আম্মানে বিষ প্রয়োগে মেশালকে হত্যাচেষ্টা, মোসাদের ব্যর্থতায় ফাঁদে পড়ে ইসরায়েল

মুহাম্মাদ জাহিদুল ইসলাম
  ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:২৭


১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে ঘটে যায় এক রোমহর্ষ গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনা। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের নেতা খালেদ মেশালকে নীরবে হত্যা করতে ছয় এজেন্টের একটি বিশেষ দল আম্মানে পাঠায়। কিন্তু এই হত্যা পরিকল্পনা শেষ মুহূর্তে ভেস্তে যায়, আটক হয় দুই এজেন্ট। এটি ছিল মোসাদের সবচেয়ে শোচনীয় ব্যর্থ অভিযান।
ওই ঘটনা খালেদ মেশালের রাজনৈতিক জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছিল। জর্ডানের তৎকালীন বাদশাহ হোসেনের জন্য এ ঘটনা ছিল বড় কূটনৈতিক বিজয়। অন্যদিকে ইসরায়েলকে এই ব্যর্থতার চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। খালেদ মেশালকে কেন হত্যা করতে চেয়েছিল ইসরায়েল আর কেনই–বা ব্যর্থ হয়েছিল সেই অভিযান? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফিরে দেখা যাক ২৮ বছর আগে।
প্রতিশোধের ডাক
১৯৯৭ সালের জুলাইয়ে ইসরায়েলের জেরুজালেমের একটি বিপণিবিতানে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায় হামাস। নিহত হয় ১৬ জন ইসরায়েলি, আহত হয় অন্তত ১৭০ জন। এ হামলার প্রতিশোধ নিতে জরুরি নিরাপত্তা বৈঠক ডাকেন ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ওই বৈঠকে মোসাদসহ দেশটির অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে হামাসের একজন শীর্ষ নেতাকে হত্যার ব্যাপারে সবাই একমত হন। কিন্তু কাকে হত্যা করা হবে, তা নিয়ে দ্বিধা তৈরি হয়। 
কিন্তু ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানান, আবু মারজুক যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী। তাঁকে হত্যা করলে মার্কিন প্রশাসনের চাপের মুখে পড়তে হতে পারে। এমন পরিস্থিতি হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান খালেদ মেশালকে হত্যার প্রস্তাব দেন মোসাদের তৎকালীন পরিচালক ড্যানি ইয়াতোম। সেই প্রস্তাব অনুমোদন করেন জায়নবাদী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু।
খালেদ মেশাল জর্ডানের রাজধানী আম্মান থেকে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। আর এটিই তাঁকে হত্যার ক্ষেত্রে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াল।
খালেদ মেশালকে হত্যাচেষ্টার তিন বছর আগে ১৯৯৪ সালে জর্ডানের সঙ্গে ইসরায়েলের একটি শান্তি চুক্তি হয়। এ চুক্তিতে দুই দেশ একে অন্যের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল।
জর্ডানে অনুপ্রবেশ করে খালেদ মেশালকে হত্যা করলে চুক্তিটি হুমকির মুখে পড়তে পারে—এমন আশঙ্কা থেকে শুরুতে খালেদ মেশালের ওপর শুধু নজরদারির নির্দেশ দেন নেতানিয়াহু।
খালিদকে হত্যার অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন মোসাদের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মিশকা বেন ডেভিড। তিনি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘শুরুতে আমাদের আম্মানে গিয়ে শহরটি সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে এবং হামাসের কার্যক্রমের ওপর নজর রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।’
খালেদ মেশাল জর্ডানের রাজধানী আম্মান থেকে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। আর এটিই তাঁকে হত্যার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াল।
কিন্তু ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলে আরেকটি আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায় হামাস। এতে নিহত হন প্রায় আট ইসরায়েলি, আহত হন অনেকে। এ হামলার পর আর কালক্ষেপণ করলেন না নেতানিয়াহু। অবিলম্বে জর্ডানে ঢুকে খালেদ মেশালকে হত্যার নির্দেশ দেন তিনি। তবে শর্ত হলো, হত্যার অভিযান এতটাই সতর্কতার সঙ্গে পরিচালিত করতে হবে, যাতে জর্ডান ঘুণাক্ষরেও তা টের না পায় এবং দেশটির সঙ্গে কোনো কূটনৈতিক–সংকট সৃষ্টি না নয়।
হামলার পরিকল্পনা ঠিক করতে শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন মোসাদপ্রধান ড্যানি ইয়াতোম। সেখানে সিদ্ধান্ত হলো, মিশালকে হত্যার কথিত অভিযানে ছয়জন এজেন্ট অংশ নেবেন। এতে কোনো ধরনের বোমা কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। একেবারে গোপনে, নীরবে ও কোনো চিহ্ন না রেখে খালিদকে হত্যা করা হবে।
হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নীরবেই জর্ডান থেকে ইসরায়েলে ফিরে আসবেন মোসাদ এজেন্টরা। এই হত্যাকাণ্ডে একমাত্র অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে বিশেষ একধরনের মারাত্মক বিষ। এটি তৈরি করা হবে মোসাদেরই নিজস্ব ল্যাবে।
এই বিষ কারও শরীরে নিক্ষেপ করা হলে আক্রান্ত ব্যক্তি শুরুতে কিছুই টের পাবেন না। তবে ধীরে ধীরে এটি তাঁর মস্তিষ্কে অক্সিজেন চলাচল বন্ধ করে দেবে এবং তিনি কোমায় চলে যাবেন। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর মৃত্যু হবে। ফলে এটিকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই মনে হবে।
আম্মানে ছয় মোসাদ এজেন্ট
১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে মোসাদের ছয়জন এজেন্ট বিভিন্ন বিমানবন্দর দিয়ে জর্ডানে প্রবেশ করেন। এর মধ্যে দুজন নিজেদের কানাডার নাগরিক বলে পরিচয় দেন। এরপর তাঁরা সবাই একটি হোটেলে মিলিত হন। শেষবারের মতো পরীক্ষা করে নেন সঙ্গে করে নিয়ে আসা নীরব ঘাতক বিষের বোতল।
মজার ব্যাপার হলো, মোসাদের দলটিতে একজন নারীও ছিলেন। তাঁর কাছেও ছিল তরল ভর্তি একটি বোতল। তবে সেখানে বিষ নয়, বরং ছিল বিষের প্রতিষেধক বা অ্যান্টিডোট।
সঙ্গে করে এই প্রতিষেধক নিয়ে আসার বিষয়টি অবাক করলেও এর পেছনে ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। খালেদ মেশালের গায়ে বিষ স্প্রে করার সময় দুর্ঘটনাবশত মোসাদ এজেন্টের গায়ে ওই বিষ এসে পড়লে, তাঁকে বাঁচানোর জন্য ব্যবহার করা হবে এটি। আর সেই কাজটি করবেন ওই নারী এজেন্ট।
আম্মানে পৌঁছানোর পর খালেদ মেশালের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে শুরু করেন মোসাদের এজেন্টরা। এরপর টানা ছয় দিন ধরে তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিবারই নানা কারণে সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। অবশেষে ২৫ সেপ্টেম্বর খালেদ মেশালকে হাতের নাগালে পেয়ে যান মোসাদের এজেন্টরা।
কী ঘটেছিল ২৫ সেপ্টেম্বর
অন্যান্য দিনের মতো সেদিন সকালেও অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেন খালেদ মেশাল। গাড়ি চালাচ্ছিলেন তাঁর দেহরক্ষী আবু মাহের। সঙ্গে ছিল খালিদের তিন ছেলে। গাড়ি চালানোর একপর্যায়ে আবু মাহেরের কাছে মনে হলো, একটি গাড়ি সম্ভবত পেছন থেকে তাদের অনুসরণ করছে। পরে অবশ্য গাড়িটি তাদের অতিক্রম করে চলে যাওয়ায়, তিনি বিষয়টি নিয়ে আর মাথা ঘামাননি।
সকাল ১০টার দিকে খালেদ মেশালর গাড়িটি আম্মানের আল–শামিয়া স্ট্রিটের একটি বিপণিবিতানের সামনে এসে থামে। ওই বিপণিবিতানেই হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর অফিস। গাড়ি থেকে নামার আগে বিপণিবিতানের লনে কালো চশমা পরা দুই ব্যক্তিকে দেখে সন্দেহ হয় খালিদের।
তৎক্ষণাৎ বিষয়টি খালেদ মেশাল দেহরক্ষী আবু মাহেরকেও জানান। এ সময় খালেদ মেশাল গাড়ি থেকে নামবেন কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান। পরে অবশ্য মন থেকে এ সন্দেহ উড়িয়ে দিয়ে তিনি গাড়ি থেকে বের হয়ে অফিসের দিকে হাঁটতে শুরু করেন।
অন্যান্য দিনের মতো সেদিন সকালেও অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেন খালেদ মেশাল। গাড়ি চালাচ্ছিলেন তাঁর দেহরক্ষী আবু মাহের। সঙ্গে ছিল খালিদের তিন ছেলে। গাড়ি চালানোর একপর্যায়ে আবু মাহেরের কাছে মনে হলো, একটি গাড়ি সম্ভবত পেছন থেকে তাদের অনুসরণ করছে। পরে অবশ্য গাড়িটি তাদের অতিক্রম করে চলে যাওয়ায়, তিনি বিষয়টি নিয়ে আর মাথা ঘামাননি।
পরে আল–জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে খালেদ মেশাল বলেন, তাঁরা যখন ভবনটির সিঁড়ির কাছাকাছি পৌঁছলেন, তখন ওই দুই ব্যক্তির সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব ছিল মাত্র তিন মিটার।
আবু মাহের বলেন, ওই দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন পেছন থেকে এসে আমার বাঁ কাঁধের ওপর দিয়ে খালেদ মেশালের দিকে হাত বাড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝটকায় ধাক্কা দিয়ে আমি তাঁর হাতটি সরিয়ে দিই। তাঁর হাতে ব্যান্ডেজ করা ছিল এবং সেটির ভেতরেই হামলার যন্ত্রটি লুকোনো ছিল।
মোসাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, যন্ত্রটি দিয়ে ওই বিষ স্প্রে করার কথা ছিল খালেদ মেশালের ঘাড়ে। কিন্তু আবু মাহেরের সঙ্গে ধস্তাধস্তির কারণে বিষ খালিদের কানে গিয়ে লাগে।
খালেদ মেশাল বলেন, ‘আমার বাম কানে বিকট শব্দ হলো। মনে হলো বৈদ্যুতিক শকের মতো পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝতে পারলেন, এটি হত্যাচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। তবে নিজেকে সামলে নেওয়ার পর বুঝলেন, তাঁকে গুলি করা হয়নি কিংবা বোমা হামলাও হয়নি।
ধাওয়া দিয়ে দুই এজেন্টকে আটক
এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন খালেদ মেশালের আরেক দেহরক্ষী আবু সাইফ। তিনি হামলার এ ঘটনা দেখে সঙ্গে সঙ্গে ওই দুই ব্যক্তিকে ধাওয়া করেন। ঘটনাস্থল থেকে এক শ মিটার দূরে আগে থেকেই মোসাদের ওই দুই এজেন্টের জন্য একটি গাড়ি অপেক্ষা করছিল। তাঁরা দ্রুত সেটিতে উঠে সটকে পড়েন।

আবু সাইফও হাল ছাড়ার পাত্র নন। রাস্তায় অপরিচিত একটি গাড়ি থামিয়ে তিনি ওই দুই ব্যক্তির পিছু নেন।

তাঁদের অনুসরণ করা হতে পারে—এমন আশঙ্কায় মোসাদের ওই এজেন্ট আল–মদিনা স্ট্রিটে গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। এ সময় তাঁরা আবু সাইফকে দেখে ভড়কে যান এবং পালানোর চেষ্টা করেন।
আবু সাইফ তাঁদের ধাওয়া করে একপর্যায়ে ধরে ফেলতে সক্ষম হন। এ সময় তাদের মধ্যে ব্যাপক ধস্তাধস্তি হয়। ততক্ষণে সেখানে একটি বড়সড় ভিড় জমে যায়। পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন প্যালেস্টাইন লিবারেশন আর্মির কর্মকর্তা সাদ আল খতিব। তিনি ভিড় দেখে এগিয়ে যান।
সাদ আল খতিবকে দেখে এ সময় আবু সাইফ চিৎকার করে বলেন, তাঁরা মোসাদ এজেন্ট। খালেদ মেশালকে হত্যার চেষ্টা করেছেন।
আবু সাইফের কথা শুনে সাদ আল খতিব সাহায্যের হাত বাড়ান। ওই দুই এজেন্টকে আটক করে তাঁরা পুলিশের হাতে তুলে দেন।
প্রতিষেধক হস্তান্তর
হামলার প্রায় ঘণ্টাখানেক পর অসুস্থ হয়ে পড়েন খালেদ মেশাল। তিনি বলেন, এ সময় তাঁর শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন বোধ করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি হতে থাকলে তাঁকে আম্মানের ইসলামিক হাসপাতালে নেওয়া হয়।
এর মধ্যে মোসাদের দুই এজেন্ট গ্রেপ্তার হওয়ার পরই হামাস আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপির জর্ডানের তৎকালীন ব্যুরোপ্রধান রন্ডা হাবিবকে ঘটনাটি জানান। হামাসের বরাতে তিনি এ খবর প্রকাশ করলে হইচই পড়ে যায়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়ে পুরো আম্মান শহরে।
তবে জর্ডান সরকার শুরুতে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, খালেদ মেশালকে হত্যাচেষ্টার মতো কোনো ঘটনাই ঘটেনি। কানাডার দুই নাগরিকের সঙ্গে তাঁর সামান্য কথা-কাটাকাটি হয়েছে।

ততক্ষণে মোসাদের সদর দপ্তরে অভিযান ব্যর্থ হওয়ার খবর পৌঁছে গেছে। সংস্থাটির পরিচালক ড্যানি ইয়াতোম খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা নেতানিয়াহুকে জানান। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে তাঁর।
পরিস্থিতি সামাল দিতে নেতানিয়াহু মোসাদের প্রধান ইয়াতোমকে তখনই জর্ডানে যেতে বলেন। দেশটির বাদশাহ হোসেন আল তালালকে সবকিছু খুলে বলার নির্দেশ দেন তিনি।
ড্যানি ইয়াতোম আম্মানে পৌঁছানোর পর জর্ডান সরকারের টনক নড়ে। তখন তাঁরা বুঝতে পারে, হত্যাচেষ্টার খবর নিশ্চয়ই ভিত্তিহীন নয়। ইয়াতোম বাদশাহ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানান, মোসাদই খালেদ মেশালকে হত্যার চেষ্টা করেছে। আটক দুজন তাদেরই এজেন্ট।
ইয়াতোম আরও বলেন, জর্ডানের সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো সমস্যা নেই। মূলত হামাসের উদ্দেশে এ হামলা হয়েছে। ইয়াতোমের কথা শুনে ক্ষেপে যান বাদশাহ। তিনি দ্রুত বিষের প্রতিষেধক এবং বিষের বিস্তারিত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার দাবি জানান।
বাদশাহ হোসেন বলেন, খালেদ মেশাল মারা গেলে তাঁর সঙ্গে জর্ডান-ইসরায়েল শান্তিচুক্তিরও মৃত্যু হবে। পাশাপাশি আটক দুই মোসাদ এজেন্টকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।
ওই দিন সন্ধ্যায় উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদ মেশালকে কিং হোসেন মেডিকেল সিটিতে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন বাদশাহ। ওই হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি কোমায় চলে যান।

ঠিক একই সময় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে ফোন করে ঘটনা জানান বাদশাহ হোসেন। তিনি ওয়াশিংটনের মাধ্যমে তেল-আবিবকে চাপ দেন, যেন ইসরায়েল অবিলম্বে হত্যাচেষ্টার দায় স্বীকার করে এবং খালিদের জীবন বাঁচানোর জন্য প্রতিষেধক পাঠায়।
‘আমার বাম কানে বিকট শব্দ হলো। মনে হলো বৈদ্যুতিক শকের মতো পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল।’
খালেদ মেশাল, হামাস নেতা
অন্যদিকে জর্ডানের আকাশে উত্তেজনার পারদ যখন ভারী হচ্ছিল, তখন বাদশাহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ইসরায়েলি দূতাবাস ঘেরাও করার নির্দেশ দেন। ধারণা করা হচ্ছিল, অভিযানে অংশ নেওয়া মোসাদের অন্য এজেন্টেরা দূতাবাসের ভেতরেই অবস্থান করছিলেন।
জর্ডান সরকার ২৭ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতের মধ্যে বিষের প্রতিষেধক সরবরাহ করতে ইসরায়েলকে আলটিমেটাম দেয়। তা না হলে দূতাবাসেও হামলার হুমকি দেওয়া হয়।
অবশেষে নানামুখী তীব্র চাপে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রতিষেধক সরবরাহে রাজি হন। মোসাদের একটি বিশেষ দল গোপনে ওই হাসপাতালে গিয়ে প্রতিষেধক হস্তান্তর করে। প্রতিষেধক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খালেদ মেশালের জ্ঞান ফিরে, তিনি চোখ খোলেন।
হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ইয়াসিনের মুক্তি ও বন্দিবিনিময়
খালেদ মেশাল বেঁচে যাওয়ার পর এবার মোসাদের দুই এজেন্টকে মুক্তির এবং দূতাবাস থেকে অবরোধ উঠিয়ে নেওয়ার দাবি জানায় ইসরায়েল। কিন্তু বাদশাহ হোসেন এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন।
মোসাদের দুই এজেন্টকে বিনিময়ে ইসরায়েলে দীর্ঘদিন ধরে বন্দী ফিলিস্তিনের আধ্যাত্মিক নেতা ও হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে কারাগার থেকে মুক্তির শর্ত দেন। পাশাপাশি ফিলিস্তিন ও জর্ডানের আরও ৫০ বন্দীকে ছেড়ে দিতে হবে বলেও জানান। শুরুতে এই শর্তে নারাজ থাকলেও দীর্ঘ দর-কষাকষির পর তা মানতে রাজি হয় ইসরায়েল।
১৯৯৭ সালের ১ অক্টোবর শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে নিয়ে একটি হেলিকপ্টার কিং হোসেন মেডিকেল সিটিতে অবতরণ করে। এর কয়েক দিন পর মোসাদ এজেন্টদের নিয়ে গোপনে অন্য একটি হেলিকপ্টার ইসরায়েলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
এ ঘটনার কিছুদিন পর ইসরায়েল ফিলিস্তিন ও জর্ডানের আরও ৫০ বন্দীকে মুক্তি দেয়। তাদেরও পাঠানো হয় হেলিকপ্টারযোগে। এ কারণেই ঘটনাটি ইতিহাসে ‘হেলিকপ্টার ডিপ্লোমেসি’ নামে পরিচিত।
নেতানিয়াহুর জন্য বড় ধাক্কা
এই অভিযানের ব্যর্থতা ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য ছিল বিরাট কূটনৈতিক ধাক্কা। শান্তি চুক্তি থাকা সত্ত্বেও প্রতিবেশী জর্ডানে গুপ্তহত্যার চেষ্টা চালানোয় আন্তর্জাতিক মহলে ইসরায়েলের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও প্রকাশ্যে নেতানিয়াহুর সমালোচনা করেন। এ ঘটনার প্রভাব পড়ে ১৯৯৯ সালে অনুষ্ঠিত ইসরায়েলের জাতীয় নির্বাচনেও। এতে নেতানিয়াহু পরাজিত হন এবং সাময়িকভাবে রাজনীতি থেকে অবসর নেন।
অন্যদিকে খালেদ মেশালর হত্যাচেষ্টার অভিযান শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হওয়ায় মোসাদের ভাবমূর্তিও সংকটে পড়ে। সংস্থাটির প্রধান ড্যানি ইয়াতোম ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে ১৯৯৮ সালে পদত্যাগ করেন।
খালেদ মেশালের উত্থান
এই ঘটনা খালেদ মেশালর জন্য রাজনৈতিক আশীর্বাদে পরিণত হয়। হামাসের ভেতরে তাঁর অবস্থান আরও দৃঢ় হয়। আরব বিশ্বে তাঁর জনপ্রিয়তা হঠাৎ করেই আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। খালেদ মেশাল হয়ে ওঠেন ইসরায়েলবিরোধী প্রতিরোধের প্রতীক। পরবর্তী বছরগুলোয় হামাসের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তিনি প্রধান ভূমিকা রাখেন।
বাদশাহ হোসেনের কূটনৈতিক জয়
এই সংকট দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়ে জর্ডানের বাদশাহ হোসেন এক বিরাট কূটনৈতিক বিজয় অর্জন করেন। একদিকে ইসরায়েলের কাছ থেকে শেখ ইয়াসিনের মুক্তি নিশ্চিত করেন, অন্যদিকে নিজের দেশের শান্তিচুক্তিও রক্ষা করেন।
ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় মুসলিম বিশ্ব বাদশাহ হোসেনকে অবিশ্বাসের চোখে দেখত। কিন্তু এ ঘটনার পর তিনি তাদের বিশ্বাসও অর্জন করতে সক্ষম হন।
তথ্যসূত্র: (আল–জাজিরা, বিবিসি, মিডল ইস্ট মনিটর)
সূত্র: প্রথম আলো