একজন শিক্ষার্থীর দৃষ্টিতে সম্ভাব্য পররাষ্ট্রনীতি কেমন হতে পারে

রাকিব হাসান রাফি    
ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩:১৬

বাংলাদেশের আয়তন ৫৬,৯৭৭ বর্গমাইল। অথচ এ দেশটিতে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বসবাস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য হচ্ছে আইওয়া। আইওয়ার আয়তন প্রায় ৫৬,২৭৩ বর্গমাইল। আইওয়াতে বসবাসরত মোট জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৩২ লাখের কাছাকাছি। আর যদি পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বিবেচনা করি, তাহলে বলতে হবে ৩৭,৯৬,৭৪২ বর্গমাইল আয়তনের বৃহৎ রাষ্ট্রে মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩৩ কোটি।
বাংলাদেশ ও আইওয়ার আয়তন প্রায় কাছাকাছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট ৫০টি অঙ্গরাজ্য রয়েছে এবং আয়তনের দিক থেকে বিবেচনা করলে আইওয়ার অবস্থান এ ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ২৬তম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্ষুদ্র অঙ্গরাজ্যের সমান আয়তনবিশিষ্ট একটি স্বাধীন ও সাবভৌম রাষ্ট্রে দেশটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের থেকে বেশি মানুষ বসবাস করে।
বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, নদী ভাঙন, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে বাংলাদেশে প্রত্যেক বছর বেশ কিছু পরিমাণ ভূমি চাষাবাদ ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে।
আমার মনে হয় না হংকং, মোনাকো, মালদ্বীপ, মাল্টা, বাহরাইন ও সিঙ্গাপুর ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো রাষ্ট্র পাওয়া যাবে সেখানে এত অল্প জায়গায় এত অধিক সংখ্যক মানুষের বসবাস। হংকং চীনের স্বায়ত্তশাসিত একটি অঞ্চল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় মোনাকো, মালদ্বীপ ও মাল্টা হচ্ছে মাইক্রোস্টেট। আয়তন, জনসংখ্যা ও অর্থনীতির পরিধির কথা বিবেচনা করলে রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় মোনাকো, মালদ্বীপ, মাল্টা, বাহরাইন ও সিঙ্গাপুরের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও আমাদের দেশ খুব একটা অগ্রসর নয়। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিক্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী এ দেশের শতকরা ১৮.৭ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করেন। শিল্পক্ষেত্রে আমাদের দেশ এখনও কাঙ্ক্ষিত উন্নতি লাভ করতে পারেনি। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার বেশিরভাগ আসে তৈরি পোশাক, কৃষি, চিংড়ি ও বিভিন্ন স্বাদু পানির মাছ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করা প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ থেকে। প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ আমাদের দেশে যথেষ্ট পরিমাণে নেই।
হাজারো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিপত্তিশালী রাষ্ট্রের কাছে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান আমাদের জন্য যেভাবে আশীর্বাদ, ঠিক একইভাবে আমাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার একটি প্রধান কারণ হতে পারে আমাদের দেশের ভৌগলিক অবস্থান। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান কি ভবিষ্যতের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হবে, নাকি এটি আমাদের জন্য গলার কাঁটা হবে, তা নির্ভর করবে যখন যে সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকবে, তাদের গ্রহণ করা পলিসির ওপর।
বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশের মাঝে ভারতবিদ্বেষ রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ দেশের সাধারণ মানুষের ভারতবিদ্বেষী মনোভাবকে কোনোভাবে সমর্থন করি না। তবে একটি বিষয় সত্য যে ভারত আমাদের প্রতিবেশি। প্রতিবেশিকে কখনও পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ভারতের সঙ্গে আমাদের দেশের প্রায় ২ হাজার ৫৪৫ মাইল দীর্ঘ সীমারেখা রয়েছে। উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম তিন দিক থেকে আমরা ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত। বাংলাদেশের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর এবং বঙ্গপোসাগরেও বাংলাদেশের সাথে ভারতের সংযোগ ঘটেছে।
ভারতের মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারতের পেটের ভেতর বাংলাদেশের অবস্থান। ভারতের মানচিত্র আঁকলে পরোক্ষভাবে আমাদের দেশের মানচিত্র আঁকা হয়ে যায়। ধর্মীয় বিষয় বাদ দিলে সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাংলাদেশের সাথে ভারতের পার্থক্য তেমনভাবে চোখে পড়ে না। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান একই রাষ্ট্রের অংশ ছিল। ভারতের সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র।
বিভিন্ন কারণে ভারতের প্রতি আমাদের নির্ভরশীলতা থাকবে এটা স্বাভাবিক। ভারতের সঙ্গে কোনো কারণে বৈরিতা সৃষ্টি হলে আমাদের দেশের মানুষের জন্য তা কল্যাণ বয়ে আনবে না। তাছাড়া বর্তমান পৃথিবীতে ভারত একটি উদীয়মান পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভারত বর্তমান বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। এছাড়াও সামরিক দিক থেকে ভারত এ পৃথিবীর চতুর্থ শক্তিধর রাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো পশ্চিমা বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকদের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে।

আয়তন ও জনসংখ্যা এমনকি অর্থনীতির পরিধির কথা চিন্তা করলে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে অসমতা থাকবে। এটা স্বাভাবিক। আমাদের দেশ আমদানিনির্ভর রাষ্ট্র এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসের জন্য আমরা ভারতের প্রতি নির্ভরশীল। প্রত্যেক বছর বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ তুলনামূলকভাবে স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা লাভের জন্য ভারতে যান। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রায় ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভারত অধিকাংশ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোকে উপনিবেশের চোখে দেখে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিজেপির রাজনৈতিক নেতারা অনেকে যখন অখণ্ড ভারতের কথা বলেন, তখন মিয়ানমার, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপের মতো কয়েকটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা হয়। ভারত ইতিপূর্বে হায়দ্রাবাদ ও সিকিমের মতো দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে গোগ্রাসে গিলে খেয়েছে। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো সে সময় ভারতের বিপক্ষে কোনো অবস্থান নিতে পারেনি।
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মাঝে পারস্পারিক সহায়তা ও বন্ধুত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে সার্ক গঠন করা হয়েছিল। সার্ক বর্তমানে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতে, ভারতের উদাসীনতার কারণে সার্ক কার্যকরভাবে ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ভারত বিশ্ব পরিসরে পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ভারতের মধ্যে সে সম্ভাবনা রয়েছে প্রবলভাবে।
এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত ষষ্ঠ রাষ্ট্র হিসেবে স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করতে চায়। ভারতের নীতি-নির্ধারকদের অনুধাবন করতে হবে যে প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে শীতল সম্পর্ক বজায় রেখে ভারত কোনও দিন পরাশক্তি কিংবা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে না। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
দুর্ভাগ্যবশত বাজপেয়ী পরবর্তী ভারত সকল সরকার দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার পরিবর্তে এ সকল দেশের প্রতি উপনিবেশের মতো আচরণ দেখিয়েছে। নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের ওপর ভারতের এ উপনিবেশবাদি আচরণ প্রকট রূপ ধারণ করেছে।
ভারতও বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। যেসব দেশ থেকে ভারত সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আয় করে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশি ক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল। সেভেন সিস্টার্স হিসেবে পরিচিত ভারতের সাতটি রাজ্য হচ্ছে আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মিজোরাম ও অরুণাচল। শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেকের ১২ থেকে ১৪ মাইলের সঙ্কীর্ণ অংশ বাদ দিলে ভারতের রাজধানী দিল্লির সাথে এ সাতটি রাজ্যের কোনো ধরনের স্থল সংযোগ নেই।
পশ্চিমবঙ্গ ও সেভেন সিস্টার্সের রাজ্যসমূহের নিরাপত্তার জন্য ভারত বাংলাদেশের কাছে কোনো না কোনোভাবে দায়বদ্ধ। ভারত বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করেছে বিভিন্ন সময়। কাঁটাতারের বেড়া থেকে শুরু করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে বিএসএফের কার্যক্রম আমাদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এছাড়াও বিগত সাড়ে পনেরো বছর ভারত বাংলাদেশের জনগণের সাথে সুসম্পর্ক উন্নয়ন করার চেষ্টা করেনি বরং এ দেশের মানুষের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে একটি রাজনৈতিক দলকে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় রাখার চেষ্টা করেছে।
ভারতের নীতি-নির্ধারকদের এ বিষয়টি অনুধাবন করা প্রয়োজন যে দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্যেকটি দেশের সাথে তাদের সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে জনগণের মতামত ও অংশীদারত্বের ভিত্তিতে। কোনও ব্যক্তি বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হতে পারে না।
ইসরায়েল আয়তনে অতি ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্র। ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া বলা হয়। জর্ডান ও মিশর ইসরায়েলের প্রতিবেশি দুইটি রাষ্ট্র এবং এ দুই দেশের সাথে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। তবে সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় কারণে ইসরায়েলের সঙ্গে মিশর ও জর্ডানের সম্পর্ক সাধারণ জনগণের স্তরে পৌঁছায়নি। বলাবাহুল্য, ইসরায়েল এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত যে অঞ্চলের প্রত্যেকটি দেশের সাথে তার কোনো না কোনো দিক থেকে বৈরিতা রয়েছে। তারপরেও ইসরায়েল আরব রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অবস্থান নিতে পারে কারণ ইসরায়েলের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ পশ্চিমা বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর খুবই জোরালো ও মজবুত সম্পর্ক রয়েছে।
শিক্ষা ও গবেষণা খাতেও ইসরায়েল ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন ও রাশিয়ার স্থায়ীভাবে ভেটো প্রদানের ক্ষমতা রয়েছে। অন্যদিকে সামরিক শক্তিমত্তার দিক থেকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হচ্ছে পাকিস্তান, তুরস্ক ও ইরান যদিও ভারত সামরিক শক্তিতে এ তিন দেশের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে। ইসরায়েলের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক যে রকম নিরেট, বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক ও ইরানের সম্পর্ক ঠিক একই রকম নিরেট নয়।
এ কারণে ভারতের সাথে যদি বাংলাদেশের যুদ্ধের মতো কোনও পরিস্থিতি হয়, সেটা আমাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। কাজেই ভারতের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক অত্যাবশ্যক এবং ভারতের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক হবে দুই দেশের জনসাধারণ কেন্দ্রিক। ভারত ও বাংলাদেশ এ দুই রাষ্ট্রের এমন কোনও কিছু করা উচিত নয় যা পরস্পরের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক হতে হবে ভারসাম্যমূলক। ভারত বাংলাদেশের তুলনায় একটি বৃহৎ রাষ্ট্র এবং এক্ষেত্রে তাদের দায়িত্বের জায়গা বেশি। ভারতের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরালো হোক সেটা আমি মনেপ্রাণে কামনা করি।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কেমন হতে পারে সে বিষয়ে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোররাজি দেশাই আমাদের পথ দেখিয়েছেন। জিয়াউর রহমান ও মোররাজি দেশাইয়ের হাত ধরে বাংলাদেশের সাথে ভারতের যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল সেটি ছিল সত্যিকার অর্থে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সাথে আরেকটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সত্যিকারের সম্পর্ক। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে। এদেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে সে সময় ভারত আশ্রয় দিয়েছিল।
তবে এটাও ঠিক যে, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ভারত আমাদের ওপর যে ধরনের আচরণ দেখিয়েছে তা আমাদের অনেকের মনে তীব্র ক্ষোভ হতাশার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ বিষয়ে বিজেপি এবং রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস উভয় রাজনৈতিক দল প্রায় কাছাকাছি ধরনের মনোভাব পোষণ করেন যা সত্যি দুঃখজনক।
বাংলাদেশের থেকে চীনের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। চীন ও জাপান এ দুই দেশের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা রয়েছে। জাপান ও চীন এ দুই দেশ আমাদের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করে। জাপান বর্তমান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে জাপানের সখ্যতা রয়েছে। জাপান এশিয়া মহাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র। ঐতিহাসিক কারণে চীনের সাথে জাপানের বৈরিতা রয়েছে। ভারতের সাথে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের শীতলতার কারণে চীন কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে।

চীনের বিরাগভাজন হলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপরও চীনের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। চীনের সহায়তা ছাড়া আমরা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কার্যকরি উদ্যোগ গ্রহণে সমর্থ হবো না। জাপান হয়তো বা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে সে অর্থে ভূমিকা রাখবে না।
বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন দাতা রাষ্ট্র হিসেবে চীন ছাড়া অন্যকোনও রাষ্ট্র আমাদের সেভাবে অর্থ সহযোগিতা দিতে পারবে না। ভারতের মতো চীনের সাথেও আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরালো করতে হবে। তবে চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে গেলে ভারতের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো পশ্চিমা দেশ সেটি সহজে গ্রহণ করবে না।
দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ ঘটেছে বাংলাদেশ ও বঙ্গপোসাগরের মধ্য দিয়ে। এ কারণে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয় রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানকে কেন্দ্র করে ভারতের অবস্থান বিশেষত নরেন্দ্র মোদির সাথে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের মিত্রতা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্কে ভাটা পড়েছে। ভারত কোয়াডের সদস্য, কিন্তু তা সত্ত্বেও আপাতদৃষ্টিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারছে না। এ কারণে এ অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেনেজুয়েলা বা ইরানের মতো নয়। আমাদের দেশের অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালিসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, কৃষি ও মাছের প্রধান বাজার পশ্চিমা দেশগুলোতে। আমাদের দেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, একক দেশ হিসেবে বিবেচনা করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করেন এবং তারা এ দেশে রেমিট্যান্স পাঠান। এমনকি উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে অভিবাসনের জন্য আমাদের দেশের মানুষের কাছে পশ্চিমা দেশগুলো বেশি পছন্দের। কাজেই পশ্চিমা দেশগুলো আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে আমাদের দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে এক অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
ঐতিহাসিক দিক থেকেও আমাদের দেশের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর সংযোগ রয়েছে। প্রায় দুইশো বছর ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সংসদীয় কাঠামো রয়েছে যা ওয়েস্টমিনিস্টার দ্বারা অনুপ্রাণিত। পশ্চিমা দেশগুলোও বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে আমাদের অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছে, অন্য রাষ্ট্রগুলো থেকে আমরা সে রকম সাহায্য পাইনি। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছ থেকে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছি।
রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প ছাড়া এ মুহূর্তে বাংলাদেশে রাশিয়ার বড় কোনো স্বার্থ নেই যদিও শোনা যাচ্ছে আমাদের দেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলে রাশিয়া বিনিয়োগে আগ্রহী। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে যদিও বর্তমান রাশিয়া ও সে সময়কার সোভিয়েত ইউনিয়ন এক নয়। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে অবদান রেখেছেন তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান লিওনিড ব্রেজনোভ। ব্রেডনোভ ছিলেন একজন ইউক্রেনিয়ান। বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে গম ও সার আমদানি করে। ফ্রান্স বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমান সময়ে সে অর্থে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। বাংলাদেশ ওআইসির সদস্য। বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহারাইন ও মালয়েশিয়া সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। এসব দেশের প্রত্যেকটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ আসে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও মালয়েশিয়া থেকে। এরদোগানের নেতৃত্বাধীন তুরস্ক বিশ্ব রাজনীতিতে ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। তুরস্ক সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী।
তারা বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে চাইছে। অন্যদিকে পাকিস্তান এখন পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের একমাত্র রাষ্ট্র যাদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। যদিও এ মুহূর্তে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা আশানুরূপ নয়। দেশটি বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। ইরানও সামরিক দিক থেকে অগ্রগামী একটি রাষ্ট্র। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হোক কিংবা অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে হলেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে আমাদের সম্পর্ক জোরদার করতে হবে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সহায়তা চাইতে পারে। সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, কাতার ও কুয়েত ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আমাদের বিভিন্নভাবে অর্থ সহযোগিতা দিয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কিছু দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অভিবাসনপ্রত্যাশী হিসেবে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্র। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডসহ আসিয়ানের দেশগুলোকে বাংলাদেশ ব্যবহার করতে পারে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য। কৌশলগত কারণে পাকিস্তান, তুরস্ক ও ইরানের সাথেও আমাদের সখ্যতা বৃদ্ধি করতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান ও জার্মানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অংশ নিয়েছিল। আজকে জাপান ও জার্মানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কাছের মিত্র। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সের সাথে গ্রেট ব্রিটেন লম্বা সময় ধরে যুদ্ধে জড়িয়েছে। আজকে ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যাকার সম্পর্ক অত্যন্ত জোরালো। বাংলাদেশকেও অতীত ভুলে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে হবে। পাকিস্তানকেও একাত্তরের গণহত্যার জন্য আমাদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে।
মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। ঐতিহাসিকভাবেও বাংলাদেশ বিভিন্নভাবে মিয়ানমারের সাথে সংযুক্ত। আরাকানের রাজসভায় এক সময় বাংলা সাহিত্যের চর্চা হতো। বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেক সাধারণ মানুষ এক সময় জীবন ও জীবিকার জন্য রেঙ্গুনকে বেছে নিতেন। স্বাধীনতার পর থেকে মিয়ানমার সব সময় নিজেদের বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চেয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের নীতি-নির্ধারকেরা সে রকম পদক্ষেপ দেখায়নি। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে মিয়ানমার বেশিরভাগ সময় সামরিক শাসনের অধীনে ছিল।
বর্তমানে মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। বাংলাদেশের নিরাপত্তার সাথে মিয়ানমার জড়িত। মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত ইয়াবা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের চালান আসে। মিয়ানমারের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন না ঘটলে বাংলাদেশে ইয়াবা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব নয়।
এমনকি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানেও মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা ছাড়া বিকল্প কোনও অপশন নেই। মিয়ানমারের জনসাধারণের সঙ্গে বাংলাদেশের জনসাধারণের সম্পর্ক সুদৃঢ় করা প্রয়োজন। মিয়ানমারের সাথে কার্যকরি সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রে এ দুই দেশ লাভবান হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে মিয়ানমারকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত এবং একজন পেশাদার ও দক্ষ কূটনৈতিককে মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।
রাজনীতির ক্ষেত্রে শেষ কথা বলে কিছু নেই। রিচার্ড নিক্সনের শাসনামলে চীন ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, অথচ আজকের বিশ্বে চীন ও রাশিয়া একযোগ হয়ে পশ্চিমা জোটের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তিমত্তা জানান দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, স্নায়ু যুদ্ধ আবার ফিরে আসছে যার একদিকে থাকছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট এবং বিরোধী পক্ষে থাকছে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট।
পরিবর্তনের পথে পা বাড়ানো নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় বাংলাদেশের মতো ছোট দেশগুলো কীভাবে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বজায় রেখে নিরপেক্ষভাবে চলতে পারবে সে বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মাঝে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি ভারতের মতো শক্তিশালি রাষ্ট্রকেও রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্কের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

ভারত এখনও মিলিটারি হার্ডওয়ারের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলোর ওপরও ভারতের নির্ভরশীলতা রয়েছে। পশ্চিমা জোট ও রাশিয়া এ দুই শক্তিকে ব্যালেন্স করে ভারত অগ্রসর হতে পারছে না। তবে বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো সরাসরিভাবে ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় না। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাবকে খর্ব করতে পশ্চিমা দেশগুলোর ভারতকে প্রয়োজন।

ভৌগলিক অবস্থান কিংবা অর্থনীতি যেদিক থেকে বিবেচনা করি না কেনো, বাংলাদেশের পক্ষে ভারত, চীন ও পশ্চিমা জোটের মধ্য থেকে যে কোনও একজনের প্রতি ঢালাওভাবে ঝুঁকে পড়া সম্ভব নয়। এটাও ঠিক যে একই সাথে সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখা যায় না। তাই বাংলাদেশকে নিজেদের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সকল রাষ্ট্রের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। আমাদের নীতি-নির্ধারকদের সকল কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থকে সবার প্রথমে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বাংলাদেশ যেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী রাষ্ট্রের প্লে-গ্রাউন্ডে পরিণত না হয় সে বিষয়ে আমাদের সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার বা চীন কারও সাথে যাতে কূটনৈতিকভাবে আমাদের বৈরিতা সৃষ্টি না হয় সে লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে। সার্ককে কার্যকরি হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সাথে আমাদের আলোচনায় বসতে হবে। একই সাথে অর্থনীতির কথা চিন্তা করে পশ্চিমের দেশগুলোর সাথেও আমাদের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে যদি উপায়ন্তর না দেখে যে কোনও এক পক্ষের প্রতি ঝুঁকে পড়তে হয়; তাহলে সেক্ষেত্রে আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের উচিত হবে পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে মনোনিবেশ করা। পাঁচ বা দশ বছর পর বর্তমান প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটতে পারে এবং পরিবর্তীত পরিস্থিতিকে সামনে রেখে আমাদের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও পশ্চিমের দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক থাকলে বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফের মতো বিভিন্ন সংস্থা থেকে সহজে ঋণ পেতে পারে এবং এ ঋণের অর্থ বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করতে পারে।
এছাড়াও চীন ও ভারতের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সৃষ্টি হওয়া কূটনৈতিক শীতলতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ পশ্চিমের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানাতে পারে। তবে আমাদের দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনসাধারণের স্বার্থকে প্রশ্নের মুখে ছুঁড়ে দেয় এমন কোনো বিষয় আমরা আমাদের দেশে বাস্তবায়িত হতে দিতে পারি না। ইদানিং সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে একটি খবর প্রায়শ শোনা যাচ্ছে। গুঞ্জন উঠেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না কি সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একটি নৌঘাঁটি স্থাপন করতে চায় যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও অফিসিয়াল সোর্স থেকে এখনও এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা হয়নি।
বাংলাদেশের মাটিতে অন্যকোনও দেশ নৌঘাঁটি বা কোনও ধরনের সামরিক স্থাপনা নির্মাণ করুক সেটা আমি চাই না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি এ ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে থাকে সেটা আমাদের দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য অশনি সঙ্কেত হয়ে দাঁড়াবে এবং চীন ও ভারতের সাথে আমাদের সংঘাতের ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করবে। এছাড়াও সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জীব বৈচিত্র্যের জন্য এ ধরনের স্থাপনা হুমকিস্বরূপ। তাই ভবিষ্যৎ পরিণতি বিবেচনা না করে এবং সঠিক বিচার ও বিশ্লেষণ ছাড়া বাইরের কোনও দেশ সম্পর্কে কোনও ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কূটনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়ছিলেন। ভারতের সাথে সে সময় বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। চীন, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম জার্মানি, যুগোস্লাভিয়া, পাকিস্তান ও সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রা পায় তাঁর হাত ধরে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজার সৃষ্টি হয়। বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ আসতে শুরু করে।
এদেশে বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা স্থাপিত হয়। ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে শুরু করে। আমার মনে হয়, আমাদের দেশের নীতি-নির্ধারকেরা পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণে জিয়াউর রহমানের প্রশাসনকে উদাহরণ হিসেবে নিতে পারে। মোটকথা কোনো রাষ্ট্রের সাথে শত্রুতাভাবাপন্ন সম্পর্ক আমাদের কাম্য নয় এবং আমাদের দেশের জন্য তা কল্যাণকর নয়। চীন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও মুসলিম বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সাথে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক হতে হবে ভারসাম্যপূর্ণ এবং এ দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট।
আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমকে প্রশ্নের মুখে ফেলে এমন কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। একই সাথে আমাদেরও সতর্ক থাকতে হবে যেন আমাদের কোনো কর্মকাণ্ড চীনসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। ভৌগলিক অবস্থান, অর্থনীতি এবং জনগণের স্বার্থ এ তিনের ওপর ভিত্তি করে সময়ের সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে গড়ে উঠুক এ দেশের স্বতন্ত্র পররাষ্ট্রনীতি। একজন প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে সেটি কায়মনোবাক্যে আমার কামনা।


রাকিব হাসান রাফি,

শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।