অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে গিয়ে মাত্র চার দিনে ৪০টি সভা ও বৈঠক করেছেন বলে শুনেছি। ৮৪ বছর বয়সেও তাঁর সক্রিয়তা সত্যিই দৃষ্টান্তমূলক; যদিও তাঁর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের কেউ কেউ সেই মাত্রায় সক্রিয়তা দেখাতে পারছেন না। কোনো কোনো উপদেষ্টার কাছ থেকে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কর্মপরিকল্পনাও মিলছে না। অথচ বিশেষ পরিস্থিতিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাদের সুচারুরূপে, সমন্বিতভাবে, জরুরি ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সংস্কার প্রশ্নে দৃশ্যমান কাজ করার কথা ছিল। বিশেষত আর্থিক খাত ছাড়া বাকি খাতের পরিবর্তন খুবই শ্লথ।
এমন প্রশ্নও জাগতে পারে, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ব্যাপকতা কি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাই বুঝতে পারছেন? যে অভ্যুত্থানে দেড় সহস্রাধিক শহীদ, পাঁচ শতাধিক চোখহারা, ২ সহস্রাধিক আহত এখনও হাসপাতালে, সেই গণঅভ্যুত্থানের ফসল সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা স্বভাবতই বেশি থাকবে। বস্তুত এই অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে মানুষের মধ্যে সত্যিকারের অর্থনৈতিক মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, উপদেষ্টাদের সে অনুযায়ী কাজ করার বিকল্প নেই।
শুধু অন্তর্বর্তী সরকার নয়; গণঅভ্যুত্থানের মূল শক্তি ছাত্ররা কি আগের স্পিরিট ধরে রাখতে পারছে? আমার সন্দেহ হয়। যেভাবে যত্রতত্র ‘সমন্বয়ক’ শব্দের অপব্যবহার করা হচ্ছে, সেটা কাম্য নয়। এমনকি কেউ কেউ এই নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করছে বলেও খবর বেরিয়েছে। ওদিকে কেউ কেউ যেন ভুলে যাচ্ছেন, শহীদদের নির্ভুল তালিকা তৈরির কাজ দ্রুততার সঙ্গে শেষ করা খুবই জরুরি। এই গণঅভ্যুত্থানে হতাহতদেরই যদি প্রাপ্য সম্মান দিতে না পারি, তাহলে বাকি আকাঙ্ক্ষাগুলো কতটা পূরণ হবে, সে সন্দেহ রয়েই যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে আরও কিছু কাজ দ্রুতগতিতে করার কথা ছিল। খানিকটা দেরিতে হলেও এগুলো করতেই হবে।
এক. এখন পর্যন্ত গণহত্যার হুকুমদাতা স্বৈরাচার সরকারের কিছু নির্দিষ্ট মন্ত্রী-এমপিকে আইনের আওতায় আনা হলো না। বরং তাদের কাউকে কাউকে সুকৌশলে দেশ থেকে পালাতে সাহায্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ। এরা কারা, যারা তাদের পালাতে সহায়তা করেছে বা করে যাচ্ছে? তারা কীভাবে পালালেন?
দুই. মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে আলোচিত কিছু পুলিশ কর্মকর্তা গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তাদের অনেকে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের ধরা যাচ্ছে না কেন? অতি দ্রুত দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে। সে জন্য পুলিশ বাহিনীতে কয়েক হাজার কনস্টেবল এবং কয়েক হাজার উপপরিদর্শক নিয়োগ দেওয়া জরুরি। পুলিশের পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করতে হবে। সেটি না পারলে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো যেতে পারে। যারা এখনও কর্মস্থলে ফেরত আসেননি তাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে হবে; তাদের বিভাগীয় শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশের চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে হবে ইতিবাচকভাবে।
তিন. জনপ্রশাসনে বিগত সরকারের সময় রাজনৈতিক দলবাজির ভেতর দিয়ে পদোন্নতি পাওয়া অনেক কর্মচারী এখনও গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। এসব দেখার দায়িত্ব কার? এসব সংস্কারে কারও কারও কি আগ্রহের অভাব রয়েছে? সরকারে সম্ভবত আরও গতিশীল ও উদ্যমী ব্যক্তিদের যোগ হওয়া দরকার। এই দেশে সত্যিকারার্থে যোগ্য, দক্ষ, ন্যায়নিষ্ঠ ও সাহসী লোকজন আছেন অবশ্যই। সে রকম মানুষ খুঁজে বের করে দায়িত্ব দিতে হবে।
চার. জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন খুবই জরুরি ছিল, কিন্তু হলো না। আমরা একটি উচ্চশিক্ষা কমিশনেরও প্রস্তাব করেছিলাম। সে ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য নেই কেন? আপাতভাবে মনে হচ্ছে, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত দেশের চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চারজন যোগ্য উপাচার্য পেয়েছে। কিন্তু কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ ভালো হয়নি। সেখানে বেশ কয়েকজন বিতর্কিত ব্যক্তি দায়িত্ব পেয়েছেন। তা ছাড়া দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গোষ্ঠীবদ্ধ সহিংসতা চলছে। এসব বন্ধ করতে হবে; অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে।
কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দেখছি, যেসব শিক্ষক গণআন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের কাউকে কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ট্যাগিং করা হচ্ছে। এসব বন্ধ করতে শিক্ষা উপদেষ্টার দিক থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত দেখা গেল না। এটি সত্যিই হতাশাজনক।
পাঁচ. বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। এসবের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের নাম ইতোমধ্যে সব মিডিয়াতে এসেছে। এসব চোর-ডাকাত, লুটেরা, অর্থ পাচারকারীকে ফিরিয়ে এনে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী দ্রুত শাস্তি দিতে হবে। পাচারকৃত সব অর্থ দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। আমরা বিশ্বাস করি, এই বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। তিনি নিউইয়র্ক সফরকালে দু-একটি সভা করেছেন। এগুলোর ফলাফল আমরা দ্রুত পেতে চাই।
ছয়. আমরা চাই অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোর ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার’ শেষে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ দেবে। সেটিই তাদের মূল কাজ; এই দেশের সব নাগরিকের চাওয়া এটিই। তবে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে ইতিবাচক সংস্কার করতে হবে। এই কাজটি সঠিকভাবে করানোর জন্য বর্তমান সরকার, ছাত্রসমাজ, পেশাজীবী ও সামাজিক শক্তি এবং নাগরিক সমাজের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি করা দরকার।
পরিশেষে বলব, রাজনৈতিক দলের টেকসই সংস্কার ছাড়া একটি টেকসই ও গ্রহণযোগ্য ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। শুধু একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই নতুন করে গণতন্ত্র এবং জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে না। এবার শেষ সুযোগটি হারালে এই রাষ্ট্র এত বড় আকারে জনমানুষের ঐক্য নিয়ে আর কোনোদিন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। তাহলে জাতি হিসেবে আমরা ‘আত্মঘাতী ও অপরিণামদর্শী’ হয়েই থেকে যাব!
শেখ নাহিদ নিয়াজী: শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
[email protected]