স্বাদে গুণে অতুলনীয় হওয়ায় বগুড়ার দই দেশ ও দেশের বাইরে তুমুল জনপ্রিয়। সেই সঙ্গে বগুড়ার আরও একটি বিখ্যাত খাবারের হলো মহাস্থানের কটকটি। চার কোণা বিস্কুট আকৃতির শুকনো মিষ্টান্ন জাতীয় গুড়মাখা খাবার এটি। বগুড়া শহর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তরে করতোয়া নদীর পশ্চিম পাশে বাংলার প্রাচীন রাজধানী পুণ্ড্রবর্ধন বা মহাস্থানগড়। এই গড় এলাকাতেই কটকটির উৎপত্তি।
স্থানীয়রা জানায়, উনিশ শতকের শেষের দিকে বগুড়া সদর উপজেলার গোকুল ইউনিয়নে পলাশবাড়ী উত্তরপাড়া গ্রামের জয়নাল আলী মণ্ডল, ভোলা মণ্ডল ও গেদা মণ্ডলের হাতেই কটকটির জন্ম। জীবিকার তাগিদে নিজ বাড়িতে একেবারে সাধারণভাবে গমের আটা দিয়ে কটকটি বানিয়ে মহাস্থান, শিবগঞ্জ, মোকামতলায় বিক্রি করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে এই সুস্বাদু মিষ্টিজাতীয় খাবারটি মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আবার অনেকে বলেন, মহাস্থানগড়ের পীর শাহ সুলতানের মাজারের শিরনি বা তবারক হিসেবে প্রচলন হয় কটকটির। বর্তমানে মহাস্থানগড় ঘিরে গড়ে উঠেছে কটকটির বিশাল বাজার।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অর্ধ শতাধিক বড় দোকানে প্রতিদিন হরেক স্বাদের কটকটির বিশাল পসরা নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। বড় দোকানগুলোর মধ্যে রয়েছে লাল মিয়া কটকটি ঘর, নাসির কটকটি প্যালেস, সুলতান কটকটি প্যালেস, চায়না কটকটি ঘর, ফাতেমা কটকটি প্যালেস, আল আমীন কটকটি প্যালেস, লায়েব কটকটি ভান্ডার ইত্যাদি।
দোকানিরা জানালেন, পর্যটন মৌসুমে এখানে গড়ে প্রতিদিন প্রায় দেড় শ’ মণ কটকটি বিক্রি হয়। স্বাদ ও মানভেদে প্রতি কেজি কটকটির দাম গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। তারা বলেন, আগের দিনে কটকটি বেশ শক্ত ছিল। এখন কটকটি তৈরির পদ্ধতিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় এবং খামিরে ডালডার ব্যবহারের কারণে কটকটি আগের চেয়ে অনেকটাই নরম।
সবচেয়ে পুরোনো নাসির কটকটির বর্তমান স্বত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম জানান, ৬০-৬৫ বছর আগে তার দাদা এই ব্যবসা শুরু করেন। দোকানের নাম রাখা হয় তার বাবার নামে। গড়ে প্রতিদিন ৬-৭ মণ কটকটি বিক্রি হয় এই দোকানে। কটকটি বিক্রি করে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার টাকা লাভ করেন তিনি।
রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রথমে কটকটি বানানো হতো গমের আটা দিয়ে। পরে স্বাদ ও মান বাড়াতে বানানোর পদ্ধতি ও উপকরণে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে এটি ভাজতে তেল ব্যবহার হতো, এখন ঘি-ডালডা ব্যবহার করা হয়।
জানা যায়, কটকটি তৈরি হয় কয়েক ধাপে। এর প্রধান উপকরণ সিদ্ধ সুগন্ধি চাল। চাল পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। একেবারে নরম হলে সেই চাল ছেঁকে শুকানোর জন্য রেখে দিতে হয় প্রায় পনেরো মিনিট। পানি শুকিয়ে গেলে ঢেঁকি, মেশিন বা অন্য উপায়ে একেবারে মিহি আটায় রূপান্তর করা হয়। এই আটার সঙ্গে মেশাতে হয় বিভিন্ন মসলা, সয়াবিন তেল। ভালোভাবে মিশিয়ে গাঢ় করে খামির করা হয়। এরপর আকৃতির জন্য আগে থেকে তৈরি করে রাখা ছাঁচ দিয়ে কেটে নিতে হয়। পরে বড় কড়াইয়ে তেল ও ডালডা দিয়ে ভাজা হয়। ভাজার সময় ঘি স্প্রে করা হয়।
এই কটকটির কদর শুধু দেশেই নয় বিদেশেও আছে। বিউটি নামের একজন কটকটি ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উনি ১২ বছর যাবত আমেরিকায় বসবাস করেন। দেশে এলেই শুকনো খাবার হিসেবে এই কটকটি নিয়ে যান।
তিনি বলেন, কটকটি নিয়ে গিয়ে বগুড়ার আঞ্চলিক খাবার হিসেবে আমেরিকার প্রতিবেশীদের উপহার দিই। ওনারা খেয়ে খুব তারিফ করেন।
মহাস্থানে বেড়াতে আসা সিলেটের পর্যটক আমির আলি বলেন, আমি দশ বছর আগেও মহাস্থানে বেড়াতে এসেছিলাম। ফেরার সময় দশ কেজি কটকটি নিয়ে গিয়ে আমার পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের দিয়েছিলাম। সেসময় আমার একবন্ধু রাশিয়া থেকে দেশে এসেছিল। আমার দেয়া কটকটি খেয়ে তার বেশ ভালো লেগেছিলো। সে আবার রাশিয়ায় কটকটি পাঠানোর জন্য ফোন করেছে। বন্ধুকে কটকটি খাওয়াবো বলেই আবার মহাস্থানে বেড়াতে আসা।
তিনি আরও বলেন, আগে বগুড়ার বিখ্যাত খাবার হিসেবে লোকমুখে শুধু বগুড়ার দই-এর নামই শুনতাম। কিন্তু এই কটকটিও যে এত স্বাদের তা আগে বুঝিনি। এখন দেখছি কটকটিও দইয়ের চেয়ে কম বিখ্যাত নয়।