বাংলাদেশ থিয়েটার অব অ্যারিজোনা (বিটিএ) এবং শিকড় বাংলা স্কুলের উদ্যোগে ১৬ নভেম্বর অ্যারিজোনার ফিনিক্স শহরের অদূরে চ্যান্ডলারের হ্যামিল্টন হাই স্কুল মিলনায়তনে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণ আন্দোলন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের কল্যাণে একটি নাট্যসন্ধ্যা আয়োজিত হয়। অনুষ্ঠানে দুইটি নাটক মঞ্চায়িত হয়। প্রথমটি শিকড় বাংলা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত "রাজা ও রাজদ্রোহী" এবং দ্বিতীয়টি শুভঙ্কর চক্রবর্তী রচিত নাটক "মড়া" অবলম্বনে মুস্তফা রিয়াদের রূপান্তরে নাটক "কানার হাট-বাজার"। নাটক দুটোর নির্দেশনা দিয়েছেন শেখ শামস ভাস্কর এবং আরিফ মাহমুদ।
অ্যারিজোনাতে বাংলাদেশ থিয়েটার অব অ্যারিজোনা (বিটিএ) ১৯৯৯ সাল থেকে অ্যারিজোনার বাঙ্গালি অভিবাসী সমাজে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি প্রসারে বিভিন্ন ভাবে বড় ভূমিকা রেখে আসছে। যেমন - নাটক মঞ্চায়ন, বাংলা সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ, বাংলা চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, মূলধারারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলা এবং বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা, বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবস আয়োজন। তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো অ্যারিজোনার বাঙ্গালি পরিবারের শিশু সন্তান-সন্ততি ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে প্রাথমিকভাবে দীক্ষিত করবার স্বপ্ন নিয়ে ২০০৩ সালে শিকড় বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা। এদেশে জন্ম নেয়া আমাদের বাচ্চারা তাদের আদি এবং সাম্প্রতিক পূর্বপুরুষদের জানতে পারবে, তাদের বাবা-মা'র জন্মভূমি- বাংলাদেশকে নিয়ে গর্ব করতে শিখবে, বাংলাদেশের দুর্দিনে, দুর্যোগে ব্যথিত হয়ে চিন্তা করবে কিভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া যায়- এসব উদ্দেশ্য নিয়েই শুরু হয়েছিল বাংলা স্কুলটির পথযাত্রা। আর বিটিএ সুনিপুণ দক্ষতায় শিকড় বাংলা স্কুলটি পরিচালনা করে আসছে গত ২১ বছর যাবত । বিটিএ এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হলো - এদেশে জন্ম নেয়া আমাদের পরবর্তী প্রজন্মদের শিশু-কিশোরদের নিয়ে পূর্ণ-দৈর্ঘ বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করা, যেটি প্রবাসে একটি বিরল দৃষ্টান্ত। মূলত ইংরেজী ভাষায় অভ্যস্ত শিশু-কিশোররা যখন কখনো আটপৌরে, আবার কখনো বা পোশাকি বাংলা ভাষায় সংলাপ দিয়ে এসব নাটকে অনায়াসে অভিনয় করে যায় তখন উপস্থিত দর্শকমন্ডলী যারপরনাই বিস্মিত ও চমৎকৃত হয়ে পড়ে। আর এ কাজটি বাংলা স্কুল এবং বিটিএ নিরলস করে যাচ্ছে বছরের পর বছর, ব্যাচের পর ব্যাচ স্কুল ছাত্রদের নিয়ে।
পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিটিএ এর রজত জয়ন্তী উদযাপনে দুইদিনব্যাপী নাট্যৎসব আয়োজনের পরিকল্পনা থাকলেও - বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণ আন্দোলন এবং তৎপরবর্তী বন্যার কারণে বিটিএ অনুষ্ঠানটি একটি একদিনের নাট্যসন্ধ্যায় রূপান্তর করে এবং এই অনুষ্ঠান থেকে অর্জিত সমুদয় অর্থ বাংলাদেশের গণ আন্দোলন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের কল্যাণে ব্যায় হবে ঘোষণা দেয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে শিকড়ের শিক্ষক, অভিভাবক এবং বিটিএ এর সদস্যদের সমবেত কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর রিপন সাহার প্রস্তুতে পরিবেশিত হয় এই অনুষ্ঠানের চ্যারিটি উপলক্ষ্য পরিবেশনে একটি স্লাইড শো যেখানে "মুক্তির মন্দির সোপানতলে" গানের সাথে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণ অভ্যুত্থান, এবং সেই অভ্যুত্থানে শহীদ, আহত এবং শেষে বন্যার চিত্র ফুটে ওঠে। অ্যারিজোনা ষ্টেট ইউনিভার্সিটির পি,এইচ,ডি ছাত্র এবং বাংলাদেশের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আসাদ আজিম, যিনি গত জুলাই মাসের অস্থির সময়ে বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন, তিনি গণ আন্দোলনে আহতদের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন এবং আজকের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সবাইকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর আহ্বান জানান।
এরপর বিটিএ এর বার্ষিক সাহিত্য পত্রিকা "সিঁড়ি" অষ্টম সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফিনিক্সের সভাপতি জনাব হামিদ কাজী। অনিরুদ্ধ বাশারের নির্বাহী সম্পাদনায় এবারের সিঁড়িতে অন্যান্য সম্পাদকরা শিলেন শেখ শামস ভাস্কর, রচনা সেন মৈত্র এবং ফাহিম হুসেইন। সহযোগিতায় ছিলেন - আসাদ আজিম, হাসানুর খান এবং সন্দীপন বিশ্বাস। এবারের সিঁড়িতে স্থান পেয়েছে বেশ কিছু সুন্দর বাংলা লেখা, কবিতা, সাক্ষাৎকার, আঁকা ছবি, শিকড়ের ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা। পত্রিকাটিতে প্রকাশিত একটি বিশেষ নিবন্ধে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণ আন্দোলনে অংশ নেয়া কিছু ছাত্র ও ছাত্রী সমন্বয়কেরা তাদের প্রত্যয়, অভিজ্ঞতা ও স্বপ্ন নিয়ে লিখেছেন। এবারের পত্রিকাটির অনলাইন ভার্সন পাওয়া যাবে এখানেঃ https://btaweb.org/shiri-publication/
অনুষ্ঠানের এই পর্যায়ে শুরু হয় শিকড়ের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে বিটিএ এর ৪৪তম পরিবেশনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত এবং শেখ শামস ভাস্কর এবং আরিফ মাহমুদ নির্দেশিত নাটক "রাজা ও রাজদ্রোহী"। এর আগে বিটিএ শিশু-কিশোরদের নিয়ে আরো ২৩টি পরিবেশনা করেছিল - যার মধ্যে পূর্ণ দৈর্ঘ মঞ্চ নাটকঃ "হীরক রাজার দেশে", "রাজার নতুন জামা", "তোতা কাহিনী", "হবু চন্দ্র রাজার দেশে", "ভূতের জাদু" উল্লেখযোগ্য। প্রায় একশ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত "রাজা ও রাজদ্রহী" মঞ্চনাটকটি এখনো বিস্ময়করভাবে কতোটা প্রাসঙ্গিক। রাজার অন্যায়, অহেতুক কোন কারণ ছাড়া যুদ্ধ বাঁধানো, শত্রুকে নিপীড়নের মাধ্যমে স্বৈরাচার হয়ে ওঠা এবং প্রজাদের বিদ্রোহের মাঝে রাজার পতন - সমসাময়িক বিবেচনায় এটি ছিল বিটিএ এর খুবই যুক্তিযুক্ত সময়োপযোগী নাটক নির্বাচন। নাটকটিতে অভিনয় করেছে শিকড় বাংলা স্কুলের ছাব্বিশ জন ক্ষুদে ছাত্র-ছাত্রী যাদের বয়স চার থেকে তেরো। নাটকে সংযুক্ত হয়েছে সাতটি রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং রচনা সেন মৈত্র এবং ফাবিহা নওমি হুসেইন এর পরিচালনায় ছাত্র-ছাত্রীরা সেগুলোতে নিজেরাই কন্ঠ দিয়েছে এবং অনিরুদ্ধ বাশারের রেকর্ডিং এ সেগুলো নাটকে বাজানো হয়েছে বিভিন্ন দৃশ্যের পর এবং সেই গানের সাথে ছাত্র-ছাত্রীরা শ্রুতি দাসের পরিচালনা নৃত্য পরিবেশন করেছে। প্রতিটি দৃশ্যের পর ঘটনার সাথে মিল রেখে খুবই প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্রসঙ্গীত নির্বাচন করা হয়েছে। নাটকের পোশাক ছিল অভাবনীয়। চাঁদ সুলতানা লিপির পরিকল্পনায় নাটকের প্রতিটি চরিত্র হয়ে ঊঠেছিল প্রাণবন্ত। আর বিভিন্ন দৃশ্যের পর খুব দ্রুত এতোগুলো চরিত্রের পোশাক পরিবর্তন ছিল অকল্পনীয়। আরিফ মাহমুদের আবহ সঙ্গীত পরিকল্পনা ছিল দারুণ। তার মঞ্ছ সজ্জা এবং ব্যাকগ্রাউন্ড প্রজেকশন করেছে শামীম চৌধুরী জয়। স্বতঃস্ফূর্ত করতালির মাধ্যমে নাটক শেষ হয়, তারপর সমস্ত কলাকুশলীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন নাটকটির একজন নির্দেশক শেখ শামস ভাস্কর।
নাটকটি সফল মঞ্চায়ন সম্ভব হয়েছে দীর্ঘ ছয় মাসব্যাপী ছাত্র-ছাত্রীদের মহড়া এবং অভিভাবকদের অভাবনীয় সহযোগিতায়। শিকড়ের যেসকল ছাত্র-ছাত্রীরা নাটকটিতে অংশ নিয়েছে তারা হলেনঃ নয়লি, জাইম, আয়ান, জীনিন, ঈশান, মাঈশা, মাঈরীন, নাবা, মানহা, বর্নাদিত্য, আনবী, রাফসান, ইউকি, মুনিফ, রিয়াসাত, জিশান, আনাস, নাহাদ, ওনুর, নাভান, আয়রা, বুরহান, নাফি, অর্নাদিত্য, অলিভিয়া, অহনা। মঞ্চ ব্যবস্থাপনায় সাবরিনা এবং মেজবা, নার্গিস, নাজহি, আবীর, বিন্দু, নূরী, রিনা সহ আরো অনেকে। নৃত্য অনুশীলন সহযোগিতায় পিঙ্কী এবং পোশাক পরিকল্পনা সহযোগীরা ছিলেন - নার্গিস, সাবরিনা, বিন্দু, নূরী, তানিয়া, মঞ্চ পরিবর্তনে শিকড়ের অভিভাবকগণ। ছয় মাসব্যাপী মহড়া ব্যবস্থাপনায় - রেজাউল, বিন্দু, মাহাবুব এবং অন্যান্যদের সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য।
প্রায় ৪৫ মিনিট রাতের খাবারের বিরিতির সময় দেখানো হয় ছবিতে বিটিএ এর গত পঁচিশ বছরের যাত্রাপথ এটি তৈরী করেছেন - মনজুর এবং ভাস্কর। এবং পরে বাশারের তৈরী স্লাইডে পৃষ্ঠপোষকদের পরিচিতি।
পর শুরু হয় বিটিএ এর বড়দের নাটক ৪৫তম পরিবেশনা "কানার হাট-বাজার"। এর আগে - বিটিএ গত প্রায় ২৬ বছরে অসংখ্য মঞ্চনাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ বিটিএ এর নিজস্ব "আম্বিয়ার বিয়া", "নিস্তব্ধ আর্তনাদ", "একাত্তর বারবার", "মুক্ত করো ভয়", মাসুম আজিজ রচিত "বৃত্ত", মলিয়েরের নাটক অবলম্বনে "কেরামতের মসিবত", "ভদ্দরনোক", হুমায়ূন আহমেদ রচিত "১৯৭১", "এসো নবধারা জলে", মনোজ মিত্রের নাটক অবলম্বনে "চলো যাই হাওয়াই", রবি ঘোষের নাটক অবলম্বনে "হোম মিনিস্টার একদিন" সহ আরো অনেক। এবারের মঞ্চ নাটক "কানার হাট-বাজার" নাটকটি শুভঙ্কর চক্রবর্তীর "মড়া" নাটক অবলম্বনে মুস্তফা রিয়াদ কর্তৃক রূপান্তরিত। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন আরিফ মাহমুদ এবং শেখ শামস ভাস্কর। নাটকটিতে ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে দ্বারা মানুষের মাঝে যে বিভাজন এবং তা থেকে সমাজে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ব্যাঘাত ঘতে তা ফুটে উঠেছে। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে এই নাটকের নির্বাচনও খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল। অভিনেতা অভিনেত্রীদের সাবলিল অভিনয় দর্শকদের মন কেড়ে নিয়েছে। নাটকটিতে স্থান পেয়েছে তিনটি লালনের গান। অভিনয় করেছেনঃ আতিকুর রহমান, রেজাউল করিম নয়ন, আদিয়াত ওয়াশিক রহমান, ফাহিম হুসেইন, মোহাম্মদ হাসান জান, মামুন রহমান, মুস্তাফা রিয়াদ, শায়লা নাহার মুক্তি, নাহিদা ইসলাম সিলভি, আহমেদ জেবা তানহা, আসাদ আজিম, কলিমুর রহমান আফতাব, অনিরুদ্ধ বাশার, নাজিম উদ্দীন, নিয়ত রহমান, আবু ওসমান, রেজাউল করিম রেজা, ফাবিহা নওমি হুসেইন, সন্দীপন বিশ্বাস। অপূর্ব সুন্দর মঞ্চ সাজিয়েছেন শামীম চৌধুরী জয়। পোশাক পরিকল্পনায় ছিলেন চাঁদ সুলতানা লিপি, তাকে সহযোগিতা করেছেন - নার্গিস এবং নূরী। আবহ শব্দ পরিকল্পনা এবং শব্দ ও আলোক নিয়ন্ত্রনে ছিলেন আরিফ মাহমুদ।
অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছিলেন ফারহানা হুসেইন দীপা, আশফাক আনসারী এবং শিকড়ের বর্তমান ছাত্রী মেইসাম এবং প্রাক্তন ছাত্র রাভিদ। ভিডিও রেকর্ডিং করেন আশরাফ রুমি। অন্যান্য স্বচ্ছাসেবীদের মধ্যে ছিলেন সেলিনা খানম, নাসিম আমানতুল্লাহ, শামীম দেওয়ান, জসীম উদ্দীন, সেলিনা ইমাম, ইসমত জাহান সুমনা, নাজনীন আফরোজ নূপুর, রওশন রহিম ইতি, ইফফাত শারমিন, মুস্তফা রিয়াদ, আশফাক আনসারী, এবং অন্যান্যরা। অনুষ্ঠানের শুরুতে এবং দুটো নাটকের মাঝে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের সমসাময়িক প্রেক্ষাপট বড় স্ক্রীনে স্লাইড শোতে দেখানো হয়েছিল।
দ্বিতীয় নাটকটির যবনিকাপাতের পর শিকড় বাংলা স্কুল আর বাংলাদেশ থিয়েটার অফ অ্যারিজোনার পক্ষ থেকে উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করলেন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধার জনাব শেখ শামস ভাস্কর। সব মিলিয়ে সেদিনের সন্ধ্যাটি একটি বড়ই মনোজ্ঞ হয়েছিল, আর সাথে ছিল দুঃস্থ, অসহায়, পীড়িত জনতার জন্য সামান্য কিছু করবার আত্মতৃপ্তি। বিদায়কালে উপস্থিত সবাই আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা জানালেন বাংলাদেশের জন্য, এ শহরের অসাধারণ দুটো প্রতিষ্ঠানের জন্য।