বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধিক গান রচনা করেন, যা শুধু সঙ্গীতের গুণেই নয়, আন্দোলনের মূল চেতনাকে তুলে ধরার মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল। এই সময় তিনি গিরিডিতে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন, সেখানে বসেই বাউল সুরে রচিত প্রায় একুশটি গান লিখেছিলেন। এই গানের অন্যতম হলো 'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে'।
এই গানটি রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেমের এক অনন্য প্রকাশ। মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং আত্মিক সংযোগের এক মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে এই গান। কবির অনুভূতির গাঢ়তা এবং তার মাতৃভূমির প্রতি শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ যেন প্রতিটি লাইনে ফুটে উঠেছে। ব্যক্তিগতভাবে, এই গান আমার অত্যন্ত প্রিয়, কারণ প্রতিটি শব্দই হৃদয়কে নাড়া দেয় এবং এক গভীর ভাবাবেগ জাগিয়ে তোলে। আমি প্রায়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই গানের অনুরোধ করে থাকি, কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, অনেকেই এই গানের ভারী বাণীর কারণে গাইতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।
'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে' গানটি বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে রচিত। বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাগ করতে চেয়েছিল, যা বাঙালির মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম দেয়। এই ক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথ তার সৃজনশীলতা দিয়ে জনগণের চেতনা জাগিয়ে তুলেছিলেন। মাতৃভূমি এখানে শুধু এক খণ্ড জমি নয়, বরং কবির কাছে বাংলাদেশ এক জীবন্ত সত্তা, যা তার জনগণের হৃদয়ে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে।
এই গানটিতে বাংলাদেশের প্রকৃতি, তার সৌন্দর্য এবং তার মানুষের প্রতি যে আত্মিক বন্ধন, তা অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। মাতৃভূমি এখানে এক দেবী রূপে দেখা দিয়েছেন, যিনি একাধারে স্নেহময়ী মা এবং সংগ্রামের প্রতীক।
প্রথম স্তবকে কবি মায়ের রূপকে এক অপরূপ দৃশ্যে উপস্থাপন করেছেন। তিনি লিখেছেন, 'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/ তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!'। এই বাক্যগুলোতে রবীন্দ্রনাথ যেন একটি নতুন মায়ের দর্শন পেয়েছেন, যিনি দীর্ঘদিন পরে তার সন্তানদের সামনে প্রকৃত রূপে উপস্থিত হয়েছেন। কবির চোখে মাতৃভূমির এই সৌন্দর্য এতটাই মুগ্ধকর যে তিনি তার চোখ ফেরাতে পারছেন না। এই বাক্যগুলোতে বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্য এবং তার সঙ্গে কবির গভীর আত্মিক সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটেছে।
কবির জন্য মায়ের এই সৌন্দর্য এক বিস্ময়। যেন দীর্ঘকাল পরে নতুনভাবে এই মাকে দেখা। কবি ভাবছেন, এতদিন ধরে কি আমি এই মাকে চিনতে পারিনি? এই অপরূপ রূপ দেখে কবি বুঝতে পারছেন যে, মায়ের সৌন্দর্য আর মমত্ববোধ কত গভীরে প্রবাহিত। এই সৌন্দর্য শুধুমাত্র চোখের দেখা নয়, এটি এক আত্মিক অনুভূতি, যা কবির হৃদয়ে গেঁথে আছে।
এরপরের স্তবকে মা’র রূপ আরও দৃঢ় হয়ে ধরা পড়েছে। 'ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাতে করে শঙ্কাহরণ,/ দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ।' এই লাইনগুলিতে মাতৃভূমিকে দেবী দুর্গার রূপে দেখা হয়েছে। একদিকে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা যোদ্ধা, অন্যদিকে তিনি স্নেহময়ী মা। কবির এই চিত্রকল্পের মধ্যে বাংলার মাটি এবং তার মানুষের প্রতিচ্ছবি ধরা পড়েছে। এক হাতে মায়ের খড়্গ জ্বলজ্বল করছে, যা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক, আর অন্য হাতে শান্তি ও স্নেহের প্রকাশ।
দেবী দুর্গার এই বৈশিষ্ট্যগুলিই বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে কবির চোখে। বাংলাদেশ যেমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তেমনই তার মানুষদের প্রতি স্নেহময়ী ও সুশৃঙ্খল। দুই নয়নে স্নেহের হাসি, আর ললাটে অগ্নিসংকেত যেন মাতৃভূমির শক্তির প্রতীক, যা জনগণকে সর্বদা সুরক্ষা দেয়।
তৃতীয় স্তবকে মায়ের প্রকৃতি ও শক্তির প্রতি নিবেদন দেখা যায়: 'তোমার মুক্তকেশের পুঞ্জ মেঘে লুকায় অশনি,/ তোমার আঁচল ঝলে আকাশতলে রৌদ্রবসনী!'। মায়ের মুক্তকেশ এখানে মেঘের রূপ নিয়েছে, আর সেই মেঘে লুকিয়ে রয়েছে বজ্রের শক্তি। কবি এখানে বোঝাতে চেয়েছেন, বাংলাদেশের প্রকৃতি দেখতে শান্ত হলেও তার ভেতরে রয়েছে প্রবল প্রতিরোধের শক্তি।
আঁচল ঝলমল করছে সূর্যের আলোয়, আর সেই আলো গোটা আকাশকে আলোকিত করছে। মায়ের এই বৈপরীত্যপূর্ণ রূপ—কখনও স্নিগ্ধ, কখনও প্রবল—বাংলাদেশের প্রকৃতির মধ্যেই নিহিত। কবির কাছে, এই মায়ের প্রকৃতি যেমন মমত্বময়ী, তেমনি প্রচণ্ড প্রতিশোধের আগুনও বয়ে আনতে পারে।
পরবর্তী স্তবকে রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করছেন মাতৃভূমির প্রতি তার অতীতের ভুল ধারণাগুলোকে। 'যখন অনাদরে চাই নি মুখে ভেবেছিলেম দুঃখিনী মা/ আছে ভাঙা ঘরে একলা পড়ে, দুখের বুঝি নাইকো সীমা।' এখানে কবি অতীতে তার মাকে অবহেলা করেছেন বলে আক্ষেপ করছেন।
কবি ভেবেছিলেন, তার মা দুর্বল, দুঃখিনী, এবং তার ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু এখন তিনি বুঝতে পারছেন যে মায়ের শক্তি এবং গৌরবময়তা এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছেছে। কবি দেখছেন, মা এখন আর সেই ভাঙা ঘরে একলা পড়ে নেই। বরং আকাশের চূড়ায় তার দীপ্ত চরণ বিরাজ করছে। এই রূপে মা যেন আর দুর্বল নয়, বরং শক্তিশালী এবং গৌরবময়।
শেষ স্তবকে কবি মায়ের অভয়বাণীকে সামনে নিয়ে আসছেন: 'আজি দুখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসাও ধরণী,/ তোমার অভয় বাজে হৃদয়মাঝে হৃদয়হরণী!'। মায়ের এই অভয়বাণী কবির হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করছে এবং সমস্ত দুঃখকে তুচ্ছ করে দিয়ে সাহস জোগাচ্ছে। মায়ের এই অভয়বাণীই বাংলাদেশের মানুষকে শক্তি জোগায়, তাদের দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়।
রবীন্দ্রনাথের কাছে এই অভয়বাণী শুধু শব্দ নয়, এটি আত্মার গভীর থেকে উৎসারিত এক প্রেরণা। দুঃখময় রাতকে দূর করে, সুখের আলোয় ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতোই শক্তিশালী এই বাণী। বাংলাদেশের জনগণও যেন এই অভয়বাণী শুনে নতুন উদ্যমে সামনে এগিয়ে যায়।
এই গানের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ মূলত বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনা এবং শক্তিকে তুলে ধরেছেন। যে দেশ একসময় অবহেলিত এবং দুর্বল বলে মনে হতো, সেই দেশ এখন তার শক্তির পূর্ণ প্রকাশ ঘটিয়েছে। কবির এই আস্থা এবং ভালোবাসা যেন বাংলাদেশের মাটির সঙ্গে এক গভীর আত্মিক সম্পর্কের প্রতীক হয়ে উঠেছে। মাটির মধ্যে লুকিয়ে থাকা শক্তি, সম্ভাবনা, এবং সংগ্রামের স্পন্দন কবির প্রতিটি শব্দে প্রতিফলিত হয়েছে।
'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে' গানটি শুধু দেশপ্রেমের গান নয়, এটি একটি আধ্যাত্মিক সংযোগের বহিঃপ্রকাশ। দেশের মাটি এবং তার মানুষের প্রতি যে অঙ্গীকার, যে আত্মিক সম্পর্ক, তা এই গানটির প্রতিটি স্তবকে ছড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ এখানে শুধুমাত্র একটি ভূখণ্ড নয়, এটি এক জীবন্ত সত্তা, যার সঙ্গে তার জনগণের আত্মার সম্পর্ক এই গানটির প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি লাইনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার মাতৃভূমির প্রতি যে গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের চিন্তা ও চেতনায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দেশের প্রতি ভালোবাসা শুধু মাটির সঙ্গে সম্পর্ক নয়, এটি একটি আত্মিক অভিজ্ঞতা, যা আমাদের জীবন এবং পরিচয়ের অংশ।
'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে' গানটি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, যখন আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে সামনে রেখে প্রতিটি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করি। এই গানটি কেবল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি আমাদের চলমান সংগ্রাম, অর্জন, এবং ভবিষ্যতের প্রতি প্রতিজ্ঞাকে পুনরায় উজ্জীবিত করে। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে যে অমিত সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, সেই শক্তি এবং সম্ভাবনার প্রতি আমাদের আস্থা রাখতে এই গানটি আমাদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক।
বাংলা ট্রিবিউন থেকে