শেখ হাসিনার সরকারের অবসান ঘটে এই বছরের ৫ আগস্ট। গত জুলাই মাসে শুরু হওয়া শান্তিপূর্ণ কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যা বিগত সরকারের মদতে দেশব্যাপী নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের নৃশংস আক্রমণের কারণে বিক্ষোভে রূপ নেয়। জাতিসংঘের হিসাব মতে, অন্তত ৬৫০ জন মারা যায় এই আন্দোলনে। আট দফা, নয় দফাসহ বিভিন্ন দফা পেরিয়ে ৩ আগস্ট ছাত্র-জনতা শহীদ মিনারে ঘোষণা করে এক দফা- শেখ হাসিনার পদত্যাগ।
প্রায় তিন সপ্তাহব্যাপী এই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করা হয়। ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা প্রায় ১৬ বছরের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ভারতে এবং এই কলাম যখন লিখছি তখন তিনি ভারতের আশ্রয়ে আছেন। এরপর থেকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। কয়েক দিনের সরকারবিহীন বাংলাদেশে প্রকট রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নৈরাজ্যের পর, পরিস্থিতি শান্ত হতে শুরু করেছে এবং 'নতুন স্বাভাবিক' (New Normal)-এ ফিরে যেতে শুরু করেছে জনগণ ও দেশ। নিরাপত্তাহীনতার কারণে কর্মবিরতিতে থাকা পুলিশ সদস্যরা গত সপ্তাহের বুধবার বাংলাদেশের অধিকাংশ থানায় কর্মস্থলে ফিরে আসতে শুরু করে। ফলস্বরূপ এ সপ্তাহে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করা হয়েছে পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায়।
একটি অতি সাম্প্রতিক আপডেট হলো যে ১৪ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আরও আট জনকে অভিযুক্ত করে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এছাড়াও রংপুর, ঢাকা ও চট্টগ্রামে শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে আরও কয়েকটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে গত কয়েক দিনে।
বাংলাদেশের প্রথিতযশা বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) বাংলাদেশের তদন্ত সংস্থার উপ-পরিচালক (প্রশাসন) আতাউর রহমান নিশ্চিত করেছেন যে আইসিটি বাংলাদেশ তদন্ত সংস্থা হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগটি নথিভুক্ত করেছে এবং নথিভুক্ত করার মাধ্যমে এই অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে।
আতাউর রহমান আরও যোগ করেছেন, তদন্ত শেষ হলে তারা ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর অফিসে প্রতিবেদন জমা দেবেন, যাতে পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করা যায়।
বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত পৃথক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক অধ্যাপক আলী রিয়াজের মন্তব্য। তিনি এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন, ১৪ জুলাই থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে সংজ্ঞায়িত মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে।
তিনি আরও বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ে সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের জন্য শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা হলে তার সুষ্ঠু বিচার করা হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ।
রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের পর বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মামলা পরিচালনায় অপারগ হলে, বর্তমান সরকার জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) যেতে পারে বলেও প্রস্তাব করেন অধ্যাপক রিয়াজ।
এগুলো ছিল ঘটনার পিছনের কথা বা ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি। এখন এই ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরির ভিত্তিতে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে কয়েকটি প্রশ্ন।
প্রথম প্রশ্ন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আমাদের দেশীয় আদালতে অর্থাৎ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা উচিত, নাকি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে মামলাটি জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে স্থানান্তর করা ভালো?
দ্বিতীয় প্রশ্ন এবং এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: শেখ হাসিনা এবং অন্যদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা কি গণহত্যা (Genocide) নাকি হত্যাযজ্ঞ (Mass Killing) হওয়া উচিত?
আসুন নিজেরাই উত্তরগুলো খুঁজে বের করি। প্রথমেই বলি, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কী?
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) রোম সংবিধান নামে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাজ কী? আইসিসি প্রথমে অভিযোগ তদন্ত করে এবং তদন্তে নিশ্চিত প্রমাণ পেলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করে এমন গুরুতর অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার করে। গুরুতর অপরাধগুলো হলো- গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং আগ্রাসনের অপরাধ।
শেষ অবলম্বনের আদালত বা Last Resort হিসাবে, আইসিসি কোনও দেশের Criminal Judicial System বা অপরাধমূলক বিচার ব্যবস্থার পরিপূরক হিসাবে কাজ করে, প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে নয়। এর অর্থ হলো, আইসিসি কেবল তখনই কোনও গুরুতর অপরাধের অভিযোগের বিচার করে যখন কোনও দেশ নিজ থেকে সেই অপরাধের বিচার করে না, কিংবা বিচার করতে অনিচ্ছুক বা অক্ষম হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনে মামলা হবে। এছাড়া জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া নারকীয়তার তদন্ত হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
আপাতত আমাদের হাতে থাকা তথ্য থেকে আমরা নিশ্চিতভাবেই অনুমান করতে পারি, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো গুরুতর অভিযোগের তদন্ত ও বিচার আমাদের অভ্যন্তরীণ আদালতের এখতিয়ারে হবে।
নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পথচলা মাত্র গত সপ্তাহে শুরু হলেও এ সরকার সুষ্ঠু ও ন্যায্য বিচারের সম্ভাব্যতা নিয়ে কোনও দ্বিধা বা সংশয় দেখায়নি। অপরদিকে বিগত সরকারের আমলেই চলতি বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে দেশব্যাপী ছাত্র ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর রাষ্ট্রের নৃশংসতা ও হামলার তদন্ত করতে জাতিসংঘ তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
যদিও বিগত শেখ হাসিনা সরকার বলেছিল তার সরকার তদন্ত করবে এবং এই তদন্তে তারা জাতিসংঘের সাহায্যকে স্বাগত জানায়, কিন্তু জাতিসংঘ কর্তৃক পৃথক ও স্বাধীন তদন্তে বিগত সরকার একমত ছিল না।
অপরদিকে, জাতিসংঘের মুখপাত্র জানিয়েছিলেন যে জাতিসংঘ নীতিগতভাবে একক ও স্বাধীনভাবে তদন্ত করে। কোনও ইনভেস্টিগেশন বা তদন্তে জাতিসংঘ কখনোই কোনও দেশের সরকারের বা কোনও প্রতিষ্ঠানের সাহায্যকারী ভূমিকা পালন করে না।
জাতিসংঘকে স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে দেওয়ার বিষয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তকে আমি আন্তরিকভাবে প্রশংসা করি এবং স্বাগত জানাই। উল্লেখ্য, এই তদন্তে বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যান্য সংস্থা শুধু জাতিসংঘকে সাহায্যকারী হিসাবে অবদান রাখবে।
আমার মতে, এটি একটি সুষ্ঠু ও ন্যায্য তদন্তের জন্য একটি শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করবে, যার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী বিচারকার্য পরিচালিত হবে।
উপরন্তু আমি মনে করি, কেবল তদন্ত নয়, বরং সুষ্ঠু ও ন্যায্য বিচারের পুরো পথ নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন- অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের থেকেও সহায়তা ও নির্দেশনা চাওয়া উচিত।
এছাড়া, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা এবং গোষ্ঠীগুলোকেও পর্যবেক্ষক হিসাবে স্বাগত জানানো উচিত, যদি তদন্ত পরবর্তীকালে এই বিচার শুরু হয়।
এখন দ্বিতীয় এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি আসে: তদন্তের ফলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কি গণহত্যা বা Genocide প্রমাণিত হতে পারে?
জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনের অধীনে, অনুচ্ছেদ দুই-এ জেনোসাইড বা গণহত্যার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন অনুযায়ী, গণহত্যা বা জেনোসাইড হলো নিম্নলিখিত পাঁচটি কাজের মধ্যে যেকোনও একটি কাজ, যা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে, একটি ন্যাশনাল, অ্যাথনিকাল, রেশিয়াল অথবা রিলিজাস বা ধর্মীয় কোনও গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে সংঘটিত হয়।
এই পাঁচটি কাজ হলো: উপরে উল্লিখিত যেকোনও গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা, তাদের গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা, কোনও গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তাদের জীবনযাত্রার শর্ত আরোপ করা, গোষ্ঠীর জন্ম রোধ করা এবং জোরপূর্বক গোষ্ঠী থেকে শিশুদের সরিয়ে দেওয়া।
আমাদের বোঝার সুবিধার্থে উপরোক্ত সংজ্ঞা থেকে আমরা গণহত্যার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে আলোচনা করতে পারি।
প্রথমেই বলে নিই, সৎ এবং সর্বোত্তম উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও জেনোসাইড কনভেনশনের এই সংজ্ঞা সম্পূর্ণভাবে সমস্যামুক্ত নয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশ্লেষকদের চোখ দিয়ে এই সংজ্ঞাকে ‘অত্যধিক সীমাবদ্ধ' হিসাবে দেখা হয়। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, কেবল জাতি, বর্ণ ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালানো সম্ভব। এই সংজ্ঞা রাজনৈতিক এবং সামাজিক গোষ্ঠীগুলোকে জেনোসাইডের সম্ভাব্য শিকার হিসাবে বাদ দেয়।
আমাদের প্রেক্ষাপটে, এই বছরের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে রাষ্ট্রের (পুলিশ, বিজিবি, র্যাব এবং সেনাবাহিনী) হাতে নিহত ছাত্র এবং বেসামরিক ব্যক্তিরা কেবল রাজনৈতিক ও সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পড়ে, যা দুর্ভাগ্যবশত জেনোসাইড কনভেনশনের সংজ্ঞার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়।
আবার, জেনোসাইডের সংজ্ঞাটিকে 'খুব ঢিলেঢালা' হিসাবেও দেখা হয়, কারণ যদিও বলা হয় জেনোসাইড হলো Epitome of Human Evil বা মানুষের নারকীয়তার প্রতীক বা গণহত্যাকে "সকল অপরাধের মধ্যে জঘন্যতম অপরাধ" হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তা সত্ত্বেও জেনোসাইড সংঘটিত হওয়ার জন্য হত্যাকাণ্ডের প্রয়োজন হয় না।
উপরন্তু, এখানে একটি বিষয় ফোকাসিং পয়েন্ট হওয়া উচিত, জেনোসাইড কনভেনশন বলে যে গণহত্যার সাথে 'ধ্বংস করার অভিপ্রায়' বা Intent to destroy জড়িত।
জাতি, বর্ণ, ধর্ম এবং জাতীয়তার মতো involuntary associations-এর কারণে উক্ত গোষ্ঠীর সদস্যদের ধ্বংস করার 'উদ্দেশ্য' অন্যান্য ঘটনা থেকে গণহত্যাকে আলাদা করে।
সুতরাং, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনীত জেনোসাইড বা গণহত্যার অভিযোগ প্রসিকিউশনের পক্ষে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা কঠিন হবে বলে ধারণা করছি।
সরকারপ্রধান হিসাবে শেখ হাসিনার নির্দেশে কোনও সরকারি বাহিনী জাতি, জাতীয়তা, বর্ণ বা ধর্মের ভিত্তিতে কোনও নির্দিষ্ট 'গোষ্ঠীর সদস্যদের' হত্যা করেছে তার এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না, যাতে করে জুলাই ও আগস্টের সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে শত শত ছাত্র ও বেসামরিক লোকের মৃত্যুকে গণহত্যা হিসেবে বিচার করা যেতে পারে।
শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকে এই আন্দোলনকে বরাবরই রাজনৈতিক মদতপুষ্ট এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিএনপি, জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক সদস্য বলে বারবার উল্লেখ করা হয়েছিল।
যদিও আপাতদৃষ্টিতে শেখ হাসিনা সরকারের করা হত্যাকাণ্ডকে বা হত্যাযজ্ঞকে জেনোসাইড হিসেবে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না, তবে শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে বলে আমার মনে হয়। যদিও সবকিছুই যথাযথ তদন্ত এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে হতে হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের সংজ্ঞা অনুসারে, মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে রয়েছে খুন, উচ্ছেদ, দাসত্ব, নির্যাতন, জনসংখ্যার জোরপূর্বক স্থানান্তর, কারাবাস, ধর্ষণ, নিপীড়ন, জোরপূর্বক গুম এবং বর্ণবৈষম্য ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মত অনুসারে, যখন উপরে উল্লেখিত অপরাধগুলো কোনও বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে "Widespread and Systematic Attack" বা বিস্তৃত এবং পদ্ধতিগত আক্রমণের অংশ হিসাবে পরিচালিত হয় তখন তাকে বলা হয় মানবতাবিরোধ অপরাধ।
এই সংজ্ঞার আলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে হত্যা, নির্যাতন, কারাগারে প্রেরণ, নিপীড়ন, জোরপূর্বক গুম ইত্যাদি অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা যেতে পারে বলে আমার মনে হয়।
এক্ষেত্রে কেবল জুলাই এবং আগস্টের ছাত্র আন্দোলনই নয়, বরং বিগত ১৬ বছরের সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক ও হয়রানি মামলায় বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো- এর সবকিছুই বিবেচ্য হতে পারে।
গত কয়েক বছরে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলো থেকে বারবার শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে বলে সংবাদপত্রে খবর হয়েছে। গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে স্যাংশনও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এমনকি জুলাইতে ছাত্র আন্দোলনে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহার করা ইউএন লেখা যানবাহনকে ঢাকার রাস্তায় দেখা গেছে। এই ছবি সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতিসংঘের তরফ থেকেও বিগত শেখ হাসিনা সরকারকে কারণ দর্শাতেও বলা হয়েছিল।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরপরই কথিত আয়নাঘর থেকে বছরের পর বছর গুম হওয়া মানুষদের সন্ধান মিলতে শুরু করেছে, যা হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা করেছে। এগুলো সবই মানবতাবিরোধী অপরাধ।
নতুন সরকারের প্রথম সপ্তাহের কার্যকলাপের একটা বিশাল অংশই ছিল মিথ্যা মামলা থেকে রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সাধারণ আন্দোলনকারীদের মুক্তি দেওয়া।
তারপরও আমাদের মনে রাখতে হবে, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। ক্রিমিনাল কেস বা ফৌজদারি মামলায় প্রসিকিউশন বা রাষ্ট্রপক্ষকে যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে অভিযুক্ত আসামির বিপক্ষে আনা অপরাধের অভিযোগকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হয়। ফৌজদারি আদালতে অভিযোগ প্রমাণের এই প্রক্রিয়া তাই বেশ জটিল।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের বিচারকার্য প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়েছে বারবার। বিভিন্ন সময়ে বিচারের উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে জাতিসংঘসহ নামি মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
বর্তমান এবং পরবর্তী সরকারের ওপর গুরুদায়িত্ব হবে যদি তদন্তের পর শেখ হাসিনা এবং অন্যদের বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের বিচারকার্য শুরু হয় তাহলে সেই বিচারকে পুরোপুরি স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ রাখা। কেবল নামেই আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল নয় বরং কার্যত আন্তর্জাতিক মানের বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। আদালতে পেশ করা সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সুষ্ঠু বিচার যেন হয়, কোনও মব ট্রায়াল বা মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার যেন অভিযুক্তরা না হয়।
উপসংহারে বলা যায়, জুলাই ও আগস্টে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের সময় বাংলাদেশের রাজপথে নিরস্ত্র ছাত্র, শিশু ও সাধারণ নাগরিকদের বিনা প্ররোচনায় হত্যা একটি নজিরবিহীন এবং অগ্রহণযোগ্য ঘটনা। 'আইনের শাসন'-এর মূল ধারণাটি মনে করিয়ে দেওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়: আইনের চোখে সবাই সমান। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং কেউ নিচে নয়।
আমরা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাগরিক, কেবল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের নয়, বরং প্রতিটি অপরাধের বিচারিক প্রক্রিয়ায় ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচার দাবি করি। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যে। অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আমরা আর রক্তক্ষয় দেখতে চাই না রাজপথে। মানবাধিকার এবং শান্তিময় সময়ের লক্ষ্যে আমাদের যাত্রার আজ থেকেই শুভ সূচনা হোক।
লেখক: ব্যারিস্টার-এট-ল, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউ্ন থেকে নেওয়া