এত ভাঙন কেন কমিউনিটিতে 

 যাদের অবসরে যাওয়ার কথা, তারাই নেতৃত্ব ধরে রাখতে চান!
ডেস্ক রিপোর্ট
  ২৯ মে ২০২৫, ০০:২৪

উত্তর আমেরিকায় ফোবানা চারটি, নিউইয়র্কে প্রেসক্লাব আছে পাঁচটি। আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর বেশিরভাগই খণ্ড-বিখণ্ড। প্রবাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোতেও পাল্টাপাল্টি নেতৃত্ব আছে। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এই ভাঙনের বাইরে নয়। ভেঙেছে প্রবাসের সবচেয়ে বড় সংগঠন, সিলেটবাসীর ঐক্যের প্রতীক জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন। ভাঙনের  খেলা খেলতে এখনো টিকে আছে আমব্রেলা সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি। সবশেষ ভাঙলো নিউইয়র্ক বইমেলা ২০২৫। 
কেন এত ভাঙন বাংলাদেশি কমিউনিটিতে? কাদের জন্য ভাঙছে এই কমিউনিটি? উত্তর সবার জানা। যারা ভাঙছেন তারাও জানেন, কমিউনিটির এই ভাঙনে সবাই তারদেরই দায়ী করেন। কিন্তু লাজলজ্জার মাথা খেয়ে এ কাজটি তারা করেই চলেছেন। যাদের অবসর নেওয়ার বয়স, তারাই নেতৃত্ব ধরে রাখতে চান আমৃত্যু। 
ফোবানা ভেঙেছিল প্রায় তিন দশক আগে। ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর নেতৃত্বের কোন্দলে ১৯৯৪ সালে প্রথমবারের মতো বিভক্ত হয়ে যায় ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকা (ফোবানা)। গত ৩১ বছর ধরে বিভক্ত ফোবানার ব্যানারে পৃথক অনুষ্ঠান হচ্ছে। উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের স্বদেশ-সংস্কৃতির আলোকে ঐক্যবদ্ধ রেখে নতুন প্রজন্মে বাঙালিত্ব প্রবাহিত করা এবং মূলধারায় জোরালোভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার সংকল্পে যে আলোকিত ফোবানার যাত্রা শুরু হয়েছিল, অনৈক্যের কারণে তা এখন অন্ধকারে নিমজ্জিত। 
ফোবানার ভাঙন ঠেকাতে এবং ঐক্যবদ্ধ ফোবানা সম্মেলন করার প্রয়াসে অনেকেই বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু কারো চেষ্টাই কাজে আসেনি। আর এখন যতগুলো ফোবানা হয়েছে তাতে কেউ না কেউ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে এমন কেউ অবশিষ্ট নেই, অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তি খুুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি ফোবানাকে ঐক্যবদ্ধ করতে উদ্যোগ নেবেন। আবার কেউ উদ্যোগ নিলে তার কথা সবাই শুনবেন, এমন ব্যক্তিও বাংলাদেশি কমিউনিটিতে দেখা যাচ্ছে না। 
ফোবানাকে ঐক্যবদ্ধ করতে উদ্যোগ নেওয়া বাংলাদেশি কমিউনিটির একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ জানান, আমাকে একবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তখন মাত্র বিভক্ত হয়েছে ফোবানা। আমি ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ কথা শোনেননি। সেই যে বিভক্তির ধারা, তা এখনো বহমান। এখন প্রতিবছর একটি করে বিভক্তির ‘বাচ্চা প্রসব’ করে ফোবানা। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন প্রবীণ রাজনীতিক বলেন, একসময় ফোবানা নিয়ে গর্ব করতাম। আর এখন বলতে লজ্জাবোধ হয়। একসময় আমরাই ফোবানা প্রতিষ্ঠা করেছি। এখন ফোবানা ভাঙলো, নাকি ভেস্তে গেল, তাতে কিছুই আসে যায় না। 
ফোবানাকে এক করার আর সুযোগ আছে কী না জানতে চাইলে এই প্রবীণ রাজনীতিক বলেন, এখন কয়টা ফোবানাকে এক করবো। এখন তো ঘরে ঘরে ফোবানা। প্রকৃত অর্থে ফোবানায় কিছু দুষ্টু লোক ঢুকে পড়েছে। তাদের কব্জা থেকে ফোবানাকে বের করে আনা কঠিন। এই দুষ্টু লোকগুলো নিজেদের অনেক বড় কিছু মনে করেন। ফলে ফোবানা মানেই এখন বিভক্তি, উল্লেখ করেন ওই নেতা।
যাদের কারণে ফোবানার বিভক্তি, এখন যারা ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন, অভিযোগের তীর তাদের দিকেও। প্রবীণ এই মানুষেরা ফোবানা ভেঙেছেন। আবার এক করতে দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কিন্তু এক করতে পারেননি। বরং ফোবানার চিন্তা মাথা থেকে ফেলে কমিউনিটির অন্য সংগঠনে ঢুকে সেগুলো ভাঙতে শুরু করেছেন। 
সদ্য অনুষ্ঠিত নিউইয়র্ক বইমেলা ভাঙনের নেপথ্যে যারা, ফোবানা ভাঙনের নেপথ্যেও তাদের অনেকে রয়েছেন। আঞ্চলিক সংগঠনগুলো ভাঙলেও কমিউনিটির মানুষ ততটা বিব্রত হয়নি, যতটা এ বছর বইমেলার ভাঙনে বিব্রত হয়েছেন তারা। বইমেলা ভেঙে যাওয়ায় বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকে বিব্রত হয়েছেন। তারা হতাশ হয়েছেন। এ কারণে এবারের কোনো বইমেলায় বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকে যাননি। বিব্রত হয়েছেন বেশ কয়েকজন কবি ও লেখক। জার্মানি থেকে কবি ও লেখক নাজমুন নেসা পিয়ারি এবার বইমেলায় আসেননি শুধু এই ভাঙনের কারণে। যদিও তিনি না আসার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানাননি।
প্রবাসের সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক সংগঠন জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন সিলেটবাসীর ঐক্যের প্রতীক ছিল। কিন্তু সেই সংগঠনটি ভেঙে যায় ২০২৩ সালের মাঝামাঝি। সংগঠনের তহবিল থেকে নিজ নামে ‘জালালাবাদ ভবন’ কেনা নিয়ে সৃষ্ট বিরোধে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মইনুল ইসলামকে চূড়ান্ত অব্যাহতির এক সপ্তাহ পরই পাল্টা সাধারণ সভায় বহিস্কার করা হয় সভাপতি বদরুল খান ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রোকন হাকিমকে। সভায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ঘোষণা করা হয় তৎকালীন সহ-সভাপতি শাহীন কামালীকে। এর ফলে কার্যত পাল্টাপাল্টি নেতৃত্ব তৈরি হলো প্রবাসে ৩৮ বছর ধরে ঐক্য ধরে রাখা বৃহত্তর সিলেটবাসীর এই সংগঠনটি। 
জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের এই ভাঙনের পর প্রবীণ ব্যক্তিরা বহুভাবে ঐক্যের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছেন। এই চেষ্টা সফল হয়নি কিছু ‘দুষ্টু’ লোকের কারণে। বয়সের ভাড়ে ন্যুব্জ, অথচ এই দুষ্টু লোকেরা সমস্যা জিইয়ে রেখে ‘খেলে’ যাচ্ছেন এখনো। কবে এই সংগঠনটি এক হবে, তা কেউ বলতে পারেন না। সবাই এক প্রকার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। 
শুধু জালালাবাদ নয়, বাংলাদেশ সোসাইটি এবং বিয়ানীবাজার সমিতি ছাড়া প্রবাসের ৯৯ ভাগ সংগঠন নেতৃত্বের কোন্দলে বিভক্ত। আগে জেলাভিত্তিক সংগঠনগুলোতে বিভক্তি ছিল। এখন উপজেলাভিত্তিক অনেক আঞ্চলিক সংগঠন ভেঙে গেছে। 
প্রবাসের অন্যতম বড় আঞ্চলিক সংগঠন ঢাকা জেলা সমিতি প্রতি বছর নির্বাচনের আগে ভেঙে যায়। বর্তমানে দুটি সক্রিয় দুটি কমিটি রয়েছে সংগঠনটির। 
আঞ্চলিক সংগঠনের বাইরে বাংলাদেশি কমিউনিটির ক্রীড়া সংগঠন বাংলাদেশ স্পোর্টস কাউন্সিল ভেঙেছে। একই নামে না হলেও অনেক কর্মকর্তা বেরিয়ে গিয়ে পাল্টা সংগঠন গড়েছেন। সাংস্কৃতিক সংগঠনও ভাঙার নজির রয়েছে এই কমিউনিটিতে। একই নামে না হলেও ভিন্ন নামে সংগঠন আছে।
‘ভাঙন’ শব্দটিই খুবই নেগেটিভ। ঐক্য যেমন মানুষকে, সংগঠনকে এবং সমাজকে শক্তিশালী করে; ভাঙন তার বিপরীতে ভেঙে টুকরো টুুকরো করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিউইয়র্কে একটি আঞ্চলিক সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমরা প্রবাসে থাকি। দেশ ছেড়ে এসে সবার মনেই একটা হাহাকার। শত হাহাকারের মধ্যেও আমাদের স্বপ্ন-এ দেশে নিজেদের ভাগ্য বদলের এবং সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়া। এ দেশে আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ এবং সম্ভাবনা আকাশছোঁয়া। এই সম্ভাবনার আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা লক্ষ করা যাচ্ছে। যারা আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের প্রজন্মের কথা নিয়ে ভাবেন, তাদের ক্রমেই শঙ্কিত করে তুলছে। এখানে সংগঠনের ভাঙন বলা যায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সকালে ঐক্য তো বিকালেই ভাঙন। আঞ্চলিক সংগঠনের অনেকগুলোরই একাধিক ভাঙন। এগুলো মানুষের সহনীয় হয়ে গেছে অনেকটাই। 
প্রবাসের একজন প্রবীণ ব্যক্তি, যিনি একটি বড় আঞ্চলিক সংগঠনের নেতা ছিলেন, তিনি বলেন, যেভাবে কমিউনিটিতে বিভক্তি বাড়ছে তাতে ভবিষ্যতে কী হবে, কে জানে! এত অনৈক্য থাকলে বাংলাদেশি কমিউনিটি বেশীদূর এগোতে পারবে না। মূলধারায় এক পা এগোলে দুই পা পিছিয়ে পড়ছে এই কমিউনিটি। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মূলধারার একজন নেতা বলেন, শুধু নেতৃত্বের কোন্দলে নয়, এখন অর্থবিত্ত আর ইগোর কারণে বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেক সংগঠন ভাঙছে। অনেকেই অর্থের জোরে নেতা বনে যান। সেই নেতাদের দ্বারা সংগঠনের বা মানুষের কোনো কল্যাণ হয় না। তিনি বলেন, সংগঠনের নেতাদের অনেক দায়িত্ব। কেবল নিজের মান এবং প্রতিপত্তি অর্জনের জন্য নেতৃত্বের আসনে বসে লাভ নেই। যারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে নেতৃত্বে যান, তারা আর নেতৃত্বের পরিবর্তন চান না। আর এভাবেই চলছে বাংলাদেশি কমিউনিটি। 
কমিউনিটির এই সংকট প্রবাসীদের কাছে তুলে ধরার দায়িত্ব যাদের, সেই সাংবাদিকদের মধ্যে বিভক্তি চরমে। নিউইয়র্কে পেশাদার সাংবাদিক নেই ২০জনও। অথচ পাঁচটি প্রেসক্লাবে সদস্য দেড় শতাধিক। আইডেন্টি ক্রাইসিসে ভোগা কিছু দুষ্টু লোক দিন শেষে সাংবাদিক সেজে এসব প্রেসক্লাবে ঢুকে পড়ছে। তারাই সাংবাদিক সেজে কমিউনিটির ভাঙনে ভূমিকা রাখছে, কেউ ইন্ধন দিচ্ছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।