গণঅভ্যুত্থান

সংস্কারের নামে ‘রদবদল’ করে রাষ্ট্র সংস্কার সম্ভব নয়

ইফতেখারুল ইসলাম
  ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১৩:৫২

গণঅভ্যুত্থানের পরপরই সংবিধান ও রাষ্ট্রপতি নিয়ে বহুধারার বিতর্ক দেখা দেয়। বিশ্লেষকরা সংবিধান নিয়ে যতটা শক্ত অবস্থান নিয়েছেন, ততটা রাষ্ট্রপতির বেলায় দেখা যায়নি। এর কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার চাদরে রাষ্ট্রপতি প্রায় অদৃশ্য হয়ে পড়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের কতিপয় আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যাবলিতে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা গৌণ করে দেখার সুযোগ নেই। যেমন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতির শপথ গ্রহণ কিংবা পদত্যাগপত্র প্রদান। 
রাষ্ট্রপতির এই ভূমিকা রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং সাংবিধানিক প্রশ্নে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। এ কারণে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতিতে তাঁর অপসারণের বিষয়টি হেলাফেলা করার সুযোগ ছিল না। চলমান রাজনৈতিক পটভূমিতে, বিশেষত রাষ্ট্র সংস্কার প্রশ্নে সংবিধান পুনর্লিখনের বিষয়ও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কেননা, রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিকভাবে পদে বহাল থাকেন বিধায় প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু দুঃখজনক, অন্তর্বর্তী সরকার উভয় বিপদে পা দিয়েছে। তারা রাষ্ট্রপতি নিয়ে প্রথম থেকে যেমন উদাসীনতা দেখিয়েছে, একইভাবে সংবিধান বিতর্কে তাদের অবস্থান বিপদের পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছে। এতে গণঅভ্যুত্থান আসলে কত আনা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। 
এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান-বিষয়ক একটি কমিশন গঠন করেছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, আগামী ৯০ দিনের মধ্যে তাদের প্রস্তাব সরকারের কাছে পেশ করতে হবে। ২০ অক্টোবর এক সেমিনারে দেশের আইনবিশারদ, গবেষক, লেখক ও সাংবাদিকরা সংবিধান পুনর্লিখনের পরিবর্তে সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার রাষ্ট্র সংস্কারের যে দাবি, সেখানে ‘সংস্কার’ মানে আদৌ কি পুরোনো ব্যবস্থার রদবদল, নাকি পুরোনো রাষ্ট্র কাঠামোর মূলোৎপাটন? প্রকৃত অর্থে আন্দোলনের প্রধান শক্তি শিক্ষার্থী ও জনতা সংস্কার বলতে গত ৫০ বছরের রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ ও রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবি তুলেছেন। এ কারণে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীদের একাংশ বারবার রাষ্ট্রপতির অপসারণ ও সংবিধান পুনর্লিখনের পক্ষে মত দিয়েছেন, যদিও ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার এ দাবির গভীরতা বুঝতে পেরেছে বলে মনে হয়নি। 
গত আড়াই মাসে সংবিধান প্রশ্নে পত্রপত্রিকায় বহু লেখা প্রকাশ পেয়েছে। টেলিভিশন ও সামাজিক মাধ্যমে অনেক তর্কও হাজির ছিল। এতে বিদ্যমান সংবিধানের অনুচ্ছেদসহ সাংবিধানিক কাঠামো নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি সংবিধান কেবল কি একটি রাষ্ট্রনির্দেশিকা, নাকি স্রেফ রাজনৈতিক চুক্তি হিসেবে জনআকাঙ্ক্ষা ধারণ করে– সেই তর্কও বাদ যায়নি। 
এটা একেবারেই আশ্চর্যজনক নয়; নীতিনির্ধারকদের বড় একটি অংশ সংবিধান সংস্কারের পক্ষে মত দেবেন। তাদের মতে, সংবিধান পুনর্লিখন বাস্তবসম্মত নয়। কেউ কেউ অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে সেই পরিমাণ সময়ও নেই বলে মনে করেন। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা, আইনি জটিলতা ও রাজনৈতিক শূন্যতার কথা বলে তারা যেমন রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে নীরব থেকেছেন, একইভাবে সংবিধান পুনর্লিখনের বিপক্ষেও মত দিয়েছেন। প্রধানত রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি জানিয়ে যে আন্দোলন সরকার উৎখাতে সফল হয়েছে, সেখানে কেবল ‘রদবদল’ করে রাষ্ট্র সংস্কার কতটুকু অর্জিত হবে– তা নিয়ে গুরুতর সন্দেহ তৈরি হয়। ‘রদবদল’ ও ‘মূলোৎপাটন’– দুটি ধারণার মধ্যে রয়েছে ব্যাপক ফারাক। 
সংবিধান-বিষয়ক বিতর্কের বাইরে যে বিষয়ে আলোচনা হয়নি, সেটি হলো শ্রেণিস্বার্থ। ভূরাজনীতি এবং গত পাঁচ দশকের রাজনীতি পর্যালোচনা করে পুরোনো রাজনৈতিক বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে না পারা ব্যক্তিরা কোন কারণে সংবিধান বাতিল চাইবেন? এই শ্রেণিস্বার্থের সঙ্গেই যুক্ত সাংবিধানিক পদ-পদবি এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে যেখানে শিক্ষার্থী ও জনতা প্রাণ দিতে পেরেছে, সেখানে নতুন করে সংবিধান লেখা একটি জাতির পক্ষে কেন বাস্তবসম্মত হবে না? 
গত পাঁচ দশকে সংবিধানকে কেন্দ্র করে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি গড়ে উঠেছে। তাদের মনস্তত্ত্ব এই সাংবিধানিক কাঠামোর সঙ্গেই যুক্ত। বিদ্যমান সংবিধান দেশে ন্যায়বিচার তথা ইনসাফ কায়েমের বদলে শ্রেণিস্বার্থের পক্ষে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলেই সংবিধান পুনর্লিখনের দরকার পড়েছে। স্বার্থের এই মামলার মীমাংসা না করলে অভ্যুত্থানের ফল পাওয়া কঠিন। সারাদেশে যে গুম, খুন, নিপীড়ন ও হয়রানিমূলক ব্যবস্থা ও বলয় তৈরি হয়েছে, তাও সংবিধানের সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনতার পর থেকে সংশোধনের মধ্য দিয়ে সংবিধানকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে। 
গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট তথা প্রধান দাবি– পুরোনো রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলোৎপাটন– কেবল সংস্কারের নামে প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক ‘রদবদল’ করে কার্যকর ফল পাওয়া সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে বিশেষত রাষ্ট্রপতি ও সংবিধান বিতর্কে নীতিনির্ধারকরা যে ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, তাতে গণঅভ্যুত্থানের প্রধান দাবি পেছনে পড়ে গেছে। স্বাধীনতার পর থেকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক বলয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র সংস্কার ও পুরোনো ব্যবস্থার মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে ছাত্রসমাজ ও তরুণরা প্রাণ দিয়েছেন। সংবিধান পুনর্লিখন না করে পুরোনো ব্যবস্থার মূলোৎপাটন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে পুরোনো শ্রেণিস্বার্থ ভেঙে পড়বে এবং ইনসাফের ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হবে– এটাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট বা দাবি। 
ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল 
[email protected]