জুলাই-আগস্ট মাসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পতন হওয়া আগ পর্যন্ত ‘আওয়ামী দমন পীড়ন ও হত্যাকাণ্ডকে’ সমর্থনের অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন বিভাগের প্রায় অর্ধ শতাধিক শিক্ষককে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছেন শিক্ষার্থীরা। এই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কয়েক দফায় বিক্ষোভও করেছেন তারা। এক পর্যায়ে এই শিক্ষকদের শ্রেণি কার্যক্রম থেকে বিরত রেখে ‘তথ্যানুসন্ধান কমিটিও’ গঠন করেছে প্রশাসন। তবে মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও শ্রেণি কার্যক্রমে ফিরতে পারেননি অভিযুক্ত প্রায় অর্ধ শতাধিক শিক্ষক।
গতবছরের জুলাই-আগস্ট মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন এক পর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলন চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী সমর্থকরাও আন্দোলকারীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালান। এসময় নিপীড়িত নিপীড়িত শিক্ষার্থীদের পাশে না দাঁড়িয়ে গণআন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালানোর অভিযোগ উঠেছে এই অর্ধশতাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, আন্দোলনের নেপথ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ যেমন শিক্ষার্থীদের নানা পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে সাহস জুগিয়েছেন, তেমনি আরেকটি অংশ আন্দোলনের বিপক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছিলেন। তারা আন্দোলন চলাকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা বিতর্কিত পোস্ট করেছেন। আবার প্রকাশ্যে শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার ‘বিনষ্টের’ হুমকিও দিয়েছিলেন তারা।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হওয়া ঢাবি ক্যাম্পাস চালু হয় গত ২২ সেপ্টেম্বর। এরপর থেকেই বিতর্কিত এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে সরব হয় শিক্ষার্থীরা। অভিযুক্ত শিক্ষকদের বয়কটের ডাক দেন বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষার্থীরা। দফায় শুরু হয় বিক্ষোভ। এক পর্যায়ে অভিযুক্ত শিক্ষকদের ক্লাস, পরীক্ষা থেকে সাময়িকভাবে সরিয়ে নেওয়া হয় এই শিক্ষকদের। গঠন করা হয় ‘তথ্যানুসন্ধান কমিটি’। তবে সাত মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও শ্রেণি কার্যক্রমে ফিরতে পারেননি তারা। কিছু কিছু তথ্যানুসন্ধান কমিটি প্রতিবেদন জমাও দিয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত তাদের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর যেসব শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন আইন বিভাগের দুই অধ্যাপক রহমতুল্লাহ ও জামিল আহমেদ চৌধুরী, দুই প্রভাষক মো. আজহার উদ্দিন ভূঁইয়া ও প্রভাষক শাহরিমা তানজিন অর্ণি।
ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অন্তত ১৩ জন শিক্ষকের ক্লাস-পরীক্ষাসহ একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করেছেন অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোর শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান ও মো. আবুল কালাম আজাদ রয়েছেন। বর্জনের তালিকায় আছেন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক সুমন দাস, শবনম জাহান ও মো. মোশাররফ হোসেন, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. খালেদ বিন আমির, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক মো. আফজাল হোসেন ও সামশাদ নওরীন, ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক শেখ তানজিলা দীপ্তি, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদা আক্তার, অধ্যাপক মো. মুশফিকুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও মো. জামিল শরীফ।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মামুন আল মোস্তফা ও মো. মনিরুল ইসলাম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মশিউর রহমান, জিনাত হুদা, অধ্যাপক জামাল উদ্দিন ও অধ্যাপক সাদেকা হালিম; শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক সাবের আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম ওরফে রফিক শাহরিয়ার ও মারিয়া হোসাইন; পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের মুহাম্মদ বিল্লাল হোসেন, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মিজ সুমাইয়া ইকবাল ও এ বি এম নাজমুস সাকিব; লোকপ্রশাসন বিভাগের সাদিক হাসান এবং অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ শাহাদাত হোসেন সিদ্দিকীর ক্লাস বর্জন করেছেন শিক্ষার্থীরা।
কলা অনুষদের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বায়তুল্লাহ কাদেরী, তার বিরুদ্ধে এখনো আন্দোলন চলমান, থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী ফারজানা আফরীন, অধ্যাপক মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম,সহকারী অধ্যাপক জাহিদুল ইসলাম সানা ও মোহাম্মদ ইমাউল হক সরকার, উর্দু বিভাগের ১ জন অধ্যাপক মো. মাহমুদুল ইসলাম, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজের প্রভাষক মো. রাকিবুল হাসান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২ জন অধ্যাপক আবদুল বাছির ও অধ্যাপক মো. আবদুর রহিমের ক্লাসও শিক্ষার্থীরা বর্জন করেছেন।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও দাবির মুখে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে চলমান পাঁচটি ব্যাচের সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে স্বেচ্ছায় বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মোসা. রেবেকা সুলতানা ও সহযোগী অধ্যাপক মন্দিরা চৌধুরী।
জীববিজ্ঞান অনুষদের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক নীল দলের শিক্ষক মো. হারুনর রশীদ খানের ক্লাস বর্জন করেছেন শিক্ষার্থীরা। মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মো. কামাল উদ্দিন, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ. আজমল হোসেন ভূঁইয়া, মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুর রহমান, বিজ্ঞান অনুষদের গণিত বিভাগের চন্দ্রনাথ পোদ্দার, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আফরোজা শেলী ও অধ্যাপক মো. শফিকুল ইসলামের ক্লাসও বর্জন করেছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম ওহিদুজ্জামান ও অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ওরফে লিটুর ক্লাস শিক্ষার্থীরা বর্জন করেছেন। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের প্রভাষক ফারিহা কাদির ও প্রভাষক মুহাম্মদ ইহসান-উল-কবিরের ক্লাসও বর্জন করা হয়েছে।
চারুকলা অনুষদের মৃৎশিল্প বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. রবিউল ইসলামসহ দুই শিক্ষক এবং শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের একজন শিক্ষকও রয়েছেন এই তালিকায়।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত এই শিক্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি চান শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীম উদদীন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মারুফ হাসান শাহীন বলেন, ‘আমি মনে করি, শিক্ষকদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের দোসরদের সঙ্গে ছিলেন। তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক যারা আছেন; তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। তারা যদি কোনও বাড়তি সুবিধা নিয়ে থাকেন, অতীতে যেমনটা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা নিয়েছে; তাহলে সেই সুবিধাগুলো বাতিল এবং তারা থেকে যদি এসব অর্থ নিয়ে থাকেন, তাহলে সেগুলো ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। আর যেই জুনিয়র শিক্ষকরা আছেন, লেকচারার বা এমন পর্যায়ের; তারা যদি ডিপার্টমেন্ট-কেন্দ্রিক শিক্ষার্থীদের কোনও হুমকি বা কিছু দিয়ে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।’ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ যদি আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে চায়, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতা করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
আরেক শিক্ষার্থী ইমরান বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক যখন স্বৈরাচারী মনোভাব পোষণ করে এবং তাদের আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিয়ে আমজনতার ওপরে স্বৈরাচারী আচরণ করে; এটা মোটেও কাম্য নয়। এটা সমাজের জন্য হতাশাজনক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কলঙ্কময়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত একটি দৃশ্যমান এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা দরকার; যাতে করে পরবর্তী সময়ে অন্য কোনও শিক্ষক একই ধরনের কাজ পুনরাবৃত্তি না করতে পারেন।
এই শিক্ষকদের বিষয়ে প্রশাসনের কার্যক্রম জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘কয়েকটে তথ্যানুসন্ধান কমিটির রিপোর্ট আমরা পেয়েছি। সেগুলো দ্রুতই সিন্ডিকেটে যাবে। সিন্ডিকেটে প্রচুর বিষয় জমা আছে। আগামী সিন্ডিকেটে হয়তো এ বিষয়ে কয়েকটি সিদ্ধান্ত আসবে। ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী প্রয়োজন হলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। আমরা প্রসেস অনুযায়ী এগোচ্ছি।’
সিদ্ধান্তের দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা একটা নির্দিষ্ট প্রসেসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এখানে চাইলেও আমরা দ্রুত কিছু করে ফেলতে পারছি না। আইনের মধ্য দিয়ে না গেলে ন্যায্যতা পাওয়া যাবে না। দ্রুততার কারণে আমাদের অনেক শিক্ষক অপরাধ করেও হাইকোর্ট থেকে ছাড়া পেয়ে গেছেন। তাই আমরা সময় নিয়ে নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কমিটির শিক্ষকরা শুধু এই কাজ নিয়েই ব্যস্ত নন। পাশাপাশি তাদের অনেক কাজ থাকে। এছাড়া আমাদের দুটো কমিটির প্রধান ভিসি ও প্রো-ভিসির দায়িত্ব পেয়েছেন। তারা সেখান থেকে এসে কাজ করছেন। সবমিলিয়ে সময় তো একটু লাগবেই। তবে আমরা ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং রিপোর্টগুলো পাচ্ছি। সিন্ডিকেটে সেগুলো তুলে সিদ্ধান্ত আসবে।’
ঠিক কতজন শিক্ষক শ্রেণি কার্যক্রম থেকে বিরত আছেন, নির্দিষ্ট করে জানাতে না পারলেও সংখ্যাটি ‘৫০-৬০’ এরমধ্যেই বলে নিশ্চিত করেন প্রক্টর।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদ বলেন, ‘তদন্ত চলছে, শিগগিরই সমাধান হবে। একাধিক কমিটি কাজ করছে। রিপোর্টগুলো আসলে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’