পরাধীন থেকে কেউ কখনও স্বাধীন সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। রাষ্ট্রের ক্ষতি করলো যারা, তারা হয়তো অনুতপ্ত। কিন্তু প্রকাশ্যে তা বলছে না। কারণ তারা কোনও না কোনোভাবে দেশবিরোধী অপশক্তির দ্বারা প্রভাবিত। সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের কথাই ধরা যাক। কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা এই ছাত্র আন্দোলন শুরুতে দেশের সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল। মিছিল, সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করেছেন, এমন সুন্দর দৃশ্যও দেখেছি।
তাদের আন্দোলনের শুরুর অংশ ছিল অত্যন্ত সুন্দর, সুশৃঙ্খল। তাই জনসমর্থন পেতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি দিয়ে তারা যখন বলতে গেলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো তখন স্পষ্টতই বোঝা গেলো আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব আর শিক্ষার্থীদের কাছে নেই। নেতৃত্ব চলে গেছে রাষ্ট্রবিরোধী অপশক্তির কাছে। আন্দোলনের নামে রাষ্ট্রের ব্যাপক ক্ষতি করা হলো। এখনও মনে হয় একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। রাষ্ট্রের এই যে এত ক্ষতি করা হলো, তা বাস্তব নয়। কারণ দেশপ্রেমিক কোনও মানুষ রাষ্ট্রের এমন ক্ষতি করতে পারে না। অথচ এটি দুঃস্বপ্ন নয়। পুরোটাই বাস্তব। আমরা দেশকে বলি মাতৃভূমি। অর্থাৎ দেশ আমার মমতাময়ী মায়ের মতো। অথচ তাকেই আবার চরমভাবে লাঞ্ছিত করা হলো। যারা মাকে লাঞ্ছিত করলো তাদের চেহারা, আচার, আচরণ, ঔদ্ধত্য প্রকাশের ভঙ্গি ঠিক যেন একাত্তরের সেই ঘৃণিত রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের মতো। একাত্তরে রাজাকার, আলবদরদের সহায়তায় পাকহানাদার বাহিনী যেভাবে নারকীয় কায়দায় রাষ্ট্রের ক্ষতি করেছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর আবার একই দৃশ্য দেখতে হলো।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ওপর ভর করে একাত্তরের সেই অপশক্তিই আবার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চরম ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলো। যদিও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, জ্বালাও, পোড়াওয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রের যে ক্ষতি করা হয়েছে তার দায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নয়। এটাই সত্য। মেট্রোরেল, সেতু ভবন, বাংলাদেশ টেলিভিশন, এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, ডাক বিভাগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে যেভাবে ভাঙচুর করা হয়েছে, আগুন দেওয়া হয়েছে, এটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাজ নয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুষ্কৃতকারী ও জঙ্গিদের কাজ। তবু কথা থেকে যায়। নারকীয় এই ধ্বংসযজ্ঞের সুযোগ করে দিয়েছে কারা?
কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির সুযোগটাই তো সাম্প্রদায়িক অপশক্তি লুফে নিয়েছে। কী নির্দয়, নিষ্ঠুরভাবে তারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ক্ষতি করলো? কে বা কারা তাদের এই সুযোগ করে দিয়েছে? রাষ্ট্রের এই যে এত ক্ষতি হলো তার দায় কার?
আমার সাংবাদিকতা জীবনের বেশিরভাগ সময়ই ব্যয় হয়েছে দেশের ছাত্র আন্দোলন, শিক্ষাজীবন বিশেষ করে শিক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে ঘিরে। একসময়ের দেশসেরা দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাকের বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে আমার সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়। ৯০-এর গণআন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ খুব কাছ থেকে দেখেছি। বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ছাত্রদের আন্দোলনে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছে। কিন্তু ছাত্র নেতৃত্বের দৃঢ়তায় অপশক্তির উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এই প্রথম দেখলাম ছাত্র আন্দোলনকে অত্যন্ত সচতুর কায়দায় ব্যবহার করেছে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি।
তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশসেরা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শত শত শিক্ষার্থীর মুখে ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার...’ এই স্লোগানও উচ্চারণ করিয়েছে। কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুগান্তকারী ভূমিকার কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। পাশাপাশি এ কথাও লেখা থাকবে এই আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ চরম রাষ্ট্রবিরোধী স্লোগান তুলেছিল। দেশের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে মহান স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই শত শত শিক্ষার্থীর মুখে উচ্চারিত হলো– ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’। ছি ছি কী লজ্জা। কী অপমান? ইতিহাসে আরও লেখা থাকবে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি রাষ্ট্রের ব্যাপক ক্ষতি করেছে।
কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু করেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের সব দাবি মেনে নিয়েছে সরকার।
৫৬ ভাগ সরকারি কোটার পরিবর্তে এখন মাত্র ৭ ভাগ সরকারি কোটা থাকবে। দাবি তো আদায় হলো। অথচ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এখনও তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়নি। ফলে সন্দেহ অবিশ্বাসের ডালপালা ক্রমশ বাড়ছে। পরাধীন থেকে কেউ কখনও স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না এই কথাটাই এখন জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে।
আট দফা দাবি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গত কয়েক দিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার বিচার, অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের স কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া, মেধার ভিত্তিতে হলে হলে সিট বণ্টন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টর পদে পরিবর্তনসহ নানা প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি খুলে দেওয়া উচিত?
আন্দোলনের একটা পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বলপূর্বক হল থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। বিভিন্ন কক্ষে ভাঙচুর ও লুটপাট করার অভিযোগ রয়েছে। এমন উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে হুট করে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেওয়া সম্ভব নয়– এই মন্তব্য করেছেন স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী। তার কথায় যুক্তি আছে।
কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরুর পর্যায়ে দেশের সাধারণ মানুষ ব্যাপক সমর্থন জুগিয়েছে। কিন্তু মাঝ পথে কমপ্লিট শাটডাউনের সুযোগে রাষ্ট্রের এই যে ক্ষতি করা হলো তা মোটেই সমর্থন করছেন না দেশের সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন ছাত্রদের দাবি তো মেনে নিয়েছে সরকার। তবু কেন আন্দোলন প্রত্যাহার করা হচ্ছে না?
অবিলম্বে বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেওয়ার দাবি যৌক্তিক। কিন্তু দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কথাও তো ভাবতে হবে। সরকারকে তো একটু সময় দিতে হবে। দেশকে ভালোবেসে আসুন সব অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। শুভ কামনা সব দেশপ্রেমিক মানুষের জন্য।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো।
সৌজন্য : বাংলা ট্রিবিউন