দিনের বেলা, লোকচক্ষুর সামনে, ক্যামেরার সামনে, ‘প্রশাসনের নীরবতায়’ ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর লুট হয়ে গেল। আদালতের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে, প্রকাশ্যে হাজারো শ্রমিক ভাড়া করে, সাদা পাথর তুলে নেওয়া হলো। এমন ঘটনা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে— প্রশাসন যখন নিষ্ক্রিয় বা বধির থাকে, তখন অপরাধীরা সাহসী হয়ে ওঠে। এটি রাষ্ট্রের দায়িত্বের অবনমন এবং সামাজিক অরাজকতার জ্বলন্ত উদাহরণ।
রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হলো নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, সুষ্ঠুভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখা। কিন্তু ইতিহাস ও বাস্তবতা ভিন্ন—প্রশাসন যখন জনগণের কথা না শুনে বধির থাকে, রাষ্ট্র তখন দুর্বল হয়, সমাজে অন্যায় সংস্কৃতি জন্ম নিয়ে অপরাধীর দাপট বাড়ে। ‘বধির’ শব্দটি এখানে রূপক অর্থে ব্যবহার করেছি। প্রশাসন যদি জনগণের অভিযোগ না শোনে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নেয়, ক্ষমতাবানদের অপরাধ দেখেও চোখ-কান বন্ধ রাখে, তখন বস্তুতই প্রশাসন বধির।
২০১২ সালে রামু, ২০১৬ সালে নাসিরনগরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, ঘরবাড়ি ও উপাসনালয় পুড়িয়ে দেওয়া—এ রকম অসংখ্য ঘটনার পরও প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আর সাধারণ মানুষ ভয়ে সেঁটিয়ে গিয়ে রাষ্ট্র ও রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ে।
গণ-অভ্যুত্থানের পর এক বছর ধরে আমরা মব লিঞ্চিংয়ের ঘটনা দেখছি।
যেখানে তুচ্ছ অভিযোগে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এটি প্রশাসনের নীরবতার ফল। দখল, সেটা যেভাবেই করা হোক, এমন ঘটনার ক্ষেত্রেও প্রভাবশালী কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তিরা অব্যাহতি পাচ্ছে। প্রশাসন তদন্তে গড়িমসি বা মামলা বন্ধ করে দিচ্ছে। ফলে অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে।
এতে সাধারণ মানুষ আরো নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার ফলে সামাজিক ন্যায়বিচার বিফল হয়ে পড়ছে।
আইন সবার জন্য সমান না হলে তা আর আইন থাকে না। উল্টো শাসকগোষ্ঠীর হাতিয়ার হয়ে পড়ে। প্রশাসনের বধিরতা আইনের প্রয়োগকে পক্ষপাতমূলক করে তোলে। দুর্বলরা শাস্তি পায়, ক্ষমতাবান অপরাধীরা পায় অব্যাহতি। ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজারে ধস, কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার—এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্তদের বেশির ভাগই ছিল পতিত ক্ষমতাসীনসহ তাদের আশ্রয়প্রাপ্ত। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তাদের বাড়িঘর নিলামে ওঠে। ক্ষুদ্র ঋণের দায়ে, ক্ষুধা-পিপাসায় হতদরিদ্র কৃষক, দিনমজুররা আত্মহননের পথ পর্যন্ত বেছে নেয়। এ রকম দ্বিমুখী আইন রাষ্ট্রের ওপর জনগণের আস্থা নষ্ট করে দেয়।
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানও প্রশাসনের এক ধরনের বধিরতার ফল। দীর্ঘদিন ধরে দেশের মানুষ ভোটাধিকার ফেরত পাওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু প্রশাসন ওই দাবির প্রতি অবহেলা করেছে। মন দিয়ে জনগণের ন্যায্য দাবির কথা শোনেনি। বিপরীতে দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে। এর ফলে দেশজুড়ে গণ-অসন্তোষ গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। প্রশাসনের বধিরতা রাষ্ট্রকে অচল করে দেয়।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রশাসনের মৌলিক দায়িত্ব। কিন্তু প্রশাসন যদি জনগণের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে রাস্তায় দাঁড়ানোকে দমন করে, গুলি চালিয়ে হত্যা করে, শান্তিপূর্ণ মত প্রকাশের দায়ে জেলে পাঠায়—তাহলে জনগণ কার ওপর ভরসা রাখবে?
বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে, ১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জনগণের দাবির প্রতি অবহেলা করায় জনগণ নিজেই নতুন পথ খুঁজে নিয়েছে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণই রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। আর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনগণের সেবক। কিন্তু বাংলাদেশে বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে প্রশাসন বা আমলারা সেবক হওয়ার পরিবর্তে শাসক হয়ে ওঠেন। সরকারের কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয় জনগণের করের টাকায়। তাঁরা জনগণকে সেবা দিতে নিযুক্ত হন। প্রশিক্ষণে আমলাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ শেখানো উচিত, যাতে তাঁরা জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করেন।
দক্ষ প্রশাসন ছাড়া গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষ প্রশাসন অপরিহার্য। পক্ষপাত ও দুর্নীতি গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষা প্রশাসনের মূল বিষয়। মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে নিরপেক্ষ প্রশাসনের বিকল্প নেই।
গণতন্ত্র ও সুশাসনের মূল ভিত্তি হচ্ছে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার। দুর্নীতিবাজ প্রশাসন শাসকের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে বলে জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। নির্বাচনে কারচুপি, তথ্য গোপন, বিরোধী মত দমন স্বৈরাচারের জন্ম দেয়। আইনের শাসন দুর্বল হলে শাসক অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। দুর্নীতিবাজ প্রশাসন বিচারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে বিরোধী কণ্ঠ, ভিন্ন মত প্রকাশ দমন করে। এসবই ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য।
জনবিচ্ছিন্ন প্রশাসন রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করে তা ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করে বলে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ে। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি লোপ পায়। স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী বিরোধী মত দমনে দুর্নীতিবাজ প্রশাসন ব্যবহার করে। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র কায়েম করে—যার প্রমাণ শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য প্রশাসনকে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ করা। প্রশাসনকে জনগণের কণ্ঠ, শব্দ, মত শুনতে হবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে, অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। না হলে রাষ্ট্র আবারও অপরাধীদের কবজায় চলে যাবে।
যদি প্রশাসন গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে, নাগরিক সেবা নিশ্চিত করে, সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করে, তাহলে সেখানে সুশাসন, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবেই।
লেখক : যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ