‘আমার ছোট ছেলের বয়স চার বছর। কিন্তু সে জানেই না যে ফলমূল আর সবজি দেখতে কিংবা খেতে কেমন।’ বিবিসির কাছে গাজা উপত্যকার বাসিন্দারা ভয়াবহ ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের ভয়াল অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। জাতিসংঘ সমর্থিত একটি প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো গাজার কিছু এলাকায় দুর্ভিক্ষের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর স্থানীয়দের কষ্ট আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
জাতিসংঘ-সমর্থিত খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের একটি প্রতিবেদন নিশ্চিত করেছে, গাজা শহর এবং এর আশেপাশের এলাকা এখন দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছে। বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তা ও অপুষ্টির মাত্রা শনাক্ত করতে সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ‘ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি)’ ব্যবহার করে।
গাজার বর্তমান পরিস্থিতিকে আইপিসির প্রতিবেদন ফেজ ৫-এ উন্নীত করেছে। ফেজ ৫ হলো দুর্ভিক্ষের সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে ভয়াবহ মাত্রা।
তবে ইসরায়েল এ অভিযোগ অস্বীকার করছে। গাজা জুড়ে অঞ্চলে যে অনাহার চলছে, সে কথাও ইসরায়েল অস্বীকার করেছে, যা ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শী, একশোর বেশি মানবিক গোষ্ঠী ও জাতিসংঘের একাধিক সংস্থার বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত।
গাজা সিটির ৪১ বছর বয়সী পাঁচ সন্তানের মা রীম তৌফিক খাদার বলেন, ‘দুর্ভিক্ষ ঘোষণা অনেক দেরিতে এসেছে। আমরা পাঁচ মাস ধরে কোনো আমিষ খেতে পারিনি।
আমার চার বছরের ছেলে জানেই না ফল ও সবজির স্বাদ কেমন।’
জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইসরায়েল গাজায় সহায়তা প্রবেশের পরিমাণ কঠোরভাবে সীমিত করে রেখেছে এবং দাবি করেছে গাজায় ক্ষুধা নেই। কিন্তু শতাধিক মানবিক সংস্থা, স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা বলছে এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। যদিও ইসরায়েল এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গাজা শহর ও আশপাশের এলাকায় নিশ্চিত হওয়া দুর্ভিক্ষকে ‘মানবতার ব্যর্থতা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তিনি একে ‘মানবসৃষ্ট বিপর্যয়’ বলে উল্লেখ করেন।
মহাসচিব গুতেরেস বলেন, ‘গাজায় যে নরকযন্ত্রণার মতো পরিস্থিতি চলছে, তার বর্ণনা দেওয়ার মতো শব্দই যেন আর অবশিষ্ট নেই। এখন নতুন শব্দ যোগ হলো—দুর্ভিক্ষ। এটি মানুষের তৈরি বিপর্যয়, নৈতিকতার ব্যর্থতা এবং মানবতার জন্য কলঙ্ক। আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ইসরায়েলের স্পষ্ট দায়িত্ব রয়েছে গাজার জনগণের খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ নিশ্চিত করা।’
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)-এর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেন, ‘এটি পরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট অনাহার এবং ইসরায়েল সরকারের তৈরি।’ জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক বলেন, ‘দুর্ভিক্ষ ইসরায়েল সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের সরাসরি ফলাফল। তারা অবৈধভাবে গাজায় সহায়তা প্রবেশে বাধা দিয়েছে।’ ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি একে 'নৈতিক কলঙ্ক' বলে উল্লেখ করেছেন।
শুক্রবার জাতিসংঘ সমর্থিত ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) জানায়, গাজা সিটি ও আশপাশের এলাকায় সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ চলছে। সংস্থাটি সতর্ক করেছে, গাজার অর্ধকোটি মানুষেরও বেশি ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।
আইপিসি সতর্ক করে জানিয়েছে, তাৎক্ষণিক ও ব্যাপক হস্তক্ষেপ না হলে দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যু ভয়াবহ রূপ নেবে। আগস্টের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ দেইর আল-বালাহ ও খান ইউনিসে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
গাজা সিটির জেইতুন এলাকা থেকে এক মাস আগে ঘর ছেড়ে সমুদ্রতীরে অস্থায়ী তাঁবুতে বসবাস শুরু করেছেন ৪৭ বছরের ছয় সন্তানের মা রাজা তালবেহ। তিনি জানিয়েছেন, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তার ওজন ২৫ কেজি কমেছে। গ্লুটেন অসহিষ্ণুতার কারণে তিনি খাওয়ার মতো উপযুক্ত খাবার খুঁজে পাচ্ছেন না।
তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের আগে একটি দাতব্য সংস্থা আমাকে গ্লুটেন-ফ্রি খাবার পেতে সাহায্য করত। এখন বাজারে সেগুলো পাই না। পেলেও কেনার ক্ষমতা নেই। এখন দুর্ভিক্ষও যোগ হয়েছে, বোমাবর্ষণ, বাস্তুচ্যুতি আর এমন একটি তাঁবু যা আমাদের গরম বা ঠান্ডা কিছুই রাখে না।’
২৯ বছর বয়সী রিদা হিজেহ জানান, তার পাঁচ বছরের মেয়ে লামিয়ার ওজন ১৯ কেজি থেকে নেমে ১০.৫ কেজিতে দাঁড়িয়েছে। আগে শিশুটি সুস্থ ছিল, কোনো রোগ ছিল না। তিনি বলেন, ‘শুধু দুর্ভিক্ষের কারণেই এই অবস্থা। শিশুটির খাওয়ার কিছুই নেই। কোনো সবজি নেই, ফল নেই। এখন লামিয়ার পায়ে ফোলা, চুল পড়া এবং স্নায়ুর সমস্যা দেখা দিয়েছে। ও হাঁটতে পারে না। আমি অনেক ক্লিনিক, ডাক্তার, হাসপাতাল ঘুরেছি। সবাই বলেছে আমার মেয়ে অপুষ্টিতে ভুগছে, কিন্তু কেউ কোনো চিকিৎসা বা সহায়তা দেয়নি।’
গাজায় ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা ইউকে-মেডে কাজ করা নার্স ম্যান্ডি ব্ল্যাকম্যান জানিয়েছেন, তাদের মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা ৭০ শতাংশ মায়ের ক্লিনিক্যাল অপুষ্টি রয়েছে। এর ফলে নবজাতক শিশুরা ছোট এবং বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় জন্ম নিচ্ছে। গাজা সিটির আরেক বাসিন্দা আসিল জানান, ‘পাঁচ মাস আগে আমার ওজন ছিল ৫৬ কেজি। আজ তা নেমে ৪৬ কেজি।’
তিনি কয়েক মাস ধরে একটি ফল বা মাংসের টুকরাও খাননি এবং বেঁচে থাকার জন্য প্রায় সব সঞ্চয় ব্যয় করেছেন। আসিলের ননদের এক মাস বয়সী একটি সন্তান আছে। আসিল বলেন, ‘শিশুর জন্য সাশ্রয়ী দামে দুধের ফর্মুলা খুঁজে বেড়াচ্ছে। যখন পাই, তখন প্রতিটি ক্যানের দাম ১৮০ শেকেল পর্যন্ত পড়ে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার কোনো খাবারের মজুত নেই, এমনকি এক-দুই সপ্তাহের জন্যও না। হাজার হাজার মানুষের মতো আমরাও দিন গুনে বেঁচে আছি।’ গাজার হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অন্তত ২৭১ জন, যাদের মধ্যে ১১২ জন শিশু, দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টিতে মারা গেছে। ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর হামাস নেতৃত্বাধীন হামলার পর ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে এখন পর্যন্ত গাজায় ৬২,০০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি