নতুন কারিকুলামের সংস্কারসহ একগুচ্ছ দাবিতে কখনো সরাসরি, কখনোবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভার্চুয়ালি আন্দোলন করছেন অনেক অভিভাবক। তারা আগামী শিক্ষাবর্ষে (২০২৪) পাঠ্যপুস্তক উৎসব বয়কট করার আহ্বান জানিয়েছেন ভার্চুয়াল গ্রুপগুলোয়। পাশাপাশি বলছেন, সে সময় স্কুলে নতুন ভর্তি থেকে সন্তানদের বিরত রাখবেন। অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এটিকে নতুন কারিকুলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে শিক্ষকদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ কমানো ও মুখস্থনির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করে সরকার। এর প্রয়োগিক দিক নিয়ে নানা সমালোচনা চলছে। অভিভাবকদের একাংশ শিক্ষাক্রম সংশোধনের দাবি তুলে মানববন্ধনও করেছে। তারা পরীক্ষা পুনরায় বহাল করা এবং প্রাকটিক্যাল কাজ প্রতিষ্ঠানেই শেষ করার দাবি তুলেছেন। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানই যেন প্র্যাকটিক্যালের ব্যয়ভার বহন করে, সে দাবিও তুলেছেন।
সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে অভিভাবকরা ৮ দফা দাবি জানিয়েছেন। দাবিগুলো হলো- নতুন কারিকুলাম সংস্কার বা বাতিল করতে হবে, ৫০/৬০ নম্বরে অন্তত ২ সাময়িক লিখিত পরীক্ষা চালু রাখতে হবে, নবম শ্রেণিতে বিভাগ রাখতে হবে, ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ ইত্যাদি ইন্ডিকেটর বাতিল করে নম্বর ও গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি রাখতে হবে। শিখন ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক ক্লাসের সমস্ত ব্যয় স্কুলকে বহন করতে হবে এবং স্কুল পিরিয়ডেই সকল প্রজেক্ট সম্পন্ন করতে হবে, শিক্ষার্থীদের দলগত কাজে ডিভাইসমুখী হতে অনুৎসাহিত করতে হবে এবং তাত্ত্বিক বিষয়ে অধ্যয়নমুখী করতে হবে, প্রতিবছর প্রতি ক্লাসে রেজিস্ট্রেশন ও সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে, সকল শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই তা মন্ত্রিপরিষদ এবং সংসদে উত্থাপন করতে হবে।
এসব দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতিদিনই তারা নতুন নতুন কর্মসূচির বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে তুলছেন অনলাইনে। ইতোমধ্যে আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ আগামী ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে সন্তানকে স্কুলে নতুন ভর্তি করানো থেকে বিরত থাকার বিষয়ে জনমত তৈরি করছেন। আবার কেউ বছলেন, আগামী ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক উৎসব বয়কট করার কথা।
এ ছাড়া সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রতি স্কুলের সামনে মানববন্ধন, নতুন কারিকুলাম নিয়ে আলোচনাসভা, স্কুলে স্কুলে জরিপ কার্যক্রম, কারিকুলাম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বৈঠক, ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাবিদ, গবেষক, মন্ত্রী, মাউশি কর্মকর্তাদের নিয়ে কনফারেন্স/মতবিনিময়সভা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদান, সম্মিলিত শিক্ষা কমিশন গঠন ও শিক্ষানীতির পূর্ণ প্রস্তাবনা সরকারের কাছে প্রেরণ ইত্যাদি।
গত বৃহস্পতিবার মানববন্ধন করেছেন আন্দোলনকারী অভিভাবকরা। তারা চলতি বছর থেকে দেশে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলসহ একাধিক দাবি জানান; ঘোষণা করেন বেশ কিছু কর্মসূচি। এদিন রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের সড়কে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। তাদের এ আন্দোলনে সংহতি জানাতে দেখা যায় শিক্ষকদেরও। সারাদেশের স্কুলে স্কুলে অভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে বলে জানা গেছে।
মানববন্ধনে অভিভাবকরা বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে হবে ৮টি বিষয়। নতুন শিক্ষাক্রমে তাত্ত্বিক বিষয়ের চেয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নকে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। নেই সাময়িক পরীক্ষাও। এর প্রেক্ষিতে তারা বলছেন, পরীক্ষা পদ্ধতি না থাকায় ছাত্রছাত্রীরা অধ্যয়নমুখী হচ্ছে না। বইয়ের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ায় তারা ডিভাইসমুখী হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে সবচেয়ে বড় সমস্যা দলগত কার্যক্রমে। দেখা যাচ্ছে স্কুল থেকে প্রদত্ত দলগত কাজটি করতে হচ্ছে স্কুল পিরিয়ডের পর। যে কারণে ছাত্রছাত্রীদের বন্ধু-বান্ধবীর বাসায় বা অন্য কোথাও একত্রিত হয়ে তা সম্পন্ন করতে হচ্ছে। অধিকাংশ অভিভাবক স্কুল ছুটির পর তার সন্তানকে অন্য কারও বাসায় নিয়ে যেতে আগ্রহী নয় এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। অপরদিকে প্রজেক্টগুলোর সামগ্রী অপ্রতুল। দামও চড়া। এই উপকরণ গ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য দুর্লভ। তারা বলছেন, গত ৯ মাসের বিভিন্ন জরিপ বলছে গ্রামের স্কুলগুলোতে এই শিক্ষাক্রম ১০ শতাংশও সফল হয়নি। এমতাবস্থায় এই শিক্ষাক্রম সংস্কার বা বাতিলের দাবি তাদের।
এদিকে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে দেশের স্কুলগুলোর প্রধান শিক্ষকসহ সব শিক্ষককে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত সোমবার রাতে। নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে অভিভাবকদের জানাতে স্কুলগুলোতে অভিভাবক সমাবেশ আয়োজনেরও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সমস্যা ও উত্তরণের উপায় নিয়ে ঢাকা অঞ্চলের এগারো জেলার প্রায় পাঁচশ প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সভায় মন্ত্রী এ নির্দেশনা দেন।