আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও স্পেনের ২৮ মে থেকে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তটি ইউরোপ জুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে। এই তিনটি রাষ্ট্র সেই সব রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, যারা ইতিমধ্যে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্য বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও ফিলিস্তিনের ব্যাপারে তাদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইউরোপের প্রায় সব দেশই একমত হয়েছে যে, ৭ অক্টোবরের আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া এখন আর সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা সম্পর্কিত সব সমস্যার একটি বাস্তব সমাধানই ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জনে সহায়তা করতে পারে। উভয় দেশের সাধারণ জনগণের সঙ্গে ন্যায়বিচার করতে হলে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে হাঁটতে হবে বলেই মনে হচ্ছে।
ইসরায়েলি সরকারের বিবৃতির প্রত্যুত্তরে বলতে গেলে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের কারণ হামাসের প্রতি সহানুভূতি নয়, বরং ইসরায়েল বর্তমানে ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণের ওপর যে নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে, তার প্রতিবাদস্বরূপ ইউরোপিয়ান দেশগুলো ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চায়। চলমান সংঘাতের কারণে কীভাবে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ও জনগণের দুর্ভোগ বন্ধ করা যায় এবং এই অঞ্চলে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা নিয়ে এখন বিশ্বের প্রায় প্রতিটা দেশই চিন্তিত। সমস্ত ফিলিস্তিনিকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য ইসরায়েল সরকার যেন দৃঢ় সংকল্প নিয়েছে! ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণকেও সন্ত্রাসী মনে করে তাদের ওপর নির্বিচারে হামলার কারণে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি হারিয়েছে। এরূপ অবস্থায় ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের অর্থ কোনোভাবেই হামাসের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন নয়। বরং ইসরায়েলের সরকারকে বুঝতে হবে সন্ত্রাস দমনের নামে সাধারণ জনগণ হত্যা বিশ্ব মেনে নেবে না। কারণ বিশ্বের মানুষ সত্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে।
আয়ারল্যান্ডের নেতৃবৃন্দ ইসরায়েলের ‘শান্তি ও নিরাপত্তায় থাকার অধিকার’ এবং ‘জিম্মিদের নিঃশর্ত মুক্তি’র গুরুত্বের ওপর পুনরায় জোর দেওয়ার জন্য ইসরায়েলের তথাকথিত ভুল ব্যাখ্যা শুনতে চায় না। আয়ারল্যান্ডের ঘোষণায় এটা স্পষ্টভাবে বলা আছে। তারা একটা শান্তি চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশের মানুষের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কাজ করতে চাইছে। তারা এমন কোনো পক্ষের সঙ্গে থাকতে চায় না, যাদের আলোচনায় বসার কোনো আগ্রহ নেই। ইসরায়েলের বর্তমান কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, তারা আলোচনার চেয়ে যুদ্ধকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে, যা ইতিমধ্যে বিশ্বের জনগণ বুঝতে শুরু করেছে। নরওয়ে তার বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে তারা শান্তির পক্ষে এবং এই মূহূর্তে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে যদি সত্যিই দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দিকে এগোতে চায়, তাহলে তাদের বক্তব্য নিঃসন্দেহে যুক্তিযুক্ত। নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী জোনাস স্টোর বলেছেন যে, একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র ‘মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি অর্জনের পূর্বশর্ত।’ তিনি আরো বলেন, ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত জনসাধারণের সমর্থনের অন্যতম উপায় হচ্ছে তাদের ভূখণ্ডকে স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা।
যদিও ইউরোপের অন্যান্য দেশ নরওয়ের এই বিবৃতির সঙ্গে একমত পোষণ করে না। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি বিশ্বাস করে যে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি একটি বড় সিদ্ধান্ত, এবং তারা এই মূহূর্তে এমন কিছু করতে চায় না, যা ভবিষ্যতে তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াতে পারে। কয়েক দিন আগে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন তার এক বক্তৃতায় এই কথা উল্লেখ করেন। তিনি মনে করেন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ চলমান সংঘাতের অবসান ঘটাতে সক্ষম নয়, তবে তারা আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে শান্তি অর্জনের উদ্দেশ্যে কাজ করতে পারে। তাদের উচিত এমন সব দেশের সহযোগিতা কামনা করা, যারা বাস্তবেই তাদের পক্ষে কাজ করতে ইচ্ছুক। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড অনুযায়ী বলা যায়, অন্যান্য ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রগুলোও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে হাঁটবে।
যুক্তরাজ্য এই বিষয়ে ফিলিস্তিনকে সহযোগিতা করতে আগ্রহী, বিশেষ করে ফ্রান্স এবং জার্মানির সঙ্গে, কিন্তু ৪ জুলাই যুক্তরাজ্যের নির্বাচনের ঘোষণা বিষয়টিকে জটিল করে তুলেছে। প্রথমত, নির্বাচনি প্রচারণার সময় বৈদেশিক নীতি অটল থাকে না বিশেষ করে এমন দেশের পক্ষে, যার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের ঐতিহাসিক সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের পর সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে, আর যদি সত্যি সরকার পরিবর্তন হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে রক্ষণশীল সরকারের চাইতে নতুন সরকারের ওপর ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বেশি চাপ থাকবে। লেবার পার্টি ইতিমধ্যে ফিলিস্তিনের পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণা চালাচ্ছে। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সংঘাত নিয়ে কনজারভেটিভ পার্টি ও লেবার পার্টির অবস্থান ভিন্ন। আসন্ন নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে যুক্তরাজ্য আসলেই ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি প্রদানের পথে হাঁটবে কি না। এই মূহূর্তে এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। লেবার পার্টি ক্ষমতায় এলে জনগণের পক্ষ থেকে তাদের ওপর ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য চাপ আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি। অবশ্য ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের জনগণই ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সময় যত গড়াচ্ছে, ফ্রান্স ও জার্মানির সরকারের ওপরও চাপ বাড়ছে। এ অবস্থায় গাজা যুদ্ধের কারণে চলমান বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসার স্বার্থে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিতে হবে। অবশ্য তার আগে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয় দেশের নেতৃবৃন্দকে আলোচনার টেবিলে বসার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে তাদের আগ্রহ প্রকাশ করতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সদিচ্ছা ছাড়া শুধু জনগণের বিক্ষোভের মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ করা সম্ভব নয়।
লেখক :যুক্তরাজ্যের প্রাক্তন সংসদ সদস্য, যিনি পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথে দুই বার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন
আরব নিউজ থেকে অনুবাদ :আব্দুল্লাহ আল মামুন