রোহিঙ্গা ঢল) আমরা তেমনটা বুঝতে পারিনি। তাই প্রতিবেশী মিয়ানমারের ঘরের ভেতরের পরিস্থিতি সম্পর্কে সরেজমিন খোঁজখবর বাড়ানো প্রয়োজন। জান্তা বাহিনীর ‘গ্লাস প্যালেস বা কাচের প্রাসাদ’ কিন্তু ভেঙে পড়ছে। ‘বার্মার ট্রেন’ এবারও মিস করলে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে সামনে আরও বিপদে পড়তে পারে বাংলাদেশ।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও গবেষক