গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মান নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক– সরকার গঠনে কোনো সমস্যা হয়নি। আন্তর্জাতিক পরিসরেও সরকারকে এজন্য কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। অনেকে তো বলেন, ওটা কোনো ‘ইলেকশন’ই হয়নি; হয়েছে ‘সিলেকশন’! সতর্ক মূল্যায়নকারীরা বলছেন, দুই-তৃতীয়াংশ আসনে ‘সাজানো প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ও হয়নি। ভোটের প্রদর্শিত হার নিয়েও অবিশ্বাস থেকে যাবে। সব মিলিয়ে নির্বাচনটি নৈতিক ও রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তবে এর চাইতে খারাপ নির্বাচনের ভেতর দিয়েও দেশ চালিয়ে যেতে সমস্যা হয়নি নিকট অতীতে। এবারও হবে বলে মনে হচ্ছে না।
নির্বাচনের আগে থেকে ঘনিয়ে ওঠা অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা কঠিন হবে অবশ্য। সেটা ঘিরে সরকার বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে, তেমনটা নাও হতে পারে। এটা কিছুটা হতো– দেশের প্রধান রপ্তানি খাত গার্মেন্টসে মূল আমদানিকারক দেশগুলো থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা এলে। নির্বাচনের আগেই এ নিয়ে শংকা তৈরি হলেও, নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরও তেমনটি ঘটতে দেখা যায়নি। শ্রমবিষয়ক অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়নি অবশ্য। মনে হয়, পশ্চিমারা চাপ বহাল রেখে এ খাতে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করিয়ে নেওয়ার পথে এগোবে। রপ্তানি আয়ের গতি-প্রকৃতি নিয়ে দুর্ভাবনায় থাকা নীতিনির্ধারকদের জন্য এটা হবে স্বস্তির। রিজার্ভ সংকটও কিছুটা কাটিয়ে ওঠা যাবে গার্মেন্টস খাত ভালোভাবে এগিয়ে যেতে পারলে। কারণ রেমিট্যান্সের ওপর ভরসা কম। বিপুল প্রবাসী আয় এখনও আসছে হুন্ডিতে। এফডিআইসহ ঋণ সহায়তা ছাড় পরিস্থিতিও এখন পর্যন্ত খারাপ।
অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন ঘিরে যে নিষেধাজ্ঞার কথা হচ্ছিল, তা না আসায় অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে দেশে। এ ক্ষেত্রে বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রশ্নে তার মিত্র ইইউও কম আগ্রহ দেখায়নি। তাদের পার্লামেন্ট থেকে কোনো কোনো ইস্যুতে ‘অ্যাক্টিভিজম’ও (অনেকের মতে) হয়েছিল পরিলক্ষিত। একপক্ষীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর থেকে তাদেরও নিশ্চুপ হয়ে যেতে দেখা গেল। ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করা তিন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ‘নিঃশর্ত সংলাপ’ আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের তৎপরতা ছিল তাদের দৃশ্যমান সর্বশেষ প্রয়াস। তবে সরকার তার পথেই এগিয়েছে এবং নির্বাচন সেরেছে বলিষ্ঠভাবে। জাতীয় সংসদও শুরু করেছে কার্যক্রম এবং তাতে একটা ‘বিরোধী দল’ও বের করা গেছে। ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই এবার ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে। তারাও পারত একটি গ্রুপ বানিয়ে বিরোধী দলের জায়গাটা নিতে। সেটা না হলেও যা হয়েছে– তাতেও গণতন্ত্র চর্চা হবে না।
এ প্রক্রিয়ার সূচনা অবশ্য হয়েছে ২০১৪ নির্বাচনের ভেতর দিয়েই। পরবর্তী দুই নির্বাচনে এটা আরও জোরদার হলো। এমন ধারণাও জোরদার যে, আগামী নির্বাচনও এ ধারাতেই হবে। ‘এ ধারাতেই’ মানে, ক্ষমতাসীন দল ও তার মিত্ররা নির্বাচনে এসে জনগণকে বলবে ভোটকেন্দ্রে যেতে। ভবিষ্যতে ভোটদানকে হয়তো বাধ্যতামূলকও করা হবে। তার কিছু আলামত এবারের নির্বাচনেও দেখা গেল। জাল ভোটসহ গতানুগতিক ত্রুটিগুলোও ছিল নির্বাচনে। দেশের মানুষ এতে কী মনে করল, তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না। সব প্রস্তুতি দেখে নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা কিন্তু সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও প্রকাশ করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের মতো দেশের সরকারকে সরিয়ে দিতে পারে, এমনটাও বলা হয় একাধিকবার। তবে পরিস্থিতি বোধহয় সে রকম ছিল না।
নির্বাচনের আগেই কিন্তু জানানো হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। সম্প্রতি জানানো হলো, বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে কার্যক্রম অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ওই নিষেধাজ্ঞা বহাল আছে। নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ‘অবনমনে’ ভূমিকা রাখায় কার ওপর এটি কার্যকর হলো, তা অবশ্য প্রকাশ করা হয় না। একই সময়ে কর্তৃত্ববাদ কবলিত কিছু দেশে নির্বাচন ঘিরে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা যুক্তরাষ্ট্র আবার ধরে ধরে জানিয়েছে। বাংলাদেশে তেমন কিছু ঘটেনি– যদিও নজিরবিহীনভাবে আগেভাগেই এ ক্ষেত্রে ঘোষিত হয়েছিল ভিসা নীতি। নির্বাচন ‘সুষ্ঠু ও অবাধ হয়নি’ বলে আপত্তিও জারি রেখেছে তারা। কিছুটা দেরিতে বাংলাদেশের নতুন মেয়াদের প্রধানমন্ত্রীকে লেখা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের চিঠিও এসে গেছে। এটাই ছিল বাকি।
চিঠিটির ‘বার্তা’ নিয়ে অবশ্য বিতর্ক করছেন অনেকে। বার্তা রয়েছে সরকারের কার্যক্রমেও। বার্তা আছে দুর্দিনে তার পাশে এসে দাঁড়ানো মিত্র দেশগুলোর নির্বাচন-পূর্ব ও পরবর্তী ভূমিকায়। গেল নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিপরীতে এসব বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তির ভূমিকাও ছিল নজিরবিহীন। কে কত জোরালোভাবে সরকারের পাশে এসে দাঁড়াতে পারে, সে প্রতিযোগিতাও নজর এড়ায়নি। তবে নেপথ্যে ভারতের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর এটা পুরো স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র এবার ‘নিজ চোখ দিয়ে দেখে’ বাংলাদেশে ভূমিকা রাখবে বলে যে ধারণা ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটা সত্য না হওয়াতেই পরিস্থিতিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়নি। এটাই সম্ভবত মূলকথা।
যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার কৌশলগত মিত্র ভারতকে চটিয়ে কিছু করতে শেষতক আগ্রহী হয়নি বলেই বাংলাদেশে আরেকটি একপক্ষীয় নির্বাচন হতে পেরেছে বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হচ্ছে। নির্বাচনের পর এটা ঘিরে ভিসানীতি কার্যকর থাকা না-থাকার বিষয়টিও এখন অস্পষ্ট। মানবাধিকার ও দুর্নীতি ঘিরে ম্যাগনিটস্কি অ্যাক্টের আওতায় ‘টার্গেটেড স্যাংশন’ আসার আশঙ্কার কথাও কিন্তু শোনা গিয়েছিল। সে ধারায়ও কিছু আর শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের ভেতর থেকেও এ লাইনে নড়াচড়া পরিলক্ষিত হচ্ছে না। জাপানের মতো বিশ্বস্ত মিত্র তো নির্বাচনের পরপর পাল্লা দিয়ে অভিনন্দন জানানোর কাতারেও শামিল হয়েছিল। এটা নিছক ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচারের’ অংশ ছিল না। ফ্রান্সের কথা আলাদা; তবে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব একটুও না বুঝে বাংলাদেশ বিষয়ে এমন অবস্থান নেবে, এটা মনে করার কারণ নেই। জাপান তো বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন অংশীদারও।
যা হোক, এবার অন্য কিছু ঘটতে পারত– পরিস্থিতির ভিন্নতর মূল্যায়ন করে বিএনপি তার ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ শুরুর আগেই আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিলে। দলটি এ অবস্থান নিতে পারত সংসদে বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে, এমনটা ধরে নিয়েই। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের নজিরবিহীন আগ্রহের বাতাবরণে তেমনটি করলে ২০১৮ সালের মতো ৬-৭টি আসন দিয়ে তাকে অপ্রধান বিরোধী দল বানিয়ে দেওয়া বোধহয় সম্ভব হতো না এবার। নির্বাচনের মান নিয়ে পশ্চিমাদের দিক থেকে প্রবলভাবে প্রশ্ন তোলার সুযোগও তখন বেশি করে মিলত। এ ইস্যুতে আন্দোলন রচনার গতানুগতিক সুযোগও কম থাকত না।
যে মূল্যায়ন থেকেই হোক– বিএনপি সে পথে যায়নি। এখন এর ফল বিএনপির সঙ্গে জাতিকেও বহন করতে হবে। তার ক্ষমতা ছিল না দলীয় সরকারের অধীনে হতে যাওয়া নির্বাচনটি প্রতিহত করার। সেক্ষমতা সম্ভবত শেষ হয়ে গেছে ২০১৪ সালেই। অনেকে বলেন, ওই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তা প্রতিহত করার সিদ্ধান্তেই ঘটেছিল ‘ভুলের সূত্রপাত’। পরে তা সংশোধনের সুযোগ আর মেলেনি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও সুযোগটি দেয়নি– স্বভাবতই।
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক