ভিকারুননিসার শিক্ষার্থী অরিত্রীর মৃত্যুর ৫ বছর

‘সন্তানের লাশ কতটা ভারী তা শুধু বাবাই জানেন’

নিজস্ব প্রতিবেদক
  ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৪:০০

সন্তানের লাশ যে কতটা ভারী তা ক্ষণে ক্ষণে টের পাচ্ছেন দিলীপ অধিকারী। কিছুতেই ভুলতে পারবেন সেই স্মৃতি। ভুলবেনই বা কেমনে? বাবার আক্ষেপ, ‘সন্তানের লাশের বোঝা যে বাবা কাঁধে নেন তিনিই বুঝেন কষ্টটা’।
পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালের এই দিনে (৩ ডিসেম্বর) আত্মহত্যা করেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারী। অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় তার বাবা দিলীপ অধিকারী রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও শাখাপ্রধান জিনাত আক্তারকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করে ডিবি পুলিশ। ২০১৯ সালের ১০ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা (তৎকালীন) জজ রবিউল আলম। সাক্ষ্যগ্রহণও হয়। পরবর্তীতে মামলাটি ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ-১২ এর বিচারক আব্দুল্লাহ আল মামুনের আদালতে পাঠানো হয়। গত ২৭ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত আগামী ২১ জানুয়ারি রায়ের তারিখ ধার্য করেছেন। রায়ে আসামিদের দৃষ্টান্তুমূলক সাজা চায় পরিবারটি।
মামলা সম্পর্কে অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী বলেন, ‘সন্তানের লাশের বোঝা যে বাবা কাঁধে নেয় তিনিই বুঝেন সন্তান হারানোর বেদনা। এই কষ্ট আমৃত্যৃ শেষ হবে না। আর এটা হওয়ারও না। তারপরও নিজের জন্য, সংসারের জন্য বেঁচে আছি। বিষয়টা এমনই। সন্তান হারানো এতটা কঠিন, কষ্টের যা শেয়ার করা যায় না। এই বেদনা যতদিন বাঁচি বয়ে যেতে হবে। সেই দিনের অপমান কখনো ভুলব না। তারা সেদিন এ ধরনের বিহ্যাব না করলেও পারতেন। আমাদের সাথে সন্তানের সামনে। বাবা-মায়ের অপমাণ কোনো সন্তান সহ্য করতে পারে না। তারা এটা না করলেন পারতেন। টিসি দিয়ে বের করার হুমকি দেয়। যাদের কারণে সন্তান হারিয়েছি তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই। সন্তান হারানোর বিচার চেয়ে মামলা করেছি, লড়েছি। এখন বিচার যা হয় মেনে নিতে হবে। তবে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা চাই। অবিচল আস্থা বিচার যা হয় মেনে নিবো। তবে সেদিন তাদের বিহ্যাব ছিলো কমার্শিয়াল, ওদ্ধত্যপূর্ণ। বারবার বলেছি টিসি দিয়েন না, সন্তানদের অন্যত্র নিয়ে নিবো। তারা কোনো কথা শোনেনি। বললো মোবাইল দেখে নকল করেছে। কিন্তু তা প্রমাণ করতে পারেনি।
তিনি বলেন, এটা আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। কিছু টিচার বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এত রূঢ় আচরণ করে তাদের জন্য রায়ে সতর্কবার্তা হওয়া উচিত। সেই ম্যাসেজটা বিচার ব্যবস্থায় থাকা উচিত। তবে ন্যায়বিচার নিয়ে শঙ্কিত তিনি।
অরিত্রীর ছোট বোন ঐন্দ্রিলা অধিকারীর বিষয় উল্লেখ করে দিলীপ অধিকারী বলেন, ওকে নিয়েই এখন আমাদের সব। চোখের আড়াল করি না। মেয়েটা কিছুটা অভিমান করে। বোন মারা যাওয়ায় বড় ভুক্তভোগী সে। বোনই ছিলো ওর সব। সে এখন বোনের মত সাজতে চায়। বোনই তার কাছে আইডল। এখন মা-বাবার টেক কেয়ার করে সে। আমাদের শান্ত্বনা দেয়। 
অরিত্রীর বিষয় উল্লেখ করে বলেন, প্রতিটি জায়গায় ওর স্মৃতি জড়িত। ওর ব্যবহৃত জিনিসপত্র কিছু বাসায় আছে। কিছু কিছু গরীবদের দিয়ে দিয়েছি। গিটারটা আগের জায়গাতেই রয়েছে।
অরিত্রীর মায়ের বিষয়ে বলেন, এখনো সে দিনে ২/১ বার কান্নাকাটি করে। ওর বান্ধবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ওর মা যাদের দেখে ভার্সিটিতে যাচ্ছে। এটা তাকে খুব পেইন দেয়। এই দিন আসলে অরিত্রী ভালো কি খেতো রান্নার পরিকল্পনা করে।
শিক্ষকদের উদ্দেশ্য বলেন, তারা যেন স্টুডেন্টদের সাথে শিক্ষকসুলভ আচরণ করেন। শুধু শাসন করে নয় ভালোভাবে বুঝিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে সবকিছু জয় করা যায়।
মামলা সম্পর্কে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, আমরা রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে সচেষ্ট হয়েছি। আশা করছি, আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হবে এবং ভুক্তভোগী পরিবারটি ন্যায়বিচার পাবে।
এ বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন।
অরিত্রীর আত্মহত্যায় ঘটনায় রাজধানীর পল্টন থানায় তার বাবা দিলীপ অধিকারী বাদী হয়ে ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে দণ্ডবিধির ৩০৫ ধারায় মামলাটি দায়ের করেন। তিনি অভিযোগ করেন, ৩ ডিসেম্বর পরীক্ষা চলাকালে অরিত্রীর কাছে মোবাইল ফোন পান শিক্ষক। মোবাইল ফোনে নকল করেছে, এমন অভিযোগে অরিত্রীকে পরদিন তার মা-বাবাকে নিয়ে স্কুলে যেতে বলা হয়। দিলীপ অধিকারী স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ওই দিন স্কুলে গেলে ভাইস প্রিন্সিপাল তাদের অপমান করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। মেয়ের টিসি নিয়ে যেতে বলেন। পরে প্রিন্সিপালের কক্ষে গেলে তিনিও একই রকম আচরণ করেন। এ সময় অরিত্রী দ্রুত প্রিন্সিপালের কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। পরে শান্তিনগরে বাসায় গিয়ে তিনি দেখেন, অরিত্রী তার কক্ষে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়নায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় ঝুলছে। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা অরিত্রীকে মৃত ঘোষণা করেন।
মামলায় তিনজনকে আসামি করা হয়। মামলা দায়েরের পর ৫ ডিসেম্বর শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরের দিন আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে ৯ ডিসেম্বর জামিন পান হাসনা হেনা। ১৪ জানুয়ারি নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তার আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন।
২০১৯ সালের ২০ মার্চ নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তারকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক কামরুল হাসান তালুকদার। আর শ্রেণিশিক্ষক হাসনা হেনাকে অভিযুক্ত করার মতো সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় তার অব্যাহতির আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
নির্দয় ব্যবহার ও অশিক্ষকসুলভ আচরণে আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয় বলে চার্জশিটে উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
এদিকে দুই আসামির বিরুদ্ধে যে ধারায় চার্জ গঠন করা হয়েছে উক্ত ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা মৃতুদণ্ড হতে পারে। এছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কারাদণ্ডের পাশাপাশি অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।