জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইইউর সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিবাদ নয়, নির্বাচন ‘বিদ্রোহ’ ঘটে গেল। এ পর্যন্ত, সাধারণত যে পার্টি বা কোয়ালিশন পার্টি ক্ষমতায় থাকত, ভোটদাতারা সেই পার্টির প্রার্থীদেরকে ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ বানিয়ে ব্রাসেলসের (ইইউর) সংসদে পাঠাত। অর্থাত্, ‘ঘরে ও বাইরে’ সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকত। এবার (২০২৪) উলটোটি ঘটেছে; উদাহরণস্বরূপ, যেমন :চেক প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংসদে ১০৮ জন এমপিতে সমৃদ্ধ কোয়ালিশন সরকার বিরোধী পার্টিগুলোর ৮৪ জন এমপি নিয়ে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মেজাজ ও দেমাগ দেখাতে পারছে। কিন্তু ইইউর সংসদ নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ পক্ষ এখন সংখ্যালঘিষ্ঠ, এবং সংখ্যালঘিষ্ঠরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যেহেতু ছোট দেশগুলো বড় দেশগুলোর কথায় ওঠে-বসে, তাই এবার বড়দের অবস্থা কেমন, দেখা যাক; যেমন :ফ্রান্সে, লাপেনের ‘ন্যাশনাল র্যালি’ ম্যাক্রঁঁয়ের রিপাবলিক দলকে ‘এক হাত দেখিয়ে’ দিয়েছে; জার্মানির বিকল্প পার্টি ‘AFD’ এবং ‘সারা ভাগেননেখট’-এর পার্টি মিলে সরকারি তিন পার্টিকে ‘আচ্ছামতো শিক্ষা’ দিয়েছে।
সুস্পষ্ট যে, ইইউর ভোটদাতারা ইস্টাবলিশমেন্টের ওপর খু-উ-ব চটে গেছে/রয়েছে। কেন? কারণ বহুবিধ ও বহুমুখী—অভিবাসন, জীবনযাত্রার মানের অব্যাহত নিম্নগামিতা, ‘সবুজ অ্যাজেন্ডা’র প্রতি রাগ-ক্রোধ, ‘জেন্ডার’ নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা, এবং অবশ্যই ইউক্রেন যুদ্ধ; যদিও সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ্যে সরাসরি কেউ কখনো কিছু বলেনি (রেখেঢেকে বলেছে)। ঠান্ডা যুদ্ধোত্তরকাল থেকে যে লিবেরালিজমের কথা বলা হচ্ছে, শোনানো হচ্ছে, তার কোনো বাস্তব ভিত্তি আসলে নেই। বরং বাস্তবতা হলো :নিয়ন্ত্রণ, কড়া নজরদারি করা, সেন্সরশিপ, টেকনোক্রেসি, লকডাউন, জলবায়ুসংকট ইত্যাদি। অর্থাত্ লিবেরালিজমের হীনতা বা অনুপস্থিতি পরিস্থিতিকে অনেকটা প্রায় একদল মতবাদ বা সমগ্রতাবাদে পরিণত করেছে।
ইউরোপের এই নির্বাচন-বিদ্রোহের শিকড় খুঁজতে হলে আমাদেরকে ১৯৭০-এর দশকে যেতে হয়। ‘দ্য গ্র্যান্ড চেসবোর্ড’ গ্রন্থের প্রণেতা এবং প্রেসিডেন্ট কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জবিগনিউ বার্জেজিনস্কি (Zbigniew Brzezniski) ১৯৭০ সালে ‘বিটুয়িন টু এইজেস’ গ্রন্থে বলেন, ‘যে নেশন-স্টেট/জাতি-রাষ্ট্র শৃঙ্খলাবদ্ধ মানুষের মুখ্য সৃজনশক্তির উত্স, তার সমাপ্তি বা বিলুপ্তি ঘটবে; কারণ জাতি-রাষ্ট্র যে রাজনৈতিক কনসেপ্টের ভিত্তিতে কাজ করে—তুলনায় আন্তর্জাতিক ব্যাংকসমূহ ও বহুজাতিভিত্তিক করপোরেশনগুলো কর্ম ও প্ল্যানিংয়ে অনেক বেশি পটু ও প্রাগ্রসর।’ বার্জেজিনস্কির মতে, টেকনোক্রেটিক যুগে ‘ঐতিহ্যগত মূল্যবোধমুক্ত অনিয়ন্ত্রিত এলিট গোষ্ঠী সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করবে, মানুষের ওপর নজরদারি বৃদ্ধি পাবে, সেই সঙ্গে নিপুণভাবে মানুষের আচরণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হবে।’ ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘লিমিটস টু গ্রোউথ’ (LTG) নামক রিপোর্ট/প্রস্তাবের সাহায্যে বার্জেজিনস্কির পরিজ্ঞানকে ত্রুটিপূর্ণ বা কৃত্রিম বা সিউডো ‘বৈজ্ঞানিক’ ভিত্তি দেওয়া হয় এবং ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় যে :জনসংখ্যা বৃদ্ধিপ্রক্রিয়া ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উেসর ফুরিয়ে যাওয়ার, বিশেষ করে তেল সম্পদের নিঃশেষ হওয়ার কারণে সভ্যতার (সিভিলাইজেশনের) সমাপ্তি ঘটবে। অর্থাত্ এমতাবস্থায়, সমাজের ব্যবস্থাপনা পরিচালনার মতো দূরদর্শিতা ও প্রযুক্তিগত উপলব্ধি কেবল অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ দলের, টেক বিশেষজ্ঞ দলের, বহুজাতিভিত্তিক করপোরেশনের দক্ষ জনদের ও ব্যাংকসমূহেরই রয়েছে।
ডেভিড রকফেলার ও তার বিশ্বাসভাজনরা, বিল্ডারবার্গ গ্রুপ বার্জেজিনস্কির পরিজ্ঞান লুফে নেন; নির্ধারিত হয় যে, একবিংশ শতাব্দী হবে ‘আমেরিকান সেঞ্চুরি’, তেলের উত্সসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও ডলার হেজিমনি বা আধিপত্য হবে দুই অপরিহার্য অংশ।
১৯৯২ সালে রিয়ো ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের রিয়ো কনফারেন্সে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের উপদেষ্টা টিম ওয়ের্থ (Tim Wirth) ‘লিমিটস টু গ্রোউথ’-এ ভুল ত্রুটিপূর্ণ স্বীকার করেন বটে কিন্তু ‘অ্যান ইনকনভেনিয়েন্ট ট্রুথ’ অনুসারে ‘বিশ্ব উষ্ণতর হচ্ছে’ পলিসি অব্যাহত থেকে যায়। যাহোক, উইলিয়াম ইংডাল (William Engdahl) লেখেন যে, কার্টার প্রশাসনের আমল থেকে মার্কিন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক ও অর্থনৈতিক পদগুলো রকফেলারের ট্রাইলেটারেল কমিশনের সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। যিনি-ই প্রেসিডেন্ট হন না কেন, নির্দিষ্ট চেয়ারগুলোতে ট্রাইলেটারেলের প্রার্থিরাই বসবেন।
ইউরোপীয়ান নির্বাচন ‘বিদ্রোহ’ ঘটার শিকড় এখানেই নিহিত রয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তিকে পশ্চিম স্নায়ুযুদ্ধে তাদের বিজয়োল্লাসের প্রতীকে পরিণত করে। এতে আনুষঙ্গিক দরকারি উদ্যম জোগায় ফুকুয়ামার ‘দি এন্ড অব হিস্ট্রি অ্যান্ড দি লাস্ট ম্যান’; অর্থনৈতিক লিবেরালিজম ও বিশ্বায়ন এবং অর্থনৈতিক বাণিজ্যনীতি ও সর্বোচ্চ পরিমাণে রাষ্ট্রীয় মালিকানাকে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তরকরণ মূলমন্ত্রে পরিণত হয়। কিন্তু অনেকেই নিয়ন্ত্রিত বিশ্বধারণার বিরোধী; অনেকেই তাদের ঐতিহ্যগত জীবনযাত্রাকে পরিত্যাগ করতে যেমন অনিচ্ছুক, তেমনি অনেকেই আবার তাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্যসমূহ পরিহার করতে নারাজ।
(অনিচ্ছুক, নারাজ দলের কারণে) হতাশা, আতঙ্ক ও সংক্ষোভের প্রথম প্রকাশ আমরা দেখি যুক্তরাজ্যে, ঋষি সুনাক তড়িঘড়ি অকাল ঝটিকা নির্বাচনের ঘোষণা দেন; অতঃপর ফরাসি ইস্টাবলিশমেন্টে দুর্যোগ নিয়ে আসে ইইউ নির্বাচন (অকাল ঝটিকা নির্বাচনের ঘোষণা), একইভাবে জার্মান ইস্টাবলিশমেন্টও মারাত্মকভাবে অবমানিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিন্যাসের বিরুদ্ধে, বিভিন্ন বেশে ও কখনো-বা কিছু ভাবাদর্শের মিশ্রণসহ, বিশ্বব্যাপী যে জাগরণ দ্রুততর বেগে বিকশিত হচ্ছে, ইউরোপিয়ান নির্বাচন ‘বিদ্রোহ’ তার অন্তর্ভুক্ত।
এমতাবস্থায়, শাসকশ্রেণি কি আপসরফায় আসবে? মোটেই নয়। প্রথমত, তারা ‘স্যানিটারি কর্ডন’ নামক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে চিরায়ত ডানপন্থি রাজনীতিকে অমর্যাদাকর চরম ডান বা ডানপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করেছে; অর্থাত্ ডানপন্থিরা অস্পৃশ্য দল। তাই মূলধারার রাজনীতিতে তাদের প্রবেশাধিকার নেই; তাদের সঙ্গে যে কোনো ধরনের কোয়ালিশন, বা অংশীদারিত্ব অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমের ক্ষমতাকাঠামোর দখলে রয়েছে বিশাল সম্পদ, গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং কার্যকরীকরণের উপায়। অর্থাত্ কর্তৃত্বময়, ডমিনেন্ট হওয়াতে তারা তাদের অস্তিত্ব নিয়ে সদাই ভীত, আতঙ্কগ্রস্ত; হয় কর্তৃত্ব থাকবে, নয় তো সব হারাতে হবে, কোনো মধ্যপন্থা নেই। তাই যারা তাদের সঙ্গে একমত নয়, তারা সবাই ‘সপত্ন’ (অ্যাডভারসারি)।
ব্রাসেলস হয়তো নির্বাচন-বিদ্রোহসম্পৃক্ত ঘটনাবলিকে অবজ্ঞা করার চেষ্টা করবে; তবে সাবধানের মার নেই তো! নির্বাচনি ফলাফল প্রকাশের প্রায় তিন-চার দিনের মাথায় (ইইউর সংসদ নির্বাচনের পর নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে) গোপনে আয়োজিত সান্ধ্য ভোজসভায় (নির্বাচনোত্তর) ইইউ কমিশনের চারটি গুরুত্বপূর্ণ পদে—বর্তমান কমিশন প্রধান উরসুলা ফন ডের লিয়েনকে পুনরায় কমিশন প্রধান হিসেবে নির্বাচিন করা হয়, বাকি তিনটি পদে নির্বাচিত করা হয় অর্ধমিলিয়ন জন-অধ্যুষিত মাল্টার ও প্রায় ১ মিলিয়ন জন অধ্যুষিত এস্তোনিয়ার এবং ইউরোপের প্রান্তিক দেশ পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রীদেরকে। ইইউ কমিশন জনভোটে নির্বাচিত কোনো অর্গান নয়। নির্বাচনের চার দিন পর আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে। হাঙ্গেরিকে ইইউর আদালত (সরাসরি ইইউ নয়, আদালত প্রায় এক মিলিয়ন জন-অধ্যুষিত লুক্সেমবুর্গে অবস্থিত) দোষী সাব্যস্ত করে এই মর্মে যে, বছর পাঁচেক আগে মাইগ্রেশন-সম্পর্কিত চুক্তির নিয়মকানুন হাঙ্গেরি সঠিকভাবে মেনে চলেনি, তাই দেশটিকে ২০০ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা করা হয় এবং পরিশোধে বিলম্বন বাবদ দিনপ্রতি খেসারত নির্ধারিত হয় ১ মিলিয়ন ইউরো। যাহোক, নিয়মকানুন-বহির্ভূত আগাম গঠিত নতুন ‘কমিশন’ গঠনের মাধ্যমে অথবা অবাধ্য সদস্য হাঙ্গেরিকে বড় অঙ্কের জরিমানা করে,—‘কোনো রদবদল’ ঘটেনি, অর্থাত্ ইইউ একতাবদ্ধ, প্রমাণ হয় কি না, বলা কঠিন; তবে সদ্য নির্বাচন বাসিগন্ধ গুমোট পরিবেশে তাজা বাতাসের অবাধ প্রবাহের জানালা খুলে দিয়েছে।
নির্বাচিত অস্পৃশ্য দলগুলোর কোয়ালিশনের মাধ্যমে নতুন সংসদীয় ‘ব্লক’ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চলছে; যার অর্থ—ইইউতে দীর্ঘদিন ধরে যে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি চলছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
লেখক: আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ রচয়িতা