গত বছর অগাস্টে গণআন্দোলনে পতন হয়েছিল বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের। আর এ বছর সেপ্টেম্বরে একই চিত্র দেখা গেল নেপালে।
বাংলাদেশে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মত এবার নেপালে একইরকম পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি।
হাসিনার মত ওলিও দেশ ছাড়ছেন বলে খবর শোনা যাচ্ছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে, ওলি দুবাই যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, চিকিৎসার জন্য ওলি দুবাই যাচ্ছেন।
জেন-জি আন্দোলনে নেপালের সরকারও পতনের দুয়ারে পৌঁছে গেছে। একের পর এক মন্ত্রী পদত্যাগ করছেন। সরকারি বাসভবন, পার্লামেন্টে ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও চলছে।
অবস্থা বেগতিক বুঝেই হয়ত দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছেন কেপি শর্মা ওলি। এ যেন গত বছরের বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশে ছাত্র-যুবাদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। পরে তা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
দুই ক্ষেত্রেই সরকার পতনের ভিত তৈরি হয়েছে তরুণ-যুবা ও শিক্ষার্থীদের দাবিকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ থেকে। আর নেপালে সোশাল মিডিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারির পর রাস্তায় নেমে আসে জেন-জি, অর্থাৎ ‘জেনারেশন জেড’।
দুই বছরে দুটি দেশে গণআন্দোলন শাসনক্ষমতায় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বাংলাদেশ ও নেপালের গণআন্দোলন কোনদিক থেকে এক, কী কী মিল আছে, এক প্রতিবেদনে তা বিশ্লেষণ করেছে এনডিটিভি।
এক বিপ্লব থেকে আরেক বিপ্লবে
ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। কিন্তু অর্ধশতাব্দী পর পাল্টে যায় চিত্র।
কর্তৃত্ববাদী শাসনের অভিযোগে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে ওঠে। তার পদত্যাগের দাবিতে মানুষ রাস্তায় নামে। যে দল একসময় বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিল, সে দলই আরেক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়।
নেপালে কট্টর বামপন্থিরা রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তার পথ ধরে ২০০৮ সালের মে মাসে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়।
সে সময় ক্ষমতাসীন জোট সরকারের অংশ ছিলেন কেপি শর্মা ওলি, যিনি কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনিফায়েড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট)–এর নেতা।
আর এখন গণবিক্ষোভ তাকেও পদ ছাড়তে বাধ্য করেছে, যেখানে নেপালের একটি অংশ আবার রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবি তুলছে।
সেই যুবসমাজ আন্দোলনের মুখ
নেপালের আন্দোলনকে বলা হচ্ছে ‘জেন-জি রেভলিউশন’। কারণ, সোশাল মিডিয়া-সচেতন তরুণ প্রজন্মই এ আন্দোলনের নেতৃত্বে। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, তরুণ-যুবারা পতাকা হাতে রাস্তায় নেমেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তারা প্রথমে আন্দোলন শুরু করে। পরে তা রূপ নেয় সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনে। প্রাণহানির পরও আন্দোলন থামেনি, বরং আরও ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশেও ছাত্র-যুবারাই আন্দোলনের প্রধান চালিকা শক্তি ছিল। শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে সেই আন্দোলনের মুখ ছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’।
২০২৪ সালের জুলাই–অগাস্টে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে। পরে তা সরকারবিরোধী গণআন্দোলনে রূপ নেয়। দমনপীড়নের মুখেও প্রাণহানি উপেক্ষা করে তারা রাজপথে টিকে ছিল এবং শেষ পর্যন্ত সফল হয়।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের কেন্দ্রে ছিল চাকরি ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা। মুক্তিযুদ্ধের বহু বছর পর জন্ম নেওয়া তরুণরা ওই কোটা ব্যবস্থাকে অন্যায্য হিসাবেই দেখেছে।
২০২৪ সালের জুনে হাই কোর্ট সরকারি চাকরিতে কোটা বহালের পক্ষে রায় দেওয়ার পর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, যা শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পতন ডেকে আনে।
নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আন্দোলন দ্রুত বিস্তৃত হয় দুর্নীতি, এবং সরকারি পদগুলোতে রাজনীতিবিদদের স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে।
‘নেপোকিডস’ হ্যাশট্যাগ ভাইরাল হয়, যেখানে আন্দোলনকারীরা অভিযোগ তোলেন– আত্মীয়তা বা পারিবারিকসূত্রে সরকারি পদে কাজের সুযোগ পাওয়া ব্যক্তিরা বিলাসী জীবনযাপন করছে, অথচ সাধারণ মানুষ টিকে থাকার সংগ্রামে ক্লান্ত।
দমননীতি ব্যুমেরাং
বলা হয়, জুলাই আন্দোলনের সময় বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের দমনপীড়নে প্রায় দেড় হাজার মানুষের প্রাণ গেছে। সেই মৃত্যু আন্দোলন থামাতে পারেনি; বরং সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে।
শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ভারতে। আন্দোলনকারীরা তার বাসভবনে ঢুকে উৎসবের আমেজে ভাংচুর-লুটপাট চালায়।
নেপাল সরকার আন্দোলন দমাতে শুরুতেই কঠোর অবস্থান নেয়। সেনা ও দাঙ্গা পুলিশ বিক্ষোভ দমনে মাঠে নামে।
কিন্তু ওই বলপ্রয়োগ আন্দোলনকে আরও তীব্র করেছে, দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও তা ছড়িয়ে পড়েছে।
নেপালের ওলি সরকারের দমনাভিযানে অন্তত ১৯ জন নিহত হয়েছেন। প্রথমে পদত্যাগে অনড় থাকলেও শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ওলি বাধ্য হন সরে দাঁড়াতে।