বাংলাদেশে খাবার অপচয় করার মতো পরিবার আসলে কারা?

শাহানা হুদা রঞ্জনা
  ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৫৭


মায়েরা বা পরিবারের নারী সদস্যরা সাধারণত রান্না হওয়া খাদ্যসামগ্রী নষ্ট হতে দেন না। আমাদের মায়েরা বিশ্বাস করতেন কোনোকিছুর অপচয় মানে অপরাধ। আর খাবার নষ্ট করলে তা পরিবারের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে।
যে কারণে বাচ্চাকে খাওয়ানোর পর অবশিষ্ট খাবারটুকু মা নিজের খাবার মনে করে নিজে খেয়ে নিতেন বা রেখে দিতেন পরে খাওয়াবেন বলে। সেই বিশ্বাস আমাদের মধ্যেও এসেছে। আর বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবারে এমন সীমিতভাবে রান্না করা হয়, যেন বাড়তি খাবার পড়ে না থাকে। অবশ্য মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে প্রতিদিন চাহিদামতো খাদ্যের জোগান দেওয়াই প্রায় অসম্ভব, সেখানে অপচয় হবে কেমন করে?
অথচ খবরে দেখলাম ২০২২ সালে বাংলাদেশে গড়ে একজন ব্যক্তি বছরে ৮২ কেজি খাবার অপচয় করেছেন। গবেষণালব্ধ এ তথ্য বিশ্বাস করবো কীভাবে, আবার অবিশ্বাস করাও যায় না। আমরা জানি যে দেশে তেমন খাদ্যাভাব না থাকলেও ঠিক অপচয় করার মতো খাদ্যও আমাদের নেই। তাও আবার বছরে প্রতিজন ৮২ কেজি খাবার অপচয় করছেন। কিন্তু তথ্যটি প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্মসূচি বা ইউনেপ।
এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানিয়েছে, বিশ্বে ২০২২ সালে বাসাবাড়ি, খাদ্যসেবা ও খুচরা পর্যায়ে মোট খাদ্যের প্রায় ১৯ শতাংশ অর্থাৎ একশ কোটি টনের বেশি খাবার অপচয় হয়েছে। ’ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স রিপোর্ট ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি বলেছে ওই সময়ে বাংলাদেশের খাদ্য অপচয়ের এ প্রবণতা ছিল ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। এর আগে বিভিন্ন প্রতিবেদনে আমরা দেখেছিলাম আরব বিশ্ব ও আমেরিকায় সবচাইতে বেশি খাদ্য অপচয় হয়, এখন দেখছি আমাদের দেশে।
বাংলাদেশে অধিকাংশ পরিবার নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। কিছু পরিবার উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং খুব অল্প সংখ্যক উচ্চবিত্ত। করোনা মহামারির আগে থেকেই এদেশের মানুষের খাদ্য গ্রহণের হার স্বল্প মাত্রার ছিল। করোনাকালে এবং পরবর্তী বছরে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিল প্রায় সব পরিবার। বহু মানুষের চাকরি চলে গেছে, কারও ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, প্রচুর মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে। করোনার পরে বৈশ্বিক মন্দা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ সবধরনের পণ্যের উচ্চমূল্য মানুষকে দিশেহারা করেছে।
খাদ্যগ্রহণসহ অন্য সুবিধা গ্রহণের হার অনেক কমেছে। দুই বেলা দু’মুঠো ভাত জোগাড় করাই ছিল চ্যালেঞ্জিং। উচ্চবিত্ত বা ধনী পরিবারগুলো ছাড়া কারও পক্ষে এসময় ভালোভাবে কাটানো সম্ভব ছিল না। সেখানে গড়ে একজন ব্যক্তি বছরে ৮২ কেজি খাবার অপচয় করেছেন ২০২২ সালে, সেটা ভাবা একটু কঠিন। সম্ভবত এখানে একেবারে ধনী পরিবারগুলোর হিসাব আনা হয়েছে। তাদের পক্ষেই সম্ভব বেশি খাদ্য নষ্ট বা অপচয় করা। কিন্তু সেই সংখ্যাইবা কতজন?
২০১৯ সালের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সংস্থাটি ২০২১ সালে যে রিপোর্ট দিয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল যে একজন বাংলাদেশি বছরে ৬৫ কেজি খাদ্য উপাদান কিংবা তৈরি খাদ্য নষ্ট করেন। সেটা করোনাকাল ছিল। সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ যে কীভাবে সংসার চালিয়েছে, তা তারাই ভালো জানেন। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার শ্রেণি-পেশা পরিবর্তন করে নিম্নবিত্ত হতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এই আলোচনায় যাওয়ার আগে দেখে নেই ফুড লস বা ফুড ওয়েস্ট আসলে কী। গবেষকরা বলছেন, সাধারণভাবে খাবার সম্পূর্ণ না খেয়ে অপচয়টাই হলো ’ফুড ওয়েস্ট’। আর ’ফুড লস’ হলো উৎপাদন বা আহরণের পর গ্রাহকের হাত পর্যন্ত না পৌঁছানো। সেটিও খাদ্য অপচয়ের মধ্যেই পড়ে।
আবার যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে কোনো খাবার যদি নষ্ট হয় তাহলে সেটি খাদ্য অপচয়ের আওতায় আসবে। এর মধ্যে ফুড লস হয় মাঠ পর্যায় থেকে গ্রাহকের হাতে আসা পর্যন্ত। আর ফুড ওয়েস্ট বা অপচয় হয় গ্রাহকের হাতে আসার পর। বাংলাদেশে ফুড লস অনেক হয়। যেমন এখন হচ্ছে শসা, বেগুন। উৎপাদনস্থলে দাম প্রতি কেজি এক টাকা, দুই টাকা। ফলে কৃষকরা জমিতেই ফেলে রাখছেন এসব বা গরু-মহিষকে খাওয়াচ্ছেন।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপক শাহেদ রেজা গণমাধ্যমকে বলেন, ছোট মাছের ক্ষেত্রে বেশি ফুড লস হয়। “আমরা দেখেছি আহরণের পর থেকে গ্রাহক পর্যায়ে আসা পর্যন্ত ছোট মাছের ক্ষেত্রে কেজিপ্রতি ২৩ শতাংশ ‘লস’ হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে তিন ভাগের এক ভাগ মাছ নানা কারণে নষ্ট হচ্ছে।” নানান কারণে ফুড লস হয় বাংলাদেশে কিন্তু ফুড ওয়েস্ট হওয়ার সুযোগ খুব কম।
বিয়ে বাড়ি, দাওয়াত বাড়িসহ ধনীদের বাসায় এটা হতে পারে। এই কথাই বলেছেন গবেষণায় নিযুক্ত অধ্যাপক কামরুল হাসান। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলে তারা যে গবেষণা করেছেন তাতে দেখা গেছে কমিউনিটি সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৫-১৩ শতাংশ খাবার নষ্ট বা অপচয় হয়। ‘বাসাবাড়ি ও হোটেল রেস্টুরেন্টে অনেক খাবার নষ্ট হয়। আমরা গবেষণা পেয়েছি যে উচ্চ আয়ের বাসাগুলোতে সপ্তাহে একজন মানুষ দুই কেজির বেশি খাবার অপচয় করে।’
দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশে খাদ্য অপচয় বিষয়টি দেখার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। গবেষকরা বলেন, রেস্তোরাঁ বা কমিউনিটি সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশি নজরদারি বা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকায় খাদ্য অপচয় প্রতিরোধে উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশের চেয়ে ভালো করছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের প্রায় ৮০ কোটি মানুষ যখন না খেয়ে আছে, তখন লাখো কোটি ডলারের খাবার ময়লার ঝুড়িতে ফেলা হচ্ছে। আসলে বছরের প্রতিদিন এক বেলায় যত খাবার নষ্ট হয়, তা দিয়ে বর্তমানে অনাহারে থাকা প্রায় ৮০ কোটি মানুষের সবাইকে খাওয়ানো সম্ভব।’
২০২৩ সালের জুন মাসে ঢাকায় দশম আন্তর্জাতিক নিরাপদ খাদ্য ফোরামের এক অনুষ্ঠানে ‘খাদ্য নিরাপদ এবং পুষ্টিকর রাখা, ক্ষতি রোধ করা’ শীর্ষক আলোচনায় বলা হয়েছিল দেশে বছরে প্রায় এক কোটি টনের বেশি খাবার অপচয় হয় এবং বছরে জনপ্রতি ৬৫ কেজি খাবার কখনো খাওয়াই হয় না।
খাদ্য অপচয়ের চেয়ে খাদ্য নষ্ট হওয়ার হার অনেক বেশি। যত খাদ্য নষ্ট হয় এর ৮৭ শতাংশই ঘটে উৎপাদন, মজুত, প্রক্রিয়া, বিতরণের সময় ও বাজারে। তখন জানানো হয়েছিল যে যত খাবার অপচয় হয় তার ৬১ শতাংশই বাড়িতে, ২৬ শতাংশ রেঁস্তোরায় থেকে আর বাকি খাবার অপচয় হয় খাদ্যশস্য যেখানে বিক্রি হয় অর্থাৎ বাজার কিংবা বিভিন্ন ধরনের দোকানে।
আমার বিশ্বাস বাংলাদেশে পরিবারপ্রতি ও বাসাবাড়িতে খাদ্যের অপচয় খুব স্বল্পমাত্রায় হয়। দেশের বহু পরিবার বাজারে বড় মাছের নাড়িভুঁড়ি, পাখনা, লেজ, কাঁটাসহ সব উচ্ছিষ্ট জিনিসপত্র এবং ভেঙে যাওয়া ডিম, মুরগির চামড়া, পা, গলা কিনে নেন বাসার সবাইকে আমিষের জোগান দেবেন বলে।
প্রশ্ন হচ্ছে যারা এভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন, সেখানে অপচয় হয় কেমন করে। দোকানিরাই জানিয়েছেন এসব শুধু গরিবরাই খান না, প্যান্ট-শার্ট পরা লোকজনও মধ্যবিত্তও এগুলো কিনে নেন। গ্রামে অবশ্য অবস্থা কিছুটা অন্যরকম। সেখানে মোটামুটি সবাই টাটকা সবজি, পালন করা হাঁস-মুরগি, ডিম, ছোট মাছ এবং ফ্রেশ ভাত, ডাল, ভর্তা খেয়ে থাকেন।
এই চিত্রটাই উঠে এসেছে সানেমের গবেষণায়। সংস্থাটি বলেছে শহরে দারিদ্র্য বেড়েছে, কমেছে গ্রামে। ২০১৮ ও ২০২৩ সালে দুই জরিপের ভিত্তিতে এই গবেষণা করা হয়। এতে উঠে আসে, অনেক পরিবার ব্যয় কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছে। মাসের পর মাস উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে শহরাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে, বেড়েছে আয়বৈষম্যও।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অধিকাংশ পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে। অনেক পরিবার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছে। গ্রামের তুলনায় শহরের দরিদ্র মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বেশি। কাজেই এসব পরিবারে খাদ্য অপচয় করার প্রশ্নই আসে না।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ৭০ শতাংশ খানা বা পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে। পাশাপাশি ৩৫ শতাংশ পরিবার খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কাটছাঁট করেছে। পরিবারগুলোর ব্যয় বাড়লেও একটি বড় অংশের আয় বাড়েনি অথবা আয় কমেছে। ফলে অতিদরিদ্র পরিবার সদস্যদের মাসিক মাথাপিছু ব্যয় ২০১৮ সালের তুলনায়
গত বছর ২০২১ সালে ২০ শতাংশ কমেছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় জানা গেছে বাংলাদেশে শহর এলাকায় মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। আরও সহজ করে বললে, শহরের পাঁচজনের মধ্যে একজনই দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করেন এবং শহরের অর্ধেক পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সানেম এর আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাস মহামারির অর্থনৈতিক প্রতিঘাতে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে।
মুদ্রাস্ফীতির কারণে দেশের অগণিত সাধারণ মানুষের নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। শতকরা প্রায় ৫০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে একেবারে পেরেশান করে তুলেছে। মানুষের স্বপ্নের মৃত্যু হচ্ছে, মধ্যবিত্তের জীবন থেকে নিম্নবিত্ত জীবনে প্রবেশ করছে দেশের মানুষ এবং দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে।
এরপরও যদি পরিবারপ্রতি খাদ্য অপচয় বৃদ্ধি পায়, তাহলে বুঝতে হবে এই পুরো অপচয়টাই হচ্ছে ধনী পরিবারে। যে মা তার বাচ্চার মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দিতে পারছেন না, যে বাবা সংসারের ব্যয় মেটাতে গিয়ে ধারদেনায় ডুবে যাচ্ছেন, যে পরিবার বাড়িভাড়া দিতে না পেরে উদ্বাস্তু হচ্ছে, তারা খাদ্য অপচয় করবেন কেন?
অন্যদিকে এ কথাও ঠিক যে বাংলাদেশে ধনী পরিবার বাড়ছে। এদের বড় একটা অংশ এতটাই ধনী যে তারা দেশে টাকা রাখতে নিরাপদ বোধ করছেন না। তাই খবর হয়েছে যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি টাকা পাচার হয়েছে।
সুইস ব্যাংকে রাখা বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তির অর্থের পরিমাণ সম্প্রতি কমে থাকলেও সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিকদের জমা করা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। সম্ভবত দেশের এই ধনীক শ্রেণির মানুষ খাদ্য অপচয় করার মাধ্যমে ’ফুড ওয়েস্ট’ বাড়িয়ে তুলছেন, সাধারণ জনগণ নয়।
লেখক: যেগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক