মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতদুষ্ট মধ্যস্থতা

বেলেন ফার্নান্দেজ
  ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৫:৩১

গত সপ্তাহে বৈরুতে হিজবুল্লাহ মহাসচিব হাসান নাসরাল্লাহ এবং জুলাইয়ে হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়াহকে তেহরানে হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে ইরান দু’দিন আগে ইসরায়েলে ব্যাপক হারে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। 
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মার্কিন সামরিক বাহিনীকে ক্ষেপণাস্ত্র নিষ্ক্রিয় করতে ইসরায়েলকে সহায়তা করার নির্দেশ দিয়েছেন, যদিও ইসরায়েল ইতোমধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম বেশ অত্যাধুনিক সরঞ্জামের কয়েকটি স্তর দ্বারা সজ্জিত, যা তাদের ন্যূনতম ক্ষতির বিনিময়ে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানোর সুযোগ তৈরি করে রেখেছে।  
হোয়াইট হাউসে একটি সংবাদ বিবৃতি দানের সময় মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান ঘোষণা করেছিলেন, মার্কিন নৌ-বিধ্বংসী বাহিনী ‘আন্তঃসীমান্ত ক্ষেপণাস্ত্রগুলো উড়িয়ে দিতে ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ইউনিটে যোগ দিয়েছে।’ তিনি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ‘পেশাদারিত্ব’ এবং মার্কিন সামরিক বাহিনীর দক্ষতা এবং আক্রমণের পূর্বাভাস সম্পর্কে সূক্ষ্ম যৌথ পরিকল্পনা প্রণয়নের সামর্থ্য নিয়ে বেশ প্রশংসা করেন। 
অবশ্য গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের চলমান গণহত্যা সত্যিকারভাবে বাধাগ্রস্ত করতে বাইডেন প্রশাসন একবারও পদক্ষেপ নেয়নি। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এখানে এক বছরেরও কম সময়ে ৪১ হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে, যদিও প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। এমনকি অত্যন্ত দক্ষ মার্কিন সামরিক বাহিনী বর্তমানে লেবাননে চলমান নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে হস্তক্ষেপ করারও প্রয়োজন মনে করেনি, যেখানে ইসরায়েল মাত্র এক সপ্তাহেরও কম সময়ে সাত শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছে।
অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক আশঙ্কা করেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে ‘টেনে আনা’ হতে পারে। এতে সতর্ক করা হয়েছিল যে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরই তা বাড়বে। বাস্তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সত্যিই কোথাও ‘টেনে আনা’ হচ্ছে না, বরং নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তারা ইতোমধ্যে সেখানকার যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিদের নির্মূলে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে বার্ষিক বিলিয়ন ডলার জোগান দেওয়ার মার্কিন তৎপরতাই এর প্রমাণ। ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলে কিছু আক্রমণাত্মক অস্ত্রের জোগান বন্ধ করা নিয়ে বাইডেন মাঝে মাঝে কথাবার্তা বললেও মূলত অর্থ সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে বহু গুণ।
আগস্টে বাইডেন প্রশাসন তার অংশীদার ইসরায়েলকে অপরাধ সংঘটনে অনুমোদন দিয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র প্যাকেজ। ২৬ সেপ্টেম্বর রয়টার্স নিউজ এজেন্সির প্রতিবেদনমতে, ইসরায়েল ‘তার চলমান সামরিক প্রচেষ্টায় সমর্থন এবং এ অঞ্চলে একটি গুণগত সামরিক বলয় নিশ্চিত রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৮.৭ বিলিয়ন সহায়তা প্যাকেজ নিশ্চিত করেছে।’ প্যাকেজে প্রয়োজনীয় যুদ্ধকালীন সংরক্ষণে ৩.৫ বিলিয়ন ডলার এবং আয়রন ডোম অ্যান্টি-মিসাইল সিস্টেম, ডেভিডস স্লিং ও একটি উন্নত লেজার সিস্টেমসহ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় মনোনীত ৫.২ বিলিয়ন ডলার অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল।
অন্য কথায়, ইসরায়েল তার নিজস্ব অপকর্ম তথা সন্ত্রাসবাদ বৈধ প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে নিজেকে ‘রক্ষা’ করতে ক্রমবর্ধমান প্রস্তুতির সুযোগ পাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এটি দুর্বোধ্য কিছু নয় যে, ক্রমাগত ইসরায়েলকে ব্যাপকভাবে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিচ্ছে, এমন একটি দেশকে সংঘাতে ‘টেনে নেওয়া’ লাগে না। এটি এমন এক দেশকে নির্দেশ করে, যেটি সব ধরনের ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যে সংঘাতে বেশ ভালোভাবেই সক্রিয়। 
দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার সময়ও যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সামরিকভাবে সহায়তা দিয়েছিল। এ উপলক্ষেও ইরানকে ব্যাপক সন্ত্রাসবাদী আগ্রাসন চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়, যদিও দেশটির ওই পদক্ষেপ ছিল প্রতিশোধমূলক। 
এটি বলাই বরং সংগত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কয়েক দশক ধরে আঞ্চলিক যুদ্ধে নিজেই নিজেকে ‘টেনে আনার’ সূক্ষ্ম কাজ করেছে। এ ক্ষেত্রে ২০০৩ সালে ইরাকের ওপর মার্কিন চাপ প্রয়োগের কথা মনে আসে। তাই আবারও দেশটিকে একটি গণহত্যার নেপথ্য কারিগর হিসেবে খুঁজে পাওয়া গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইয়েমেনে বিয়েতে আমেরিকান ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে। ২০০৬ সালে লেবাননের ধ্বংসযজ্ঞে সহায়তা করতে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীতে বোমা জোগান দেওয়া হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনও মধ্যপ্রাচ্যে এমন কোনো সংঘাতের মুখোমুখি হয়নি, যা নিয়ে দেশটি উত্তেজিত ছিল না।
বাইডেন প্রশাসন গাজায় যুদ্ধবিরতি চায় বলে বিরক্তিকর দাবি করেই যাচ্ছে। অথচ গণহত্যাকারীদের কাছে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র জোগান দিয়ে যুদ্ধবিরতির পথ উন্মোচন করা যায় না। মঙ্গলবারের এক বিবৃতিতে সুলিভান সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই হামলার জন্য গুরুতর পরিণতি হবে এবং আমরা তার জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে কাজ করব।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে আঞ্চলিক বিপর্যয় বাড়াতে তার কাজটি চালিয়ে যাবে এবং আরও ‘পরিণামের’ ব্যাপারে জোর দেবে। বিবৃতিতে সুলিভান আরও গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, পরিস্থিতি ছিল ‘যুদ্ধের কুয়াশা’র মতোই। বিবৃতিতে তিনি এমনও বলেন, তাঁর প্রাথমিক মূল্যায়ন ‘প্রয়োজনে সংশোধন ও সামঞ্জস্যপূর্ণ’ করার অধিকার তাঁর আছে। তবে সাম্প্রতিক যুদ্ধের কুয়াশায় এটি অন্তত স্পষ্ট– চলমান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে একটা পক্ষ হয়ে আছে। 
বেলেন ফার্নান্দেজ: আলজাজিরার কলাম লেখক; ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম