ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রায় নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর প্রশ্ন উঠেছে, এই যে অভাবিত বিজয় ঘটল, তা কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থী দলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আগাম সংকেত? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দেশের বা সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ, তাঁরাই যদি ধর্মভিত্তিক পতাকার নিচে সমবেত হন, তাহলে দেশজুড়ে এর প্রভাব পড়বে, সেটাই তো স্বাভাবিক।
তবে আমরা অনেকেই জানি, ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শিবির–সমর্থিত প্রতিনিধিদের বিজয় শুধু ধর্মীয় আদর্শ বা নীতিবোধ দ্বারা নির্ধারিত হয়নি। এই ভোট আসলে ‘স্ট্যাটাস কো’ বা স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে।
দীর্ঘদিন ধরে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের রাজনৈতিক অভিভাবকদের ছত্রচ্ছায়ায় একবার ছাত্রলীগ, একবার ছাত্রদল ক্ষমতা দখল করে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। হল দখল থেকে চাঁদাবাজি, এমন কোনো দুষ্কর্ম নেই, যা তারা বছরের পর বছর করেনি।
কেউ কেউ এমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সাধারণ ছাত্ররা এর আগের সুবিধাভোগী এই দুই দলকেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর ফলে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, আপাতত সেই স্থান পূরণ করেছে শিবির। ছাত্রলীগ-ছাত্রদল যখন লুটপাটে ব্যস্ত, শিবিরের নেতা-কর্মীরা তখন তাঁদের ‘সমাজসেবামূলক কাজ’ করেছেন। শিবিরের ভূমিধস বিজয়ের এটাই প্রধান কারণ।
কিন্তু এই ব্যাখ্যা সম্ভবত কিছুটা সরলীকৃত। শিবির যে একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন, এ কথা সারা দেশের মানুষ জানে, অথচ দেশের সবচেয়ে প্রাগ্রসর নাগরিকেরা জানবেন না, সে কথা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
বস্তুত শিবিরের ইসলামি চরিত্র ও চেহারা সম্বন্ধে পুরোপুরি জেনেশুনেই তাঁরা সে দলের বাক্সে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু কেন?
একটি সম্ভাব্য কারণ, এসব ছাত্র-ছাত্রীর অধিকাংশ শিবিরের ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন, জীবনচারিতায় সে মূল্যবোধের দৈনন্দিন প্রকাশ থাকুক বা না থাকুক। অন্য বৃহত্তর কারণটা হলো লিবারেল বা ‘উদারনৈতিক’ রাজনীতির ব্যর্থতা।
উদারনৈতিক রাজনীতির ব্যর্থতা
বাংলাদেশে গত পাঁচ দশক আমরা সরকারিভাবে যে রাজনৈতিক আদর্শের চর্চা করেছি, তার মূল সুর ছিল উদারনৈতিক বা লিবারেল। সেক্যুলারিজম বা ধর্ম-নিরপেক্ষতা এই মত-পথের একটি প্রধান লক্ষণ। যে প্রতিশ্রুতি উদারনৈতিক ব্যবস্থায় নিহিত ছিল, সে প্রতিশ্রুতি অর্জিত হয়নি। অসাম্প্রদায়িকতা, যার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিযুক্তিতে, তা আমাদের আত্মিক চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়নি।
এই ব্যর্থতাজনিত প্রত্যাখ্যান থেকেই ছাত্র–ছাত্রীরা এবং সম্ভবত দেশের এক বড় অংশ ক্রমান্বয়ে ধর্মনির্ভর দক্ষিণমুখী রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকেছে। উদারনৈতিক সংস্কৃতির এই ব্যর্থতা শুধু বাংলাদেশেই নয়, প্রতিবেশী ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই লক্ষ করা গেছে।
প্রথমে ভাবা যাক, উদারনৈতিক বা লিবারেল রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলতে কী বোঝায়? সোজা বাংলায়, এটা এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তির অধিকার ও স্বাধীনতার পূর্ণ নিশ্চয়তা রয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান, যেখানে রয়েছে ব্যক্তির ভোটাধিকার এবং আইনের সামনে সবার সমান মর্যাদা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’—এর যে নীতি ঘোষিত হয়েছিল, তাকে আমরা উদারনৈতিক বন্দোবস্তের নীতিমালা বলে ভেবে নিতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে যে চার নীতি ঘোষিত হয়, তা প্রচলিত লিবারেলিজম থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র। তবে এর ভিত্তি যে ব্যক্তিস্বাধীনতাকেন্দ্রিক উদারনৈতিক বন্দোবস্ত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এই বন্দোবস্ত চমৎকার। কিন্তু বাস্তবে এর পেছনে যে প্রতিশ্রুতি ছিল, বাংলাদেশে তা কখনোই পূর্ণতা পায়নি। সমতার বদলে আমরা পেয়েছি তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য। গণতন্ত্রের বদলে পেয়েছি প্রতিনিধিত্বহীন একদলীয় (কখনো কখনো এক ব্যক্তি ও এক পরিবারকেন্দ্রিক) দুঃশাসন। সামাজিক ন্যায়বিচারের বদলে পেয়েছি পাহাড়-সমান দুর্নীতি। অন্যদের মতো ছাত্র-যুবকেরাও এই ব্যবস্থায় প্রতারিত হয়েছেন। অনূর্ধ্ব ২৫, এমন যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ১৫ শতাংশ।
রাষ্ট্র ও ধর্মের বিযুক্তি
পশ্চিমাদের কাছ থেকে ধার করা এই বন্দোবস্তে ধর্ম ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে আলাদা রাখার কথা ভাবা হয়েছে। লক্ষ্য হিসেবে এই নীতি যত প্রশংসনীয় হোক না কেন, বাংলাদেশের মতো কৃষিভিত্তিক ও স্বল্প শিক্ষিত দেশে, যেখানে পারিবারিক ও সম্প্রদায়গত সংস্কৃতির একদম কেন্দ্রে রয়েছে ধর্মভিত্তিক লোকাচার, সেখানে এই ‘সেক্যুলার’ব্যবস্থা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়, সে কথা অন্য সবার আগে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা বুঝতে পেরেছিলেন।
ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে তাদের প্রয়োজন রাজনৈতিক বৈধতা, যা অর্জনের সহজ পথ ধর্মের লেবাস আঁকড়ে ধরা। বাংলাদেশে স্বাধীনতার গোড়া থেকেই প্রতিটি শাসকগোষ্ঠী নিজেদের বৈধতা পোক্ত করতে ইসলামের দিকে হাত বাড়িয়েছে। এখন যাকে আমরা ক্রমঃইসলামিকরণ বা ‘ক্রিপিং ইসলামাইজেশন’ বলছি, তার গোড়ায় রয়েছে বৈধতা অর্জনের এই প্রতিযোগিতা।
মনে করে দেখুন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে প্রথম সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব আয়োজিত হয়েছে, রেডিও-টিভিতে ইসলামিক ভাষার ব্যবহার চালু হয়েছে। অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি পাকিস্তানসহ বিভিন্ন ইসলামিক দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন।
জিয়াউর রহমান ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যাবর্তন ত্বরান্বিত হয়। জেনারেল এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন।
সবাইকে টেক্কা দেন শেখ হাসিনা, তিনি সারা দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার সম্প্রসারণের পাশাপাশি সে শিক্ষার সার্বিক স্বীকৃতি প্রদান করেন। তাঁর সময়েই মাদ্রাসা শিক্ষা খাতে সর্বাধিক বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা হয়। তিনি ইমাম ভাতা চালু করেন ও দেশজুড়ে সরকারি মসজিদের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। এক হিসাবে দেখছি, হাসিনার আমলে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সময়কালে, বাংলাদেশের সরকারি স্কুল থেকে ১০ লাখ ছাত্র-ছাত্রী স্কুল ছেড়েছে। অথচ মাদ্রাসাব্যবস্থায় অতিরিক্ত ২ লাখ ৫০ হাজার নতুন ছাত্র–ছাত্রী যুক্ত হয়েছে।
অন্য কথায়, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা প্রদানে বিগত প্রতিটি সরকার কমবেশি ভূমিকা পালন করেছে। ধর্মীয় রাজনীতিকদের চাপের মুখে স্কুলপর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে ক্রমেই অনৈসলামিক বলে বিবেচিত পাঠ বাদ দেওয়ার ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ধর্মের ব্যাপারে রক্ষণশীল মনোভাবের জন্ম খুবই স্বাভাবিক ছিল।
আজ যাঁরা ডাকসু ও জাকসুতে শিবিরের ব্যানারে জয়লাভ করেছেন, তাঁদের অনেকেই নতুন মাদ্রাসাব্যবস্থা থেকে এসেছেন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতি তাঁদের আগ্রহ ও আনুগত্য খুবই স্বাভাবিক। বস্তুত, গত পাঁচ দশকে যে ধর্মের বীজ বপন করা হয়েছে, তাঁরা তারই ফসল। তো, ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগরে শিবিরের ঝান্ডা উড়বে, এতে অবাক হওয়ার এমন কী আছে!
উদারপন্থার বিশ্বব্যাপী সংকট
শুধু বাংলাদেশ বা প্রতিবেশী ভারতে নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ দেশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সময় থেকে গড়ে ওঠা উদারনৈতিক বন্দোবস্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। মাথাচাড়া দিচ্ছে পরিবার, ধর্ম ও আইডেনটিটি বা আত্মপরিচয়নির্ভর উত্তর-উদারনৈতিকবাদ (পোস্ট-লিবারেলিজম)।
যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়ো মেলোনি বা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এই নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রবক্তা। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ও হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ওরবান তো প্রকাশ্যেই নিজেদের উদার নৈতিকতাবিরোধী বা ‘ইল-লিবারেল’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
তাঁরা সবাই মনে করেন, ব্যক্তিস্বাধীনতাকেন্দ্রিক পুরোনো উদার নৈতিকতাবাদের মৃত্যু হয়েছে। এখন আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই ব্যবস্থায় যেখানে, পরিবার, ধর্ম ও সম্প্রদায় হবে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আত্মপরিচয়ের প্রকৃত অনুঘটক।
বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও এই মতের সমর্থকের অভাব নেই। মার্কিন অধ্যাপক প্যাট্রিক ডেনিন মনে করেন, লিবারেলিজম কমিউনিটি ও ঐতিহ্যিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।
ব্রিটিশ পণ্ডিত জন মিলব্যাঙ্ক মনে করেন রাজনীতির কেন্দ্রে ধর্মকে অন্তর্ভুক্ত করলে বিশ্বজুড়ে বর্তমানে যে মূল্যবোধের দুর্ভিক্ষ, তা থেকে পরিত্রাণ মিলবে।
ভারতীয় রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী শশী থারুরও মনে করেন, লিবারেলিজমের ব্যর্থতার কারণেই বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটেছে। তিনি নিজেও হিন্দু হিসেবে আত্মপরিচয় দিয়ে গ্রন্থ লিখেছেন, পনেরো-কুড়ি বছর আগেও যা অভাবনীয় ছিল।
ইসলামপন্থী রাজনীতির মাঠ দখল কি অনিবার্য
বাংলাদেশে ধর্ম, সম্প্রদায় ও মসজিদ কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তার একটি স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ দেখি আমাদের সামাজিক সংস্কৃতিতে। জুমায় অংশগ্রহণ অথবা শেষ রাতে সবান্ধব সাহ্রি এখন তরুণদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় অভিজ্ঞতা।
সেক্যুলার বন্দোবস্তে আমরা ধর্মীয়, বিশেষত ইসলামিক প্রতীকগুলোকে এড়িয়ে চলেছি। দাড়ি বা হিজাব আমাদের উপহাসের শিকার হয়েছে। এখন সব বয়সের ছেলেমেয়েরাই নিঃসংকোচে দাড়ি রাখছে বা হিজাব পরছে। ডাকসু-চাকসু নির্বাচনে বিজয়ী ছাত্রনেতাদের অথবা তাঁদের উৎফুল্ল সমর্থকদের দিকে তাকালেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়।
এই রূপান্তর থেকে কি আমরা এ কথা বলতে পারি যে খুব শিগগির বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি মাঠ দখল করবে? আমার নিজের ধারণা, এই উত্তরণ স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেটিক নয়। কিছু কিছু প্রতিরোধক ব্যবস্থা বা ‘রোড বাম্প’ রয়েছে, যা আমাদের রাজনীতির ও সমাজের স্বয়ংক্রিয় ইসলামিক রূপান্তরে ব্যাঘাত ঘটাবে; নিদেনপক্ষে এই রূপান্তরকে বিলম্বিত করবে।
এই প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে রয়েছে অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবী ও এলিট শ্রেণির অব্যাহত প্রভাব, কর্মক্ষেত্রে ও নাগরিক সংস্কৃতিতে নারীর ক্রমঃউত্থিত কণ্ঠস্বর এবং বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর সমন্বিত বা সিনক্রেটিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই রোড বাম্প গত ৫০ বছরে উদারপন্থার অর্জন, চাইলেই তাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে দেশের ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের রণকৌশল বদলাতে হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী ইতিমধ্যে ইঙ্গিত করেছে তারা ভিন্নধর্মের, এমনকি হিন্দুদের নিজ দলে স্বাগত জানাবে ও নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা ও পোশাক-আশাকের স্বাধীনতায় নাক গলাবে না। ডাকসু নির্বাচনে একজন নারী ও একজন পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীর অন্তর্ভুক্তি এই দলের সেই পরিবর্তিত কৌশলেরই প্রমাণ।
জাগরণের অপেক্ষায়
এই মুহূর্তে দেশের রাজনীতির হাল-হকিকত দেখে এ কথা ভাবাই স্বাভাবিক যে দেশ উল্টোপথে চলছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যে চেতনার জন্ম দেয়, এই উল্টোযাত্রা তার পরিপন্থী। মুক্তিযুদ্ধ তার কাঙ্ক্ষিত সুফল সবার ঘরে পৌঁছে দিতে পারেনি বলেই আজকের এই বিপর্যয়। কিন্তু তাই বলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আমাদের নিয়তি হতে পারে না। এই পরিস্থিতি ঠেকাতে প্রয়োজনীয় সংশোধন বা সমন্বয় সাধনের সুযোগ রয়েছে। এই দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীদের। উগ্র ধর্মীয়করণের বিরুদ্ধে নিজেদের ভিন্নমত স্পষ্টভাবে বলতে হবে তাদেরই।
আরেকটা কথা। এত দিন ঠিক-বেঠিকের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার আমরা ছেড়ে দিয়েছি পেশাদার ধর্মীয় গোষ্ঠীর হাতে। ধর্ম প্রশ্নে সেক্যুলার কোনো কণ্ঠস্বর বা প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ করেনি। এখন সময় এসেছে পশ্চাৎপদ দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, এমন লেখক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকদের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
আরও চাই অতি-রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ। যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে বিবর্তনবাদ বাদ দিতে চায়, রবীন্দ্রনাথের গানে পৌত্তলিকতার সন্ধান করে অথবা নারী-পুরুষের পোশাকে নৈতিকতা খোঁজে, তাদের বিরুদ্ধে জোর গলায় আপত্তি জানাতে হবে।
এই কাজ অন্য সবার তুলনায় সবচেয়ে কার্যকরভাবে করতে পারেন সেই ছাত্র-ছাত্রীরা, যাঁদের কেউ কেউ জামায়াত-শিবিরের পক্ষে তাঁদের সমর্থন জানিয়েছেন। আমি তাঁদের সেই জাগরণের অপেক্ষায়।
হাসান ফেরদৌস, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
সূত্র: প্রথম আলো