মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাব কি ঔপনিবেশিকতার প্রত্যাবর্তন

হাসান ফেরদৌস
  ০২ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:৩৭

১৯১৯ সাল। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ, হার হয়েছে তুরস্কের। এত দিন সমগ্র ফিলিস্তিন ছিল তুরস্কের নিয়ন্ত্রণাধীন। যুদ্ধের পর অন্যতম বিজয়ী শক্তি ব্রিটিশ সরকার আবদার করল এই অঞ্চলের দায়িত্বভার তার হাতে ছেড়ে দিতে হবে।
ফিলিস্তিনের মানুষ কী চায়, সে প্রশ্ন বিবেচনা না করেই ভার্সাইয়ের হল অব মিররসে বসে দিন কয়েক কাগজ-কলমে কাটাকুটি করে ঠিক করা হলো, যত দিন না এই অঞ্চলের মানুষ ‘নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে’, তত দিন তা শাসন করার দায়িত্ব থাকবে যুক্তরাজ্যের ওপর।
 ১০০ বছর পর সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। এবারও হাতে গোনা কয়েকজন ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউসে শলাপরামর্শের পর ঠিক করলেন; যত দিন না পরিস্থিতি অনুকূলে আসছে, তত দিন গাজা, যা ফিলিস্তিনের একটুকরা ভূমি, তা শাসনের দায়িত্বে থাকবে একটি আন্তর্জাতিক অন্তর্বর্তী প্রশাসন।
এর নেতৃত্বে থাকবেন সেই যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। সঙ্গে পরিচালনা পর্যদ বা বোর্ডের প্রধান হিসেবে থাকবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলা বাহুল্য, গাজাবাসী কী ভাবেন বা কী চান, তা বিবেচনায় আনার কোনো প্রশ্নই উঠল না।
২৯ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে পাশে নিয়ে সাড়ম্বরে গাজার জন্য এই শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে। তাঁর কথায়, এ হলো শতাব্দীর সেরা ব্যবস্থা বা ‘ডিল’। 
গাজা প্রশ্নে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছেন, তা আগাগোড়া ক্ল্যাসিক ঔপনিবেশিক শাসন চালুর সর্বশেষ উদাহরণ। একদল মানুষ, যাদের ওই ভূখণ্ডের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, শুধু গায়ের জোরে (পড়ুন বোমার জোরে) ২২-২৩ লাখ মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করছে, ‘হয় মেনে নাও, না মানলে গুলি খাও!’

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড  ট্রাম্প গাজা প্রশ্নে যে ২০ দফা শান্তি প্রস্তাব দিয়েছেন, তাতে এই ভূখণ্ডের ভবিষ্যতের যে রূপরেখা দেওয়া হয়েছে, সেখানে গাজাবাসীর যেমন কোনো মতামত জানতে চাওয়া হয়নি, তেমনি অনাগত ভবিষ্যতেও তাদের কেউ এই তথাকথিত অন্তর্বর্তী প্রশাসনে স্থান পাবে না।
গাজা যেন ২২ লাখ মানুষের একটি ভূখণ্ড নয়, একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি, যার মালিকানায় থাকবে একটি নির্বাহী বোর্ড!
প্রশাসনিক কাজে সাহায্যের জন্য বেছে বেছে অরাজনৈতিক ‘টেকনোক্র্যাটিক’ ফিলিস্তিনিদের খুঁজে আনা হবে। নিরাপত্তার জন্য আশপাশের দেশ থেকে ভাড়া করে আনা হবে পুলিশ ও সৈন্য।
বিখ্যাত ব্রিটিশ-ইসরাইয়েলি ঐতিহাসিক ড্যানিয়েল-লেভি মন্তব্য করেছেন, ট্রাম্প গাজার জন্য যে পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছেন, তা পড়ে মনে হয় এটি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির কোনো নথি। লাখ লাখ মানুষের ভাগ্য জড়িত না থাকলে একে এক সেরা ‘কমেডি’ বলা যেত।

পরিকল্পনাটির মুখ্য শর্ত, গাজার কোনো কাজে হামাসকে রাখা যাবে না। তাদের শুধু নিরস্ত্র করতে হবে তা–ই নয়, ভবিষ্যতে কোনো প্রশাসনিক দায়িত্বে তাদের রাখা যাবে না। শান্তি প্রশ্নে তাদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনাও হবে না।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই স্পষ্ট করে বলেছেন, হামাসকে হয় এই প্রস্তাব মেনে নিতে হবে, না হয় তাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। তাদের কীভাবে খতম করতে হয়, নেতানিয়াহু তা খুব ভালো করেই জানেন।
হামাসের ব্যাপারে প্রতিবেশী আরবদের মধ্যে কমবেশি মতৈক্য রয়েছে। মাহমুদ আব্বাসের ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ গাজা থেকে হামাসের বহিষ্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন। আরব লীগও হামাসের নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে। জাতিসংঘে গৃহীত এক প্রস্তাবেও হামাসের নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে সায় দেওয়া হয়েছে।
দুই বছরের টানা যুদ্ধের পর হামাসের তেমন কোন সামরিক শক্তি নেই যে তারা এই প্রশ্নে বাগ্‌বিতণ্ডা করবে। ফলে অনুমান করি, কিছুটা বিলম্বে হলেও হামাস অস্ত্র ত্যাগ ও ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার দাবি মেনে নেবে।
 কিন্তু তারচেয়েও বড় প্রশ্ন রয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা নিয়ে। ফিলিস্তিন সমস্যার কেন্দ্রেই রয়েছে এই জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকারের স্বীকৃতি ও বাস্তবায়ন।
ট্রাম্পের গাজা শান্তি পরিকল্পনায়, অনেকটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের এক ধারা রাখা হয়েছে যাতে স্বাধীন ফিলিস্তিনকে তার ‘জনগণের আকাঙ্ক্ষা’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে; কিন্তু তার বাস্তবায়নের কোনো পথরেখা চিহ্নিত হয়নি।
পরিহাসের বিষয় হলো, ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের যে পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনকে দুই ভাগ করা হয়, তাতে একই সঙ্গে একটি ইহুদি ও একটি আরব (ফিলিস্তিনি) রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছিল।
ইহুদি রাষ্ট্রটি অনেক আগেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে; কিন্তু প্রায় ৮০ বছর পরেও স্বাধীন ফিলিস্তিন সেখানকার জনগণের ‘আকাঙ্ক্ষাই’ রয়ে গেছে।
নেতানিয়াহু বারবার বলেছেন তিনি কোনো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হতে দেবেন না। কোনো কোনো আরব রাষ্ট্র, যেমন সৌদি আরব বলেছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়া কোন শান্তি পরিকল্পনায় তাদের সমর্থন নেই। সে কথা মাথায় রেখে ট্রাম্পের পরিকল্পনায় স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবিটি একদম উড়িয়ে দেওয়া হয়নি।
এতে যে সম্ভাব্য স্বাধীন ফিলিস্তিনের কথা বলা হয়েছে, কবে সে ‘আকাঙ্ক্ষা’ বাস্তবায়িত হবে তার কোনো সময়সীমা নেই। এতে শর্ত দেওয়া হয়েছে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগে পশ্চিম তীরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে ঢেলে সাজাতে হবে।
ঢেলে সাজানো হয়েছে কি না, তার সনদপত্র আসবে এই নতুন ট্রাম্প-ব্লেয়ার বোর্ডের কাছ থেকে। ইসরায়েল ‘হ্যাঁ’ না বলা পর্যন্ত তারা যে এই প্রশ্নে নড়েচড়ে বসবে না তা বলাই বাহুল্য।

বিভিন্ন বেসরকারি আরব ভাষ্যকার ট্রাম্পের এই প্রস্তাবের সমালোচনা করেছেন। যে বোর্ডকে দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে জাতিসংঘের নয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিল রয়েছে, এ কথা বলেছেন আল কুদস আল-আরাবি পত্রিকার এক ভাষ্যকার।
 লেবাননের সাংবাদিক রাশিদা দেরঘাম বলেন, ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে ট্রাম্প গাজাকে কোনো দেউলিয়াপ্রাপ্ত করপোরেশন ঠাউরে এখন তার দেখভালের ব্যবস্থা করছেন।
জর্দানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারওয়ান মুয়াশের আলী বলেন, এটা কোনো শান্তি পরিকল্পনা নয়। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ফিলিস্তিনিদের সব রাজনৈতিক অধিকার অস্বীকার করে তাদের ‘ম্যানেজ’ করার বন্দোবস্ত।
গাজাবাসী ও ফিলিস্তিনিদের ঝুড়ি শূন্য থাকলেও ট্রাম্পের এই প্রস্তাবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তাঁর দাবির প্রায় সব কটিই আদায় করে নিয়েছেন। এত দিন তিনি বলে এসেছেন হামাসের চূড়ান্ত পরাজয় নিশ্চিত না করা পর্যন্ত তিনি হামলা বন্ধ করবেন না। এই পরিকল্পনায় কার্যত তাঁর সেই শর্ত মেনে নেওয়া হয়েছে।
নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে গাজার ব্যাপারে কোনো ভূমিকা দেওয়ার বিরোধিতা করেছেন, এই পরিকল্পনায় সে দাবিও মেনে নেওয়া হয়েছে। গাজায় অনির্দিষ্টকাল ইসরায়েলি সেনা মোতায়েন থাকবে, তাঁর এ দাবিও মেনে নেওয়া হয়েছে।
সোজাকথায়, নিউইয়র্ক টাইমসের ভাষায়, নেতানিয়াহু যা যা দাবি করেছেন, তার সবই এই পরিকল্পনায় নিশ্চিত করা হয়েছে। এ কথা ঠিক, তিনি স্বাধীন ফিলিস্তিনের বিরোধিতা করেছেন। এই পরিকল্পনায় যে স্বাধীন ফিলিস্তিনের কথা বলা হয়েছে, টাইমসের ভাষায়, তা বড়জোর এক সুখকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। কিছুটা পরিহাসের সুরেই ফিলিস্তিনিদের প্রতি টাইমস লিখেছে, ‘ড্রিম  অন’, অর্থাৎ স্বপ্ন দেখতে থাকো। 
এসব সত্বেও গাজায় জাতিহত্যা বন্ধ হবে, শুধু এ কারণেই প্রস্তাবটিকে কেউ কেউ স্বাগত জানিয়েছেন। মিসর ও আরব আমিরাতসহ আটটি আরব দেশ প্রস্তাবটি চূড়ান্তকরণে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সতর্ক সমর্থন জানিয়েছে পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া।
ইতিপূর্বে ট্রাম্প বলেছিলেন, সব গাজাবাসীকে সরিয়ে দিয়ে সেখানে তিনি অত্যাধুনিক পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলবেন। এই পরিকল্পনায় সেই দাবি বাদ গেছে, বলা হয়েছে গাজাবাসীকে কোথাও যেতে হবে না। কেউ যদি চলে গিয়েও থাকে, তারা চাইলে ফিরে আসতে পারবে।

মানতে হবে, গাজায় গণহত্যা বন্ধে কোনো আরব বা ইউরোপীয় দেশ এ পর্যন্ত অর্থপূর্ণ কিছুই করেনি। সেই তুলনায় ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাবে গাজাবাসী কিছুটা হলেও আলোর আভাস পেয়েছেন।

এ কথা ভাবার কারণ রয়েছে যে ট্রাম্পের চাপের কারণেই নেতানিয়াহু এই পরিকল্পনা মেনে নিয়েছেন। দুই সপ্তাহ আগে দোহায় হামাসের এক বৈঠকে বোমা বর্ষণের জন্য কাতারের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন তিনি। সেটিও সম্ভব হয়েছে ট্রাম্পের চাপাচাপিতে।
আমরা জানি, গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠার পুরস্কার হিসেবে ট্রাম্প নিজের জন্য নোবেল পুরস্কার দাবি করেছেন। সত্যি সত্যি যদি গাজায় গণহত্যা থামে, সেখানে শান্তি আসে, হোক না তা কবরের শান্তি, সে জন্য ট্রাম্প যদি সেই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন, তাতে কি আপত্তি করার কেউ থাকবেন?
হাসান ফেরদৌস : সাংবাদিক ও লেখক
মতামত লেখকের নিজস্ব
সূত্র: প্রথম আলো