প্রতিটি বিপ্লবের ভেতরে বেড়ে ওঠে প্রতিবিপ্লবের বীজ। প্রতিবিপ্লবকে সামাল দিতে আরেকটা বিপ্লবের প্রয়োজন হয়…।
কিউবান প্রবাদ বেশিরভাগ বিপ্লবে লাখো বা কোটি মানুষের অংশগ্রহণ থাকে। কোটি মানুষের কাঁধে ভর করে ক্ষমতায় বসে হয়তো বিশ পঁচিশ জন। এই বিশ পঁচিশ জন শুরুর দিন থেকেই রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরের যে কারাগার, সেই কারাগারে বন্দি হয়ে যান। নেতা, মন্ত্রী, সামরিক বেসামরিক আমলা, নির্বাচিত সংসদ সদস্য, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, দলদাস শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার সবাই এই কারাগারের বেষ্টনী বা প্রাচীর তৈরি করেন। এটা ভেঙে যদি তারা বের হতে না পারেন কিংবা জনগণ যদি এই কারাগার ভাঙতে না পারেন তখন আরেকটা বিপ্লবের দরকার হয়। চারদিকে অনেকের দমবন্ধ হওয়া নীরবতা আর শ্রমিক অসন্তোষের কারণে মানুষের স্বপ্ন কি ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে? নাকি সময়ের আগেই মানুষ এসব ভাবছে? মূলত তিন কারণে এই ভাবনা আসছে-
এক. শেখ হাসিনার পলায়নের (৩৬ জুলাই বা পাঁচ আগস্ট ২০২৪) আগে চাল, ডাল, আটা, পেঁয়াজ, মাছ, মাংস বা ডিমের দাম কত ছিল? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেলে তারা যারপরনাই অসহায় বোধ করেন। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তারা রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হন। শেখ হাসিনার পতনের পর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কয় দফা বৃদ্ধি পেয়েছে?
শেখ হাসিনার আমলের কথিত ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না কেন ড. ইউনূসের সরকার? তার কত সময় দরকার?
দুই. এই ‘সময়’টা এখন সবচেয়ে রহস্যময় প্রশ্ন। কতদিন থাকবেন ড. ইউনূস? তার সরকারের কেউ এই প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান আঠারো মাসের একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, সেটা ড. ইউনূস একরকম উড়িয়ে দিয়েছেন। এই রহস্যময়তাকে ঘিরে শুরু হতে পারে বিপরীত রাজনীতি। কবে নির্বাচন? এটা না জানিয়ে সংস্কার কাজের ধীরগতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ বলেছেন– ‘ড. ইউনূসের টিম মেম্বাররা ঠিক নেই!’ ২০০৭-২০০৮ সালের মঈন উদ্দীন ফখরুদ্দীনের যে শাসনকাল তার স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল।
তিন. শেখ হাসিনার আমলে বিরোধীদের যেভাবে মামলা দেওয়া হতো ঠিক একইভাবে এখনও মামলা দেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ স্পষ্ট করে বলছেন, এসব কাজ একসময় শেখ হাসিনা বা তার দলকেই সহায়তা করবে। দুর্নীতি আর অর্থ লোপাট বা পাচার জনিত মামলারও তেমন অগ্রগতি নেই। গুম ও খুন হওয়া ব্যক্তিদের নিয়েও তেমন কিছু জানা যাচ্ছে না। কবে স্পষ্টভাবে কিছু জানা যাবে? এই ‘অজানাকালের’ নীরবতার যে অপেক্ষা, সেটাই এক সময় অসন্তোষের জন্ম দেয়!
চার. শেখ হাসিনা কিছু হলেই ‘বিএনপি, জামায়াত, রাজাকার’ ট্যাগ দিতেন। এই ‘ট্যাগ’ দেওয়ার মাত্রা বেড়েছে। এখনও বাজারে জিনিসপত্রের দাম নাকি বাড়ায় স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সিন্ডিকেট বা দোসররা! সিন্ডিকেট ভাঙতে না পেরে এক উপদেষ্টা যখন দিবস পরিবর্তন করে বসেন তখনও বলা হয় যারা দিবস বাতিলের প্রতিবাদ করছেন তারা পতিত স্বৈরাচারের দোসর।
অসন্তোষ বাড়লে কিংবা মানুষ বিপরীত ভাবনায় নিমজ্জিত হলে বিপ্লব বেহাত হয়ে যাচ্ছে বা প্রতিবিপ্লব শুরু হতে যাচ্ছে এমন ধারণা করা হয়। বিদেশি উদাহরণ টানার আগে দেশি উদাহরণ দিয়ে শুরু করি–
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ৪৬ ব্রিগেডের অধীন ফার্স্ট ফিল্ড আর্টিলারি ও সেকেন্ড বেঙ্গল (ট্যাংক রেজিমেন্ট নামে খ্যাত), যার সদস্য সংখ্যা পাঁচ শতাধিক ছিল না সেদিন। ফারুক-রশীদরা এটার নাম দিয়েছিল ‘আগস্ট বিপ্লব’। ১৯৭৫-এর পনের আগস্ট থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ছিল এদের স্থায়িত্ব। তিন নভেম্বর ১৯৭৫-এ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের কমান্ডে রক্তপাতহীন আরেকটি ক্যু হয়, যা চারদিন স্থায়ী ছিল এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তার বাসভবনে অন্তরীণ করে রাখা হয়। ফারুক রশীদ গং এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের অনেকেই এটাকে ‘প্রতিবিপ্লব’ বলতেন। বলতেন ভারতের নির্দেশনা বা ইঙ্গিতে এই ক্যু হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হতো, খালেদ মোশাররফের মা ও তার ভাই রাশেদ মোশাররফ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এক মিছিলে শামিল হয়েছিলেন। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে ভারতীয় সেনা কমান্ডারদের সঙ্গে মতদ্বৈধতা, স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীর পোশাক ভারত থেকে আনার ব্যাপারে খালেদ বাধা দিয়েছিলেন, যার কারণে ৭২-৭৩ সালে সেনাবাহিনীর পোশাক আনা হয়েছিল যুগোস্লাভিয়া থেকে! খালেদ মোশাররফের ব্যাপারে যে প্রচারণা ছিল তা গুজব হিসেবেই প্রতীয়মান হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের মধ্যে যে উচ্চাভিলাষ ছিল, ব্রি. খালেদ, কর্নেল তাহের বা মে. জে জিয়াউর রহমানদের মধ্যেও সেই একই উচ্চাভিলাষ ছিল। যাহোক, চারদিন পর পাল্টা ক্যু হয়, যার প্রভাবক ছিলেন কর্নেল তাহের এবং জিয়াউর রহমান অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্ত হন। বিচারপতি আবু সাদাত মো. সায়েম রাষ্ট্রপতি হলেও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন জিয়াউর রহমান। এই বিপ্লবের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সিপাহী জনতার বিপ্লব’। আগস্ট বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব, সিপাহী জনতার বিপ্লব- কোনটা আপনি সমর্থন করবেন সেটা আপনার ব্যাপার। এসব বিপ্লব প্রতিবিপ্লবে গুজবের পাখার সঙ্গে আরও একটি জিনিস উড়ন্ত ছিল। উড়ন্ত এই জিনিস হচ্ছে ভারত বিরোধিতা কিংবা সহমর্মিতা, যা এখনও উড়ন্ত আছে! প্রায় পঞ্চাশ বছরেও গুজব সংস্কৃতি এবং ভারত বিরোধিতা বা সহমর্মিতা থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হতে পারেনি!
এবার বিদেশি উদাহরণ। ‘আরব বসন্ত’ নামে সাধারণ মানুষের এক বিপ্লব সারা পৃথিবীর নজর কেড়েছিল। এই বিপ্লবের ফলাফল কী? ফলাফল জানতে চাওয়ার কারণ, বাংলাদেশে যে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে তার সঙ্গে আরব বসন্তের মিল ছিল সাধারণ মানুষের অসাধারণ অংশগ্রহণের দিক থেকে। মিসরের মুসলিম ব্রাদার হুড আর তিউনিসিয়ার এনহাদা স্বপ্নপূরণ করতে পারেনি। হতাশার সাগরে ডুবেছেন অনেকেই। মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের শত শত কর্মী নিহত হয়েছেন সেনাবাহিনীর হাতে।
ব্রাদারহুডের সঙ্গে বিপ্লবের জন্য রাস্তায় নামা আরেক সংগঠন আল নুরের এখন রক্তারক্তি সম্পর্ক, আল নুর কোনও না কোনোভাবে মিসরের সামরিক সরকারের সহমর্মী। নির্বাচনের পর তিউনিসিয়ার এনহাদার সঙ্গে বিপ্লবের সম্পর্ক ক্রমশ ফিকে হয়েছে। এই দুই দেশের বিপ্লব কোনও না কোনোভাবে বেহাত হয়েছে, যদিও এই দুই দেশের ‘আরব বসন্তের’র সঙ্গে অন্য কোনও দেশের সম্পর্ক বা হস্তক্ষেপ ছিল না। যেসব দেশে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ ছিল সেগুলো দোজখ হয়েছে। যেমন- ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়া। বিপ্লব শুধু স্বপ্নের দিকেই টানে না, কখনও কখনও দোজখ বানিয়ে ছাড়ে! এখন আপনি প্রশ্ন করবেন কিনা সেটা আপনার ব্যাপার। প্রশ্নটা হচ্ছে–বাংলাদেশের ছাত্র জনতার বিপ্লব বা অভ্যুত্থানে আমেরিকার কোনও ইঙ্গিত, সহমর্মিতা বা হস্তক্ষেপ ছিল কিনা?
বিপ্লব বা বিরোধী মত শক্তিশালী হলে কিংবা সব শ্রেণির মানুষের ভালোবাসা পেলে সেই বিপ্লব সফল নাও হতে পারে। পাকিস্তানে সফল হননি ইমরান খান। নেপাল বা শ্রীলংকাতেও নির্বাচনি ফলাফল মানুষের স্বপ্নে সমার্থক হবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।
মিয়ানমারের বিরোধীরা এখন গৃহযুদ্ধে ব্যস্ত, যদিও সামরিক সরকার ও বিদ্রোহী উভয় পক্ষকে সাহায্য করার অভিযোগ আছে চীনের বিরুদ্ধে। সিরিয়া, লিবিয়া বা ইরাকের সঙ্গে মিয়ানমারের অবস্থার কী খুব একটা পার্থক্য আছে?
এবার আবারও দেশে ফিরে আসি। মালদ্বীপ বা শ্রীলংকাতে ভারত ও চীনের সহযোগিতা বা হস্তক্ষেপের বিষয় নিয়ে রাজনীতি হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তান এ দেশে একরকম দূরদেশ হিসেবেই থেকে গেছে। একসময়ের পাকিস্তানি ফ্যান ও বর্তমানের ‘ককমুরগি’র সঙ্গেই যেন আছে পাকিস্তান। ১৯৯৩ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের গন্ধ মিলতো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জঙ্গিবাদের বিস্তারে, বোমা হামলা, জঙ্গিদের কাছে আর্জেস গ্রেনেড বিলানো, দশ ট্রাক অস্ত্র সরবরাহ কিংবা ভারতের কয়েকটি রাজ্যে ইনসার্জেন্সিতে মদত দেওয়ার কারণে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রেখে বাংলাদেশের মেরুদণ্ড শক্ত করার প্রয়াস কয়েকটি সরকারের সময় কেমন ছিল?
প্রায় পঞ্চাশ বছরের ভারতীয় ছায়া বা জুজুর ভয় থেকে যদি বের না হতে পারে বাংলাদেশ, তাহলে ‘৩৬ জুলাই বিপ্লবে’ কী কী প্রভাব পড়তে পারে?
এক. ড. ইউনূস সরকারের যেকোনও ব্যর্থতার দায় চাপানো হচ্ছে এখন পলাতক শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ ও ভারতের ওপর। মানুষের মনের কথা না শুনে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর মধ্যেই বাড়তে থাকে প্রতিবিপ্লবের বীজ। এরশাদ ও খালেদা জিয়ার দুই আমলে ভারতের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য কেমন ছিল? টাটা, বিরলার মতো ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে এ দেশের ব্যবসার সূত্রপাত কবে? তখন সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি কেমন ছিল? ঢাকার রাস্তায় হাজারো ভারতীয় সিএনজি নামানো হয়েছিল বিএনপির আমলে। তখন কার ইশারায় এসব হয়েছিল? রাজনীতির মঞ্চে ভারত বিরোধিতা আবার একইসঙ্গে ইলিশ বা ক্রিকেট রাজনীতির ফলাফল কী?
দুই. বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি গার্মেন্টস খাত। ৩৬ জুলাই বিপ্লবে কয়জন ছাত্র মারা গিয়েছেন? কত জন মারা গেছেন দিনমজুর, শ্রমিক কিংবা সাধারণ মানুষ? জুলাই থেকেই অনেক বস্ত্র শ্রমিক রাস্তায় আছেন। দুই মাস পার হলেও গার্মেন্ট খাত শান্ত হয়নি। তাদের আন্দোলন, দীর্ঘ যানজট, জনভোগান্তি দ্রব্যমূল্যের দামের মতো আদৌ কমেনি। এসব ঠিক না হলে কিংবা চলমান থাকলে যে সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে তার নাম প্রতিবিপ্লব। আওয়ামী লীগই এখন পলাতক। ভারত প্রতিবেশী দেশ। তবু তারা আছে ড. ইউনূসের নতুন সরকার আর তাদের অগণিত সমর্থকদের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ভেতর। আগস্ট সেপ্টেম্বর মাসে আওয়ামী লীগকে গালি দিতে পারলে যতটা আরাম লাগতো তার অনেকটাই কমে এসেছে এখন।
তিন. প্রতিটি বিপ্লবের একটা চরিত্র থাকে। রহস্যময়তা সেখানে সন্দেহ বাড়ায়। বলা হচ্ছে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান বা ৩৬ জুলাই বিপ্লব। বলা হচ্ছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা। সেখানে ইউনূস সাহেব ‘মাস্টারমাইন্ড’দের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, আরও হয়তো দেবেন। জামায়াতে ইসলামী বিপ্লবের সঙ্গে থাকা তার সমন্বয়কদের অর্থাৎ শিবিরের ছেলেদের পরিচয় উন্মোচন করেছেন। পুরনো অনেক কিছু রিসেট বাটন টিপে মুছে ফেলতে বলেছেন ড. ইউনূস নিজেই। এরপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে রাশ টেনে ধরতে না পারা সরকার সাতই মার্চের মতো দিবসকেও অগুরুত্বপূর্ণ বলেছেন।
এভাবেই হয়তো উন্মোচন হবে সবকিছুর। পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত সত্যকে পায়ে ঠেলে বড় কিছু করা যায় না। আশাবাদ তবু- বিপ্লব ও মানুষের স্বপ্ন সত্য হোক।
লেখক: রম্যলেখক
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন