মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ে টানা দুই শিক্ষাবর্ষের ভুল-অসংগতি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। শুধু বানান ভুল নয়, নানা অসংগতি ও ভুল তথ্যে ঠাসা ছিল পাঠ্যবই। একের পর এক সংশোধনী দিয়ে বইগুলো ঠিক করেছে দায়িত্বে থাকা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। তবে এমন আরও অনেক ভুল রয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষকরা।
২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে সব মিলিয়ে পৌনে ৭০০ ভুল ধরা পড়ে। ঐ বছরের এপ্রিলে ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি ভার্শনে ৩৮টি আর বাংলা ভার্শনে ৩৩৫টি ভুল পেয়ে সংশোধনী দেওয়া হয়। আর সপ্তম শ্রেণির বাংলা ভার্শনে ২৪১টি এবং ইংরেজি ভার্শনে ৬১টি ভুল সংশোধন করা হয়। বেশির ভাগ সংশোধন হয় বাক্য, শব্দ, বানান ছাড়াও ব্যাকরণজনিত সমস্যা এবং গণিতে যোগ-বিয়োগের সমস্যা বা ছবির ব্যবহার ও পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে।
তথ্যগত ভুল ধরা পড়ায় একই বছরের জানুয়ারিতে সংশোধনী দিতে হয়েছিল। মাধ্যমিক স্তরের তিনটি বইয়ে ৯টি ভুলভ্রান্তি ছিল। নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও গণহত্যাবিষয়ক অংশে প্রথম লাইনে বলা হয়েছিল, ‘২৬ শে মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছিল’। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের বর্বর হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ রাত থেকেই নিরীহ বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়।
এছাড়া ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’-এ বলা হয়েছিল, ’৫৪ সালের নির্বাচনে ৪টি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। বইয়ে ৪টি দলের নামও দেওয়া হয়েছিল। এখন সংশোধনীতে বলা হয়, ’৫৪ সালের নির্বাচনে ৫টি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। এমন নানা তথ্যগত ভুল থাকায় তার সংশোধনী দিয়েছিল এনসিটিবি।
চলতি শিক্ষাবর্ষে বিনামূল্যে বিতরণ করা ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন বইয়ের ১৩০টির বেশি ভুলভ্রান্তির তথ্য পেয়েছিল এনসিটিবি। গত মে মাসে এগুলোর সংশোধনী দেওয়া হয়। ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ের একটি পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে ‘৫৫০০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস’। প্রকৃতপক্ষে এটি হবে ‘৫৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস’। অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের একটি পৃষ্ঠায় এক জায়গায় আছে ১৯৮৩। আসলে হবে ১৯৮২। অষ্টম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ের একটি পৃষ্ঠায় ছিল ‘হাইড্রোজেন ও পানির বিক্রিয়ায় পানি উৎপন্ন হয়’। সংশোধন করে এটি করা হয় ‘হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় পানি উৎপন্ন হয়’।
গত শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন কারিকুলামে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পাঠ্যবই দেওয়া হয়। গত বছর পাঠ্যবইয়ে ডারউইনের মতবাদ যুক্ত করায় তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে শিক্ষামন্ত্রণালয়। একপর্যায়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ্যবই দুটো প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। গত শিক্ষাবর্ষে এই দুটি শ্রেণিতে মোট ১৫টি পাঠ্যবই প্রদান করা হলেও এবার দেওয়া হয়েছে ১৪টি করে।
চলতি বছর সপ্তম শ্রেণির নতুন পাঠ্যবইয়ে ‘শরীফার গল্প’ যুক্ত করা হয়। এটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। গল্পটি পর্যালোচনা করতে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির দেওয়া সুপারিশের ভিত্তিতে এমন গল্পটি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
নবম শ্রেণির ‘জীবন ও জীবিকা’ বইয়ের ‘উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা’ অংশটি রয়েছে ৩০ থেকে ৬০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। এর মধ্যে ৩৮ নাম্বার পৃষ্ঠায় ‘ব্যবসার ব্র্যান্ডিং, মার্কেটিং বা বিপণন পরিকল্পনা’সংক্রান্ত ৬ নাম্বার ধাপে উদ্যোক্তা হিসেবে কীভাবে ব্যবসা শুরু করতে হয়, তার উল্লেখ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি কিউআর কোড সংযুক্ত করা হয়েছে। কোডটি স্ক্যান করলে Trucss.com.br নামক ওয়েবসাইট সামনে আসছে। এটি পর্তুগিজ নারীদের অন্তর্বাস বিক্রির একটি ওয়েবসাইট। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা চলছে।
নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে গত বছর লেখা সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের একটি অংশে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট থেকে নিয়ে হুবহু অনুবাদ করে ব্যবহার করা হয়। যদিও এর দায় স্বীকার করে নিয়েছিলেন বইটির রচনা ও সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকা অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক হাসিনা খান।
কেন এত ভুল ও অসংগতি—এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর দায় লেখক ও এনসিটিবি উভয়কেই নিতে হবে। লেখকের দেওয়া পাণ্ডুলিপি ভালোভাবে দেখার জন্য কর্মকর্তারাও রয়েছেন। তারা যদি আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেন, তাহলে এত ভুল থাকার কথা নয়।
এনসিটিবির ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ ড. মো. জুলফিকার হায়দার বলেন, লেখকের কাছ থেকে বই ছাপাখানায় যাওয়ার আগে বেশ কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে। লেখক পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার পর তা স্বাধীন একটি কমিটির মাধ্যমে যৌক্তিক মূল্যায়ন করা হয়। এরপর ঐ বইয়ে কোনো ভুলভ্রান্তি বা অসংগতি পাওয়া গেলে তা নিয়ে লেখকদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। সে আলোকে সংশোধন করা হয়। এরপর আবারও অংশীজনদের দিয়ে মূল্যায়ন হয়। এরপর বইটি চূড়ান্ত হয়। প্রতিটি বইয়ের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ দায়িত্বে থাকেন।
এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী। তিনি বলেন, একটি বইয়ের সবকিছু দেখার জন্য এনসিটিবিরি একজন কর্মকর্তা দায়িত্বে থাকেন। তিনি পাণ্ডুলিপির প্রতিটি পাতায় স্বাক্ষর করেন। কোনো ভুলভ্রান্তি বা অসংগতি আছে কি না, সেটা তারই বারবার দেখা উচিত। নির্ভুল বই হওয়ার পরই তিনি স্বাক্ষর করেন। তাহলে বইয়ে ভুল বা অসংগতি থাকলে ঐ কর্মকর্তাই দায়ী হবেন।
আমিনুল ইসলাম নামে এক শিক্ষক বলেন, এনসিটিবির একেকটি বইয়ে লেখক-সম্পাদক হিসেবে ১০-১৫ জনের নাম থাকে। বই প্রকাশের আগে কয়েক জন বিষয়-বিশেষজ্ঞের কাছেও পাণ্ডুলিপি পাঠানো হয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন কর্মকর্তা সেই বই সম্পর্কে মূল্যায়ন করেন। এ নিয়ে কর্মশালাও হয়। সেখানে বই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা পর্যালোচনা হয়। তাই বইয়ের ভুলের জন্য লেখক-সম্পাদকও দায়ী হবেন।
এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। বর্তমানে তিনি অবসরে রয়েছেন। তিনি বলেন, এনসিটিবিতে কর্মকর্তারা সাধারণ তদ্বির করে আসেন। বইয়ের কাজ করার দক্ষতা তাদের নেই। বিষয় সম্পর্কে তাদের জ্ঞানও নেই। যারা লেখালেখিতে জড়িত ও সৃজনশীল তাদেরই এনসিটিবিতে পদায়ন করা উচিত। কিন্তু তা না করে ইচ্ছেমতো পদায়ন হচ্ছে। এ কারণেই ক্ষতিটা হচ্ছে। অধ্যাপক মান্নান বলেন, বইয়ে ভুল থাকতে পারে। তবে তার মাত্রা কতটুকু। এনসিটিবিতে কোনো প্রুফ রিডার নেই। বাইরে থেকে বই প্রুফ করে আনতে হয়। এনসিটিবিতে অন্তত ছয় থেকে সাত জন প্রুফ রিডার প্রয়োজন।