সরকারের কাছে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র আছে নাকি নেই? অন্তর্বর্তী সরকার কি সাংবিধানিকভাবে বৈধ, নাকি না? গণআন্দোলনের পর দেশে কি সংবিধান কার্যকর আছে নাকি নেই?
শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ও রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবির বিতর্ক শেষ পর্যন্ত বর্তমান সংবিধানের কার্যকারিতা ও সরকারের বৈধতার প্রশ্নে গড়িয়েছে। এটি শুধু সাম্প্রতিক ঘটনাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাংলাদেশের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার গভীর সংকটকে স্পষ্ট করে তুলছে। এসব প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।
ঘটনার পরম্পরা: ৫ আগস্ট রাতে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন তিন বাহিনীর প্রধানদের সামনে বলেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং তিনি তা গ্রহণ করেছেন। তবে কিছু দিন পর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তিনি শুনেছেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু তার কাছে কোনও লিখিত প্রমাণ বা নথিপত্র নেই। উল্লেখ্য, ফরহাদ মজহারও শুরু থেকেই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র দেখতে চাইছিলেন। কিন্তু এখনও সেটির কোনও কপি কোথাও দেখা যায়নি।
এরপর উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, এই পদত্যাগপত্রের রেফারেন্স দিয়েই সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল, যা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে সহায়ক ছিল। তিনি রাষ্ট্রপতির পরবর্তী মন্তব্যকে মিথ্যা বলে দাবি করেন এবং বলেন, এটি তার শপথ ভঙ্গের শামিল। অন্যদিকে, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ভূঁইয়া বলেন, শেখ হাসিনা মৌখিকভাবে পদত্যাগ করেছেন এবং তার লিখিত পদত্যাগের সময় ছিল না। অর্থাৎ লিখিত কোনও পদত্যাগপত্র নেই। এই মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আসিফ, এটা সত্য নয়। সবসময়ই প্রেসিডেন্টের কাছে লিখিত পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার কথা ছিল। এখন কেন মিথ্যা প্রচার করছেন?’
এই পদত্যাগপত্র বিতর্কের মূল প্রশ্ন হলো—একটি সরকার পদত্যাগ করলে সেই প্রক্রিয়াটিকে সংবিধান অনুযায়ী কীভাবে পরিচালিত করা উচিত?
আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘একটি গণঅভ্যুত্থান সফল হলে সেটাই তার বৈধতা সৃষ্টি করে। সেই সময় সংবিধান কার্যত অকেজো হয়ে যায়।‘ তবে তিনি আরও বলেন, ‘পরবর্তী নির্বাচিত সংসদে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আদেশকে বৈধতা দিতে হবে। শুধু রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ নয়, সব কাজকেও বৈধতা দিতে হবে।‘
বিচারপতি মতিনের বক্তব্যের প্রথম ও পরবর্তী অংশে অসঙ্গতি রয়েছে। গণঅভ্যুত্থান সফল হলে সরকার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৈধতা পেতো, তাহলে কেন তাকে পরে আবার বৈধতা দিতে হবে? এটি প্রমাণ করে যে বর্তমান পরিস্থিতি আসলে সাংবিধানিকভাবে বৈধ নয় এবং সরকারের পদক্ষেপগুলোর সাংবিধানিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
বিপ্লব-পরবর্তী সরকারের জন্য আগের সরকারের সংশোধন করা সংবিধান মেনে চলা সবসময় সম্ভব হয় না। এই সরকার যদি সত্যিই সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হতো, তাহলে বর্তমান সংবিধানের ৪(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি” বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় প্রদর্শিত হতো।
এটা ঠিক যে “বাহাত্তরের সংবিধান” এখন তেমন আর অবশিষ্ট নেই। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনরা সংবিধানের কাটাছেঁড়া করে এটিকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছে। সেসব সংশোধনীর অধিকাংশই হয়েছিল ক্ষমতা দখলকে পোক্ত করতে বা অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় থাকাকে পরবর্তীতে বৈধ করতে। যে যখন ক্ষমতায় থেকেছে, তার সুবিধামতো সংবিধানের ব্যাখ্যা দিয়েছে এবং যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকু ব্যবহার করেছে; বাকিটা উপেক্ষা করেছে। বর্তমান অবস্থাতেও তাই চলছে।
তবে সংবিধান মানা হচ্ছে না বলেই এর অবহেলা করা যায় না। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা না হলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থায় অরাজকতা দেখা দিতে পারে। হাসনাতের কথামতো বর্তমান সংবিধান বাতিল করলে, সমস্ত আইন, কাঠামো, ও চেইন অব কমান্ড অবৈধ হয়ে যাবে। আমরা কিছু দিন আগেই দেখেছি, মাত্র কয়েক মাস পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ায় দেশে মব জাস্টিস আর খুন-ডাকাতির অরাজকতা কেমন করে তৈরি হয়েছিল। যদি এখন একাত্তর পরবর্তী সময়ের মতো সব কিছু নতুন করে তৈরি করার চেষ্টা করা হয়, সেটা ম্যানেজ করা সম্ভব হবে তো? তখন কে কাকে মানবে?
সংবিধান স্থগিত করে একমাত্র সামরিক প্রশাসকই ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল। আর্মির নিজস্ব চেইন অব কমান্ড আর ফোর্সের শক্তি নিয়ে যেভাবে সংবিধান স্থগিত করেও দেশ চালানো যায়, সিভিল সরকারের পক্ষে সেটা সহজ হয় না।
আরেকটু সহজ করে বললে—যে উপদেষ্টা বা ছাত্রনেতারা শেখ মুজিবের বিরোধিতা করছেন, মুজিবের ভাস্কর্য ভাঙছেন, তারাও কিন্তু তাদের পকেটে বা মানিব্যাগে এখনও মুজিবের ছবি নিয়েই ঘুরছেন। আমি নিশ্চিত সারজিস-হাসনাতদেরও একই কাজ করতে হচ্ছে। হ্যাঁ, আমি টাকার নোটের ছবির কথা বলছি। একটা ফ্যাসিস্ট সরকার সেই নোট ডিজাইন ও ছাপিয়েছে বলে তো কেউ সেই নোট ধ্বংস করছে না, তাই না? পরিবর্তন সময় নেয়। রাজনৈতিক বক্তৃতা দেওয়া এক জিনিস, আর বাস্তবতা বোঝা আরেক জিনিস।
যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন বা সংশোধিত সংবিধান তৈরি ও বৈধ করা না হচ্ছে, ততক্ষণ এই সরকার পুরোপুরি সাংবিধানিক না হলেও, বর্তমান সংবিধানের আওতাতেই ড. ইউনূস সরকার পরিচালনার চেষ্টা করছেন।
নতুন নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে বৈধতা নেওয়ার আগ পর্যন্ত যতটা সম্ভব চেইন অব কমান্ড বজায় রেখে লোকজনকে ম্যানেজ করা যায় আর কি! সেই বৈধতার যে গল্প বা ন্যারেটিভ তারা হাসিনার পদত্যাগপত্রকে কেন্দ্র করে দাঁড় করিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতির সাম্প্রতিক বক্তব্যে সেটিতে ধাক্কা লেগেছে। এ কারণেই এত প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
১৯৯০ সালে এরশাদের পদত্যাগের পরও রাজনৈতিক দলগুলো শাহাবুদ্দিন আহমেদকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করে এবং নির্বাচনের পর তিনি ক্ষমতা খালেদা জিয়ার হাতে তুলে দিয়ে আবার প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ফিরে যান। খালেদা জিয়ার সরকার ক্ষমতায় এসে সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে সেই শাহাবুদ্দিনের অন্তর্বর্তী সরকারকে বৈধতা দেয়।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার আসার পর আবারও শাহাবুদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি করা হয়, যদিও পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে পরাজয়ের পর শেখ হাসিনা তাকে এমনকি ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেও উল্লেখ করেন। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি পদে শুধু অনুগত প্রার্থী বেছে নিতে শুরু করে। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত হন।
আইরনিক্যালি, সাহাবুদ্দিনকেও মনে হচ্ছে সেই একই ‘বিশ্বাসঘাতক’ তকমা নিয়ে যেতে হবে।
সাবেক সরকারের আনুগত্যই যার একমাত্র যোগ্যতা ছিল, তার এতদিন টিকে থাকার কারণও সেই সাংবিধানিক ন্যারেটিভ। জনতার চোখে অনুপস্থিত এক পদত্যাগপত্রকে কেন্দ্র করেই কি এই সাংবিধানিক বৈধতার গল্প গড়ে উঠেছে? এ জন্যই কি ফরহাদ মজহার বারবার সেই পদত্যাগপত্রটি দেখতে চাইছিলেন?
যাহোক, রাষ্ট্রপতি নিজেই যখন সেই ন্যারেটিভে ধাক্কা দিলেন, তখন এই সরকারের জন্য সংবিধানের দোহাই দিয়ে তাকে রেখে কী লাভ? যদিও রাষ্ট্রপতিকে অকার্যকর সংবিধানের শপথ ভঙ্গের দোহাই দিয়ে পদত্যাগ করতে বলা সংবিধানবিরোধী হতে পারে, তবু এখন আর কোনও কিছুই নিয়ম মেনে চলছে না।
এই সাংবিধানিক বৈধতার আড়াল ইতোমধ্যে খুলে পড়ছে। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ এখন আর সংবিধানের বিষয় নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক ইস্যু। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, যেন পরবর্তী নির্বাচনে এই দলগুলো ক্ষমতায় এসে সংসদে সরকারকে বৈধতা দিতে পারে। শুধু এটাকে সাংবিধানিক বিতর্কে পরিণত করলে, অহেতুক সরকারের বৈধতার প্রশ্নই শুধু সামনে চলে আসবে।
লেখক: জননীতি বিশ্লেষক।