সকালে নিদ্রাভঙ্গের পর মাঝে মাঝে মনের ভেতরে এক একটি গান এসে ঘোরা ফেরা করতে থাকে। সারা দিন নানা কাজের ফাঁকে সে গানটি আর ছেড়ে যেতে চায়না । মনে মনে সারাদিন গানটি ভাজতে থাকি। মধ্য বয়স পেরিয়ে যাওয়া মানুষ, তাই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল দর্শনে আশ্রয় লাভ করে শান্তি খুঁজে পাই। রবীন্দ্রনাথের গান হলে পূজা, প্রার্থনা, প্রকৃতি কখন কোন পর্যায় এসে অন্তরে প্রবেশ করে তা' বুঝতে পারিনা।রবীন্দ্রনসঙ্গীতে এই ভাগ করা বড় কঠিন হয়ে পড়ে।
রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্বের গানকে কখনো মনে হয় প্রকৃতি পর্যায়ের আর প্রকৃতি পর্যায়ের গানকে মনে হয় প্রেম পর্যায়ের। এই মনে হওয়াটা সম্পূর্ণ শ্রোতার সীমাবদ্ধতা। রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্তরে যাদের নিত্য যাওয়া আসা নেই তারা যখন শুনেন, "মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চির দিন কেন পাইনা। কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয়না", মনে হয় সংগীতটি অবশ্যই প্রেম পর্যায়ের। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে গানটি প্রার্থনা পর্যায়ের। গানটিকে যারা প্রেম পর্যায় বলে চিহ্নিত করেন তাদের দোষ নেই, যদিও প্রার্থনা, পূজার কথা বলা হয়েছে কিন্তু এটিও ঈশ্বরের সাথে প্রেমের গানও বটে। রবীন্দ্র সঙ্গীতকে বিভিন্ন পর্যায়ে স্থান করে দেয়ার মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের উচ্চ দর্শন চিন্তার প্রতিফলন আছে।
এতোটুকু লেখা পড়ে অনেকেই মনে করতে পারেন লেখাটিতে রবীন্দ্রসংগীতের অন্তর্নিহিত দর্শন নিয়ে কোন বিশ্লেষণ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে ,এরকম ভাবনা যারা ভাববেন তারা কিঞ্চিত হতাশ হবেন। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত এই সঙ্গীত প্রার্থনার মতো যেনো অন্তরে গেঁথে গেছে। মানুষের নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা যখন সকল সীমানা ছাড়িয়ে যায়, তখন মানুষ আশ্রয় খুঁজে সঙ্গীত, শিল্পকলায়, অন্তত সংবেদনশীল মানুষেরা তাই করেন। সম্প্রতিকালে বিশ্ব জুড়ে বাঙালির একমাত্র দেশে যে সব নিষ্ঠুর কর্মকান্ড ঘটে চলেছে তা' গভীর ভাবে অবলোকন করলে মনে হয়, এ জাতি বেলাগাম, বেনজীর কান্ড ঘটানোর জন্য দেশটি স্বাধীন করেছিলো।রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বর দর্শনে ব্যাকুল হয়ে বলেছিলেন, মেঘ হৃদয় আকাশে জামাট বেঁধে ঈশ্বরের সাথে মিলনে বাঁধ সাধে, এবং গভীর আবেগে তিনি এ'কারণে গীতি কবিতা লিখে ঈশ্বরকে নিবেদন করেন। আমাদের বঙ্গদেশে ক্রমাগত ভাবে যে সব লোমহর্ষক ঘটনা ঘটছে রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকলে হয়তো সময়ের নিষ্ঠুর বেদনা থেকে মুক্তি পেতে বলতেন, মেঘ যেন হৃদয় এবং নয়নে এসে জমাট বেধে থাকে, যাতে মানুষ এই নিষ্ঠুরতা উপলব্ধি করতে না পারে। এরকম কী প্রার্থনা সঙ্গীত হতে পারে? হতে পারে, মানুষ বিপদগ্রস্থ হলে সব বিষয়ই প্রার্থনার বিষয় হয়ে যায়।
আমাদের দেশে জাদুকরী উপায়ে সম্পদ, ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে গেছে কতিপয় মানুষের হাতে।সম্পদ ও ক্ষমতা ক্রমাগত আয়ত্বে আসার পরও ভোগ তৃষ্ণার নিবারন নেই।আরও সম্পদ, আরও ক্ষমতা তাদের চাই আর এ'জন্য একটি শান্তি প্রিয়, কোমল মানসিকতা সম্পন্ন প্রান্তিক মানুষের সমাজকে তারা বিশৃঙ্খল এবং ভারসাম্যহীন করে ফেলছেন নানা উপায়ে। অপশাসনের মাধ্যম প্রান্তিক মানুষদের উপর ক্রমাগত শোষন প্রক্রিয়া তো চলছেই, এবার শুরু হয়েছে ক্ষমতাশালীদের মধ্যে দ্বন্ধ, সংঘাত।কারা এই ক্ষমতাশালী? যারা ক্ষমতা বলয়ের খুব কাছে অবস্থান করে "ক্ষমতা ঘর" থেকে ক্ষমতা সঞ্চয়্য করার নিশ্চিত পথ খুঁজে পেয়ছেন তারাই নানা ভাবে সম্ভাবনাময় জাতির ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে তুলছেন।
পৃথিবী দুভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়ে যদি একভাগে শোষক আর অন্য ভাগে শোষিতরা অবস্থান করেন, জাতির পিতা বলেছিলেন আমি সব সময় শোষিতের পক্ষে অবস্থান করবো। ধর্মীয় শ্লোকের মতো জাতির পিতার নাম উচ্চারণ করে তারা শোষিতদের পক্ষই শুধু ত্যাগ করেননি মানুষের শান্তি, স্বস্তি ও কেড়ে নিচ্ছেন। রাষ্ট্রের সম্পদ লুন্ঠন হচ্ছে নানা ভাবে, তারা যেখানেই বাঁধা পাচ্ছেন সেখানে পেশী শক্তি ব্যবহার করছেন। জনপ্রতিনিধি এবং তার বলয় আন্তর্জাতিক সোনা চোরাচালানী সিন্ডিকেটের সাথে যুক্ত এবং এ'নিয়ে প্রতিবেশী দেশে একশন ফিল্মের মতো আমাদের একজন জনপ্রতিনিধি খুন হওয়ার ঘটনা জেনে সচেতন, দায়িত্বশীল নাগরিকবৃন্দ মানসিক ভাবে সুস্থ থাকতে পারেন বলে আমার মনে হয়না, তবুও আমরা সমস্ত নিষ্ঠুরতা হজম করছি। নীরবতার সংস্কৃতি যেখানে সক্রিয় সেখানে সকল অঘটনই প্রত্যাশিত হয়ে যায়।ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে, পরিকল্পনা মার্কিন যুক্ত্ররাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশী দুর্বৃত্ত এবং তার দেশী সহচর।
সাধারণ কোন "গঙ্গা রাম তেলী" নয় খুন করা হয়েছে জাতীয় সংসদের একজন সাংসদকে। দেহকে প্রথমে কয়েক ভাগ করে হাড্ডি থেকে মাংস পৃথক করা হয়েছে। মাংসকে সুটকেসে করে নিয়ে পাব্লিক টয়লেটে নিয়ে আসা হয়। হাড্ডি থেকে মাংস পৃথক করে সে মাংসে হলুদ মেখে মানুষের খাবার মাংসের রূপ দেয়া হয়। মাংসকে হলদে করার কারণ হলো পথে কোন মানুষের জেরার মুখে পড়লে যেন বলা যায় এটি বিয়ে বাড়ির খাবার উপযোগী রান্নার মাংস। বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বিবিসিকে বলেছেন "অপরাধীদের উদ্দেশ্য ছিল এমনভাবেই গুম করা যাতে করে কেউ কোনও দিন তার অস্তিত্ব খুঁজে না পায়"।শুনা যায় সাংসদের শরীরের ভাগ করা মাংস সেনিটারি ল্যাট্রিনে ফেলে ফ্ল্যাশ করে নিঃশেষ করে দেয়া হয়েছিলো।
বেনজীর, বেলাগাম এসব ঘটনা একটির পর আর একটি ঘটে আমাদের অনুভূতীকে ধারহীন করে ফেলছে। একটি ঘটনা ঘটে এরপর ঘোরলাগা মেঘ এসে ভর করে চেতনার ওপর, ভয়ংকর কালো মেঘ যখন চেতনার আকাশ ঢেকে দেয় তখনি শুনা যায় কল্পনার সীমা অতিক্রম করা আর একটি ঘটনা। কারা এসব ঘটাচ্ছেন? ঘটনার পর পর "কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা, তদন্ত কমিটির মাধ্যমে সব অপরাধীকে চিহ্নিত করে সাজা দেয়া হবে।" এসব আলোচনা চারদিক থেকে ধেয়ে আসে। এসব মেকী হুমকীর মাজেজা অপরাধীরা খুব ভালো বুঝতে পারেন। সিলেটে বেশ কয়েক বছর পূর্বে একজন পুলিশ অফিসার একজন তরুণকে পুলিশ হেফাজতে নির্মম ভাবে পিটিয়ে হত্যার পর ভারত সীমান্তে চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে উর্ধতন এক পুলিশ কর্মকর্তার কাছে সেলফোনে তার করনীয় সম্পর্কে পরামর্শ চান। পরামর্শটি আমরা শুনতে পেয়েছিলাম ফাঁস হওয়া ভিডিও থেকে। বড় উপযোগী, যুৎসই পরামর্শ দিয়েছিলেন উর্ধতন, অভিজ্ঞ কর্মকর্তা। তিনি বলেছিলেন, "তুমি অপেক্ষা করো আরও কিছু সময়, এক সময় সব ঠান্ডা হয়ে যাবে অন্য দশটি ঘটনার মতো, তখন নীরবে চলে এসো। পারলে সীমান্ত অতিক্রম করে গা ঢাকা দেও।" ঘটনা যতোই নির্মম হোক অপরাধীরা জানে এক সময় সব কিছু "ঠান্ডা" হয়ে যাবে। তারা ফিরে আসবে,প্রভুদের ছত্র ছায়ায়।
এই যে অপরাধ সংঘটন, পত্র পত্রিকা, রেডিও টেলিভিশন, সামজিক মাধ্যমে সাময়িক হৈচৈ, তদন্ত কমিটি গঠন, অপরাধীদের সাময়িক প্রস্থান তার পর ফিরে আসা অথবা প্রবাসে অবস্থান। সংঘটিত অপরাধের এই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার বৃত্ত এখন সকল শ্রেণির মানুষের কাছে খুব পরিচিত। মনে হয় আমাদের নাগরিকেরা জীবনানন্দের মতো জানেন, "অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ/যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা/যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই—প্রীতি নেই—করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।"|
অদ্ভুত আঁধারে যে দহন কালের সৃষ্টি হয়, সে দহন কাল কী অনন্ত সময়ের ঘেরে বন্দী হয়ে যায়। সাময়িক ভাবে তাই মনে হয়। লুন্ঠনকারীরা যেখানে সমাজ নেতা, রাজনীতির কর্ণধার, ধর্মের ধ্বজাধারী তারা এরকম পরিবেশ সৃষ্টি করে যেন নেমে আসা "অদ্ভুত আঁধার"এর মত উপযুক্ত পরিবেশ কোন কালে কেউ কখন দেখেনি। এর থেকে সৃষ্টি হয় মোহনীয় নীরবতার সংস্কৃতি। এই সুবর্ণ ভূমিতে বারবার আঁধার নামে, কমনীয়, মোহনীয় রূপ নিয়ে। মানুষ গভীর নিদ্রা থেকে আবার জেগে ওঠে।জেগে ওঠা বাঙালির অমিত তেজে দেখেছে ঔপনিবেশিক শক্তি। দেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের বন্ধুরাষ্ট্র সমূহ, বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসক, পাকিস্তানী শাসকের দল। হাতের লাঠি যখন দেশ প্রেমের শক্তিতে বলীয়ান হয় স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, সপ্তম নৌবহর ফিরে যায় বাংলার সীমানা থেকে। শুভশক্তি সম্পন্ন মানুষ আশাবাদী, গহিন গ্রাম থেকে প্রান্তিক মানুষেরা অজস্র নুরলদিন কে নিয়ে জেগে উঠবেন। আঁধার কেটে পূর্ব দিগন্তে সাহসী সুর্যের দেখা পাওয়া যবে। ঝক ঝকে স্বচ্ছ্ব আকাশে আমাদের পতাকা ওড়বে পত-পত করে।