প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দৈহিক বিপর্যয় কি নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে?

অধ্যাপক আব্দুল কাইউম আনোয়ার
  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:৫৮

আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বে যেমন একক পরাক্রমশালী পরাশক্তি, তার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নায়ক মানে প্রেসিডেন্টকেও হতে হয় সার্বিক ক্ষমতাবান। দেহ-মন সবল সুস্থ না হলে এতো বড়ো রাষ্ট্র যেটি একাই একটি উপ-মহাদেশ, তাকে নিজ মেরুদণ্ডে ভর করে দাঁড়ানো কিংবা প্রয়োজনে দ্রুত হাঁটতে সহায়তা করা প্রায় দুরূহ। তবে এই ব্যাপারে কিছু ব্যতিক্রম আছে আমেরিকার ইতিহাসে, যেটি পরে বলবো।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন যখন (২০২০ সাল) যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র তখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিলো। একেতো ২০২০ সালের শেষের দিকে মহা প্রলয় রূপী কোভীড-১৯ কামড়ে ধরেছে ভূমণ্ডলের সমগ্র মানব প্রাণীকে, অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো তৎকালীন রাষ্ট্র নায়কের অথর্ব পরিচালনায়, সেই ক্রান্তিকালে যুক্তরাষ্ট্রকে সর্বাঙ্গীণ আত্মরক্ষায় এগিয়ে এসেছিলেন অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ এককালীন সিনেটার ও পরবর্তীতে ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেফ বাইডেণ। তখন যে তিনটি জাতীয় সংকটে ভুগছিল পুরো জাতি, সেই সব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট বাইডেণ। নির্বাচনী মাঠে নেমে তিনি সে সব সংকট সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জনগণ তাঁর প্রতিশ্রুতির উপর আস্থা স্থাপন করেই তাঁকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিলো, যদিও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ক্ষমতায় থাকা (Incumbent) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে গিয়ে নির্বাচনের ফলাফলে কারচুপির অভিযোগ এনে বিদ্রোহ করতে লেলিয়ে দিয়েছিলেন তার তাঁবেদার গুন্ডা বাহিনীকে। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারী সেই গুন্ডা বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের গর্ব ও রাষ্ট্র শাসনের কেন্দ্রীয় ভবন ক্যাপিটেল হিলে আক্রমন চালিয়ে ভবনটির ক্ষতি সাধন করে ও স্থানীয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার প্রাণনাশ করে। সেই কলঙ্কজনক ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে সারা পৃথিবী।
নির্বাচনের ইস্তেহারে (Menifesto) প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রথম ও প্রধান যে প্রতিশ্রুতি ছিল যে তিনি যদি নির্বাচিত হন তবে একশ দিনের মধ্যেই তিনি তাঁর সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় আগ্রাসী কোভিডকে নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসবেন। কারণ সেই মহামারীর প্রকোপে প্রতিদিন হাজার হজার অসহায় নরনারী ও শিশুদের প্রাণহানি ঘটছিলো অথচ ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই আত্মঘাতী মহামারিকে (Epidemic) গুরুত্ব দিয়ে জাতিকে সেই দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার কোন উদ্যোগ নেননি, ফলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি জনগনের আস্থাহীনতা বেড়েই চলছিলো। এক পর্যায়ে সেই অনাস্থা ও বিষণ্ণতার প্রকাশ ঘটে জাতীয় নির্বাচনে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হেরে যান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অতীব প্রয়োজনীয় মিত্র শক্তির( NATO) সঙ্গে চুক্তি করা বন্ধনে আবদ্ধ থাকা। সেই চুক্তির আওতাধীন ইউরোপিয় জাতি সমুহের প্রতি আনুগত্য ও সহানুভূতিশীল থাকা। ১৯৪৯ সালের সেই চুক্তির (Treaty) নিয়মানুসারে প্রতি মেয়াদে চুক্তির আওতাধীন রাষ্ট্র সমূহের কাছ থেকে যে চাঁদা সংগৃহীত হয়, সেই চাদার ভাগ দিতে দিতে অস্বীকৃতি জানায় ট্রাম্প প্রশাসন। যে যুক্তিতে সেই চাঁদা দেয়া বন্ধ করা হয়েছিলো তা ছিল যে চাঁদার বড়ো অংশ যুক্তরাষ্ট্র কেন বহন করবে? ইউরোপিয় অন্যান্য দেশ তাদের নিজস্ব আত্মরক্ষার স্বার্থ তারাই রক্ষা করুক, আমরা বড়ো অংকের চাঁদা দিয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষা করবো না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সেই যুক্তির বিরোধিতা করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। তিনি বলেছিলেন, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র যেখানে সারা বিশ্বের একচ্ছত্র প্রতিপালক, সুতরাং তার মোড়লাকি বজায় রাখতে এ জাতীয় আত্মত্যাগ করে যেতেই হবে। একা নিজে বাঁচা যায় বটে কিন্তু রাষ্ট্র সমাজ বলে একটি সত্ত্বা আছে। সেখানে সেই সমাজের সকলের ভক্তি শ্রদ্ধা ও সহানুভুতি লাভ করে নিজস্ব প্রতিপত্তির জাল বিছাতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে বহুবিধ কৌশল ও পরিকল্পনা হাতে নিতে হয়। সুতরাং, সেইসব ধ্যান ধারণার বশবর্তী প্রেসিডেন্ট বাইডেন পুনরায় NATO-র চাঁদা প্রদানে কার্যকরী ভূমিকা রাখেন।
অন্য আরেকটি মুখ্য বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশ গুলোর কার্বন নিঃসরণের কারণে বৈশ্বিক জলবায়ু যে পরিমানে দূষিত হয়েছে, তার থেকে পরিত্রান পেতে হলে দেরী না করে শীঘ্রই জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। ১৯৯৫ সালে বার্লিনে চালু হওয়া জলবায়ু সম্মেলন (COP) যেখানে বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশ সমুহ বায়ু দূষণ থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যেসব কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলো এবং একটি তহবিল গঠন করেছিলো, সেই তহবিলে চাঁদা দেয়াও বন্ধ করেছিলো ট্রাম্প প্রশাসন। অথচ বাস্তবে দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো শিল্প-কল-কারখানা স্থাপন করে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বায়ু দূষণকারী দেশ হিসাবে স্বীকৃত হয়েছিলো আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, সেই দেশই কিনা জলবায়ু তহবিলে চাঁদা দেয়া বন্ধ করেছিলো। সেই অথর্ব, বিবেকহীন, অপদার্থ প্রশাসন জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে আছে বিশ্ববাসীর কাছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন নির্বাচিত হয়ে সেই সংগঠনে যোগ দিয়ে চাঁদা দিতে শুরু করেছেন। শুধু যে চাঁদা দেয়া তা নয়, স্বদেশে কার্বন নিঃসরণ যাতে মাত্রাতিরিক্ত না হয় সেই উদ্দেশ্যে গ্রীন এনার্জি প্রকল্প চালু করে যাচ্ছেন। খনিজ তেল ও কয়লার বিকল্প জ্বালানি হিসাবে হাজারো সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করে এনার্জি সঙ্কুলানের ব্যবস্থা করেছেন। এমনকি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ইত্যাদি দেশ থেকে সস্তায় সেমি কনডাকটার কিনে এনেছেন কিংবা সেসব যন্ত্রাদি স্বদেশে উৎপাদন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। সুতরাং প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে ও তাঁর প্রশাসনকে কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয় এসব মহতী উদ্যোগের কারণে।
এতোসব সফলতাকে অস্বীকার করে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বিগত তিন বছরের শাসনামলের সার্থকতাকে অস্বীকার করে তাঁর বিরোধী রাজনৈতিক দল ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আগামী নির্বাচনে তাঁকে হারানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরণের অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। কি সেই অপপ্রচারের বিষয়? প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বয়স নাকি প্রেসিডেন্ট হবার যোগ্যতার মাপকাঠি ছাড়িয়ে গেছে। তিনি নাকি হাঁটতে হোঁচট খেয়ে পড়ে যান। বক্তৃতায় ভুল তথ্য প্রদান করেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসব তথ্যাদি যদি একজন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ পরিচালনার পরিপন্থী হয়ে থাকে, তবে অতি বৃদ্ধ না হয়েও ৪৩ তম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াকার বুশ (দ্বিতীয়) (২০০১ থেকে ২০০৯ সাল) ভারতের প্রধান মন্ত্রীর নাম বলতে পারেননি কেন?
এভাবে একাধিক প্রেসিডেন্টের শারিরিক অসুস্ততার উল্লেখ করা যায়। অতি জনপ্রিয় ৩৫ তম প্রেসিডেন্ট জন এফ। কেনেডি (১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ সাল) শিরদাঁড়ায় তীব্র ব্যাথায় ক্রেচে ভোর করে হাঁটতেন।৩২ তম প্রেসিডেন্ট এফ ডি রুজভেল্ট (১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল) ছিলেন পক্ষাঘাত রোগী, যিনি হুইল চেয়ারে বসে রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ চালাতেন।যুক্তরাষ্ট্রের ২৮ তম প্রেসিডেন্ট টমাস উড্রো উইলসন (১৯১৩ থেকে ১৯২১ সাল) ছিলেন ডাইলেক্সিয়ার (পড়তে না পারা) রোগী। যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতি প্রেসিডেন্টের একজন ৪ তম বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট জেইমস মেডিসন (১৮০৯ থেকে ১৮১৭ সাল) ছিলেন একজন মৃগী রোগী।সুতরাং, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বেলায় এমন গুরুতর কি অন্যায় হয়েছে যে বক্তৃতায় কদাচিৎ যদি দু’একবার স্মৃতি ভ্রমের কারণে ভুল তথ্য মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে কিংবা অন্যের সহায়তা ছাড়া এরপ্লেনের খাঁড়া সিঁড়ী বেয়ে উঠতে হোঁচট খান, সেইসব দৈহিক অযোগ্যতার চাল চালিয়ে তাঁকে আগামী নির্বাচনের প্রতিযোগিতা থেকে বঞ্চিত করার পায়তারা কি সার্থক হবে?
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অশুভ কিছু লক্ষণ ছায়ার মতো পিছু ধাওয়া করছে। কোভিড মহামারী থেকে পরিত্রান পেয়ে জনগন অর্থনৈতিক যে দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছিলো, তা কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছে বটে তবে মন্দার করাল গ্রাসে তলিয়ে যায়নি। সম্প্রতি হাজার নয়, কয়েক লক্ষ অভিবাসীর অপ্রত্যাশিত আগমনকে সামলে নেয়া ডেমোক্র্যাটিক রাষ্ট্র গুলোর কৃতিত্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তারপরও সারা যুক্তরাষ্ট্রে যে পরিমান কর্ম সংস্থান বৃদ্ধি অব্যাহত আছে, সেসব সফলতার মূল উদ্যোক্তা প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও তাঁর প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দলীয় যে নির্লজ্জ বিভেদ, এমনকি সর্বচ্চ বিচার বিভাগেও রাজনীতির যে দলাদলি, সেটি সত্যিই অপ্রত্যাশিত। গনত্রন্ত্রের জনকরাই যদি অগনত্রান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে জয়ী হতে চায়, বলার কিছু নেই।