সহিংসতা-দুর্যোগ

ট্রমায় ভুগছে প্রতি ১০০ জনে ৫৫ শিশু, স্কুলে যাচ্ছে না ৩৭ শতাংশ

ডেস্ক রিপোর্ট
  ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২:১৭

বছরজুড়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা লেগেই থাকে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়টা ছিল আরও ভয়াবহ। পাশাপাশি বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয় দেশে। এছাড়া মহামারি করোনাভাইরাসও আতঙ্ক ছড়িয়েছে সবার মনে। সহিংসতা, দুর্যোগ ও করোনার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের ৫৫ দশমিক ২ শতাংশ শিশু শিক্ষার্থী মানসিক ট্রমায় ভুগছে। তারা অল্পতেই ভীত-সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযান ও ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষণায় এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী- এ ভীতির কারণে লেখাপড়ায় অমনোযোগী বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ শিশু। ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে গড় উপস্থিতি কমেছে ৩৬ দশমিক ৯ শতাংশ।
সোমবার (৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার।
মতবিনিময় সভার শুরুতে জানানো হয়, দেশের আটটি বিভাগের মোট ২০৩টি সংগঠনের সহায়তার সাধারণ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মতামত নেওয়া হয়। ১২টি ফোকাস গ্রুপ আলোচনা, ৩০ জন তথ্যাভিজ্ঞ ব্যক্তির মতামত সংগ্রহ এবং দুটি বিভাগীয় ও দুটি জাতীয় পর্যায়ের সভার মাধ্যমে এ গবেষণার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে- রাজনৈতিক, প্রাকৃতিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে শিশুদের মধ্যে আরও নানা মানসিক পরিবর্তন সৃষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ শিশুমনে মানসিক অস্থিরতা বা ট্রমায় ভুগছে। ১৯ দশমিক ২ শতাংশ শিশু শিক্ষায় বা পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে পড়েছে। ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু উচ্ছৃঙ্খলতা, ৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষাক্রমের বিরূপ প্রভাব, ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ ডিভাইসে আসক্ত হয়েছে। তাছাড়া ৬ দশমিক ৯ শতাংশ ভীতসন্ত্রস্ত থাকা, ২৩ দশমিক ২ শতাংশ আতঙ্কিত থাকা এবং ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ শিশুমনে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে।
তাছাড়াও শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যমে ছবি ও খবর দেখে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়া, শিশুসুলভ চঞ্চলতা হারিয়ে যাওয়া বা একাকিত্ববোধ সৃষ্টি হওয়া, বন্যার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি বেড়ে যাওয়ার হার বেড়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। যেসব সুপারিশ করেছে গণসাক্ষরতা অভিযান সমস্যা থেকে উত্তরণে প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে গণসাক্ষরতা অভিযান।
সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারি পর্যায়ে শিশুসুরক্ষা আইন-২০১৩ বাস্তবায়ন, শিক্ষক-প্রশিক্ষণ পাঠ্যক্রমে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অন্তর্ভুক্ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ট্রমা কাউন্সেলিং কর্মসূচি আয়োজন, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিরূপণের লক্ষ্যে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য খেলাধুলা ও অন্যান্য কর্মসূচি পালনের লক্ষ্যে বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ ব্যবহারের সুযোগ উন্মুক্ত রাখা এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় পর্যাপ্ত সম্পদ ও বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করার সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। 
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, করোনার আগে যে শিক্ষাক্রম সংস্কার করা হয়েছিল, তাতে শিক্ষার অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়নি। এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপর পড়েছে।
শিক্ষায় দ্রুত পরিবর্তন সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, এখন শিক্ষার্থীদের মায়েরাও শিক্ষক। সেজন্য শিশুর সঠিক শিক্ষা নিশ্চিতে প্রয়োজনে অভিভাবকদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, সামাজিক পরিবর্তন আনা সম্ভব না হলে শুধু কাউন্সেলিং করে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সম্ভব নয়।
চলতি মাসে ১০টি বিদ্যালয় উদ্বোধন করা হবে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, এ স্কুলগুলো আলাদা আলাদাভাবে সাজানো হয়েছে। তাছাড়া বিদ্যমান প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সাজানোর কাজও আমরা করছি। এগুলো শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে কাজ করবে।
মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। সমাপনী বক্তব্যে তিনি বলেন, শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হবে। সেজন্য আমরা মতবিনিময় সভা থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাবগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরবো, যেন সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন গণসাক্ষরতা অভিযানের উপ-পরিচালক তপন কুমার দাশ, সংস্থাটির কার্যক্রম ব্যবস্থাপক আব্দুর রউফ, টিচার ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল হক। অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন ব্র্যাক শিক্ষা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র অ্যাডভাইজার ড. মুহাম্মদ মুসা। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন এডুকেশন ওয়াচের আহ্বায়ক ড. আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী।