বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির একের পর এক আক্রমণে কোণঠাসা হয়ে যাওয়ায় তাদের ছেড়ে দেবে না মিয়ানমারের জান্তা সরকার। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য দুই স্তরের ঝুঁকি রয়েছে। একটি হলো– যদিও বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর কাউকে প্রবেশ করতে দেবে না, তবে মিয়ানমারের সংকট যদি বর্তমানের চেয়ে আরও বাড়ে এবং জান্তা বাহিনী যদি আরাকান আর্মির কাছ থেকে তার হারানো অবস্থান আবারও ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালায়, তাহলে রাখাইনে বিমান আক্রমণ থেকে শুরু করে যাবতীয় ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়। এমনটি ঘটলে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে আরও মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। সেই অবস্থায় রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষ প্রাণ বাঁচাতে যে কোনো দিকে ছুটবে। কাজেই বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি রয়েছে আবারও মানুষের ঢলের।
দ্বিতীয় ঝুঁকিটি হচ্ছে, ইতোমধ্যে জানা গেছে আরাকান আর্মি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে থাকা ফাঁড়িগুলো দখল করে নিয়েছে। মিয়ানমারের আর্মি এগুলো পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ ঘটনা আরাকান আর্মিও ঘটাতে পারে। তাই সশস্ত্র মানুষের বাংলাদেশে প্রবেশের ঝুঁকি রয়েছে। এর আগে একাধিকবার মিয়ানমারের বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি মিয়ানমার বাহিনীর ৩৩০ সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তাই রাখাইনে যুদ্ধ যদি চলতে থাকে, তাহলে অনিচ্ছাকৃত সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা থেকে যায়।
মিয়ানমারে যদি এ যুদ্ধ গভীর হয়, তাহলে বাংলাদেশের জন্য এসব ঝুঁকি থাকবে। তাই নিজ স্বার্থে ঝুঁকি কমাতে রাখাইনে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশকে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। এতে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা এবং বাংলাদেশের বন্ধু চীনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে হবে।
জাতিসংঘ সীমান্তে অপেক্ষায় থাকা রোহিঙ্গাদের প্রবেশের অনুমতি চেয়েছে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। সারা পৃথিবীতে যারা বাস্তুচ্যুত হয়, তাদের সহযোগিতায় সংস্থাটি এগিয়ে আসে। তারই অংশ হিসেবে এমন অনুরোধ বাংলাদেশের কাছেও হয়তো করেছে। তবে রোহিঙ্গা নিয়ে জাতীয় টাস্কফোর্স সব দিক বিবেচনা করে আর কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের আর কোনো রোহিঙ্গা গ্রহণ করার সুযোগ নেই। আমার কাছে সিদ্ধান্তটি খুব অযৌক্তিক মনে হয়নি।
বাংলাদেশ গত ছয় বছর ধরে মিয়ানমারের সমস্যা ঘারে নিয়ে ভুগছে। কাজেই এ মুহূর্তে বাংলাদেশের পক্ষে আরও একটি রোহিঙ্গা স্রোত সামলানোর মতো যৌক্তিক কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করি না। ফলে টাস্কফোর্স যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটি যৌক্তিক। এখনকার বাস্তবতায় এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। এখানে বাংলাদেশের ওপর মানবিকতার প্রশ্নটি চলে আসে। তবে গত ছয় বছর ধরে ১০ লাখের ওপর রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য এখন পর্যন্ত তিন স্তরে ও তিনভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেই উদ্যোগ একবারের জন্য বাস্তবায়ন হয়নি। এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও ফেরত যায়নি।
জাতিসংঘসহ যত উন্নয়ন সহযোগী রয়েছে, তারা রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিচ্ছে, তবে এর ভারটি বাংলাদেশকে বহন করতে হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে যে জটিলতাগুলো দেখা যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের দৃষ্টি প্রত্যাবাসনের দিকেই থাকা উচিত। এটিই বাংলাদেশের জন্য যুক্তিযুক্ত। এ ক্ষেত্রে আরও বেশি করে বাংলাদেশের মানবিকতা দেখানোর সুযোগ নেই। কারণ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে মানবিকতা দেখিয়েছে।
এম হুমায়ুন কবির : সাবেক রাষ্ট্রদূত