ভিপিএন কি ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেয়

প্রযুক্তি  ডেস্ক
  ২৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৯

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদ ও দেশত্যাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখে প্রায়ই আমরা শুনেছি, ‘বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে এখন উন্নয়নের রোল মডেল।’ এই সময়ে এসে এই কথার সত্যতা মিলল। তা–ও আবার পাকিস্তানের মাধ্যমে। এই দেশ নিয়ে বিষোদ্‌গারই শুনতে হয়েছে বিগত সরকারের আমলে। ‘বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে’, ‘পাকিস্তানের চেয়ে আমরা অনেক এগিয়ে আছি’—এসব শোনা ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। বর্তমান সময়ে পাকিস্তানেও চলছে বিক্ষোভ। আর দেশটির সরকার ইন্টারনেটের ওপর নানা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে, যেগুলো গত এক মাসে বাংলাদেশকে দেখতে হয়েছে। আন্দোলন দমনের পদ্ধতিতে পাকিস্তানের রোল মডেল বাংলাদেশ, এ কথা বলাই যায়।
গত সোমবার বিবিসির একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, পাকিস্তানে কয়েক সপ্তাহ ধরে ইন্টারনেটের গতি ভয়াবহ রকম ধীর। এ জন্য কে দায়ী বা কী কারণে এমনটা হচ্ছে, তা নিয়ে এখন জোর বিতর্ক চলছে। পাকিস্তানে ইন্টারনেটের গতি কম হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন দেশটির তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী শাজা ফাতিমা। গত রোববার তিনি বলেন, বর্তমানে ইন্টারনেটে যে ধীরগতি, তার পেছনে সরকারের কোনো হাত নেই। তিনি ও তাঁর দল ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী ও টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে মিলে এই সংকট নিরসনে ‘অক্লান্ত পরিশ্রম’ করে যাচ্ছেন।
শাজা ফাতিমার সঙ্গে কারও কথার কি মিল পাওয়া যাচ্ছে? হ্যাঁ। গত মাসেই এমন কথা বলেছেন সদ্য সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক। গত মাসের শেষভাগে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ১১ দিন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ও ১৩ দিন মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করার সময় এ রকম কথাবার্তাই শোনা গেছে প্রতিমন্ত্রীর মুখ থেকে। ‘ইন্টারনেট সরকার বন্ধ করেনি, ইন্টারনেট একা একা বন্ধ হয়ে গেছে’, ‘ডেটা সেন্টারে আগুন দেওয়া হয়েছে, তাই ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে’—এমন বক্তব্য দিয়েছেন তিনি।
পাকিস্তানের শাজা ফাতিমা আরও বলেন, জনগণের একটি ‘বড় অংশ’ ভিপিএন ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, এটি নেটওয়ার্কের ওপর চাপ তৈরি করেছে, যে কারণে ইন্টারনেটের গতি কমেছে। ইন্টারনেটের গতি ধীর হওয়ার পেছনে সরকারের হাত রয়েছে, এমন খবরকে শাজা ফাতিমা ‘সম্পূর্ণ ভুয়া’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। এমন কথা বাংলাদেশেও আমরা শুনেছি। আর তা পাকিস্তানের মাত্র কয়েক দিন আগেই।

ইন্টারনেট বন্ধ রাখার কারণে দেশে আর্থিক, ব্যবসায় খাতসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি সেবায় বিশৃঙ্খলতা তৈরি হয়। ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার এক পর্যায়ে সরকার বাধ্য হয় ইন্টারনেট আবার চালু করতে। তখন আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও টিকটক বন্ধ রাখা হয়। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, ‘গুজব’ ঠেকাতে। সবার জন্য বন্ধ রেখে প্রতিমন্ত্রী ‘গুজব’ ঠেকিয়ে ‘সত্য’ তথ্য প্রচার করতে নিজে ফেসবুক ও টিকটক ব্যবহার করছিলেন। কিছু সরকারি অফিস ও ব্যক্তি সরব ছিলেন এসব মাধ্যমে।

কিশোর-তরুণ থেকে বৃদ্ধ, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এখন ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভ্যস্ত। হাজার হাজার ফ্রিল্যান্সার, লাখো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ফেসবুকের ওপর নির্ভরশীল। এগুলো বন্ধ রাখা মানে তাদের রুটি-রুজিতে সরাসরি আঘাত করা। এসব মাধ্যম ব্যবহার করার বিকল্প পদ্ধতি খুঁজতে লাগলেন সাধারণ মানুষসহ সবাই। ডিজিটাল জগতে বিকল্পের শেষ নেই। কেননা, এটা মেধা-বুদ্ধিনির্ভর প্রযুক্তির জগৎ। যেহেতু মাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশ থেকে ঢোকা নিষেধ, ভিপিএন হলো বিকল্প। ভিপিএন দিয়ে মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে লাগলেন।

এখন যেসব কথা শোনাচ্ছেন পাকিস্তানি মন্ত্রী শাজা ফাতিমা, সেই ‘বাণী চিরন্তনী’ শোনা গেছে জুনাইদ আহমেদের মুখেও। ‘ভিপিএন ঝুঁকিপূর্ণ’, ‘ভিপিএনে আর্থিক লেনদেন করলে গ্রাহকের তথ্য অন্য কারও হাতে চলে যাবে’, ‘ভিপিএন সাইবার হামলার ঝুঁকি বাড়ায়’—এমন কথামালা ছিল জুনাইদ আহমেদের মুখে।

পাকিস্তানে সরকারবিরোধীরা বলছেন, দেশটির সরকার এখন চীন সরকারের মতো ইন্টারনেটে ‘ফায়ারওয়াল’ তৈরি করতে চাচ্ছে। উদ্দেশ্য অনলাইন জগতের ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা। অবশ্য শাহবাজ শরিফ সরকার এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। বরং বলেছে, ভিপিএনের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে এমনটা হচ্ছে।পাকিস্তানসহ এশিয়ার অনেক দেশে বিপ্লব, বিক্ষোভ ও জন-অসন্তোষ দমনের সময় প্রশাসন থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা নিয়মিত ঘটতে দেখা যায়। আবার ভিন্নমতাবলম্বীদের ঠেকাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ওয়েবসাইটসহ নানা ভার্চ্যুয়াল মাধ্যম ব্লক করে রাখা হয়। বিবিসির প্রতিবেদন এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে এসব কাণ্ড ঘটেছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের গ্রেপ্তার এবং তাঁর মুক্তির দাবিতে গত বছর থেকেই দেশটিতে থেমে থেমে বিক্ষোভ হচ্ছে। তখন থেকেই সে দেশের সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে রেখেছে। বিক্ষোভ সড়ক থেকে ডিজিটাল জগতে ছড়িয়ে পড়ার পর ইন্টারনেটের গতিও ধীর করে দেওয়া হয়েছে। একই কাজ করা হয়েছিল বাংলাদেশে।
জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে গত ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনের সময় থেকেই খুদে ব্লগ লেখার ওয়েবসাইট এক্স (সাবেক টুইটার) বন্ধ রাখা হয়েছে। পাকিস্তানে, বিশেষ করে ইমরান খানের সমর্থকদের মধ্যে এক্স অত্যন্ত জনপ্রিয়। এতে ইমরান খানের অনুসারী প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ। বাংলাদেশে ফেসবুক বেশি জনপ্রিয়, তাই সুযোগ পেলেই ফেসবুকের ওপর খড়্গ নেমে আসত সরকারের দিক থেকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিপিএন ব্যবহারকারীর ইন্টারনেট সংযোগের গতি কমিয়ে দেয়। পেইড বা প্রিমিয়াম ভিপিএনের ক্ষেত্রে গতি কমার হার উল্লেখ করার মতো নয়। তবে বিনা মূল্যের হোক বা পেইড হোক, ভিপিএন সার্বিকভাবে ইন্টারনেট সরবরাহের গতির ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না।
নেটওয়ার্ক বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জানা যায়, ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক বা ভিপিএন ব্যবহার করা হয় নিরাপদে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে ও তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। ধরা যাক, মতিঝিল ও বনানীতে একই অফিসের দুটি শাখা রয়েছে। কিংবা ঢাকা ও রাজশাহী বা দুই দেশে অবস্থিত দুটি শাখার মধ্যে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। ভৌত কাঠামো বা তারের মাধ্যমে এই নেটওয়ার্ক তৈরি খুবই ব্যয়বহুল, ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভবও। তাই ইন্টারনেট প্রটোকল বা আইপিকে ভিত্তি করে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়। সেটাই ভার্চ্যুয়াল নেটওয়ার্ক। প্রাইভেট মানে ব্যক্তিগত। অর্থাৎ আইপিভিত্তিক যে নেটওয়ার্কটি গড়ে উঠল, সেটি নির্দিষ্ট কাজের জন্যই ব্যবহৃত হবে। পাবলিক বা উন্মুক্ত নেটওয়ার্কের সঙ্গে এটি যুক্ত থাকবে না। ফলে ফাইল বা তথ্য আদান–প্রদান করা যায় নিজেদের নিয়ন্ত্রিত নিরাপদ এক মাধ্যমে। ভিপিএনের মূল উদ্দেশ্য হলো সাইবার জগতে নিরাপত্তা দেওয়া। এটি সাইবার ঝুঁকি বাড়ায় না, বরং কমায়। আর ভিপিএন ব্যবহার করতে ইন্টারনেটের যে ব্যান্ডউইডথ দরকার, সেটাও খুব বেশি নয়। ১০ শতাংশের কম ব্যান্ডউইডথ লাগতে পারে।
আন্দোলন, বিক্ষোভ কিংবা ভিন্নমত দমন করতে কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরাচারী সরকারের এখন বড় একটি হাতিয়ার ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ যেহেতু সরকারের হাতেই, তাই তাদের স্বার্থে চাইলেই ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়, বন্ধ করা হয়, নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট ব্লক করে দেওয়া হয়। দেশে আন্দোলনের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন টেলিগ্রাম অ্যাপ ব্যবহার করে বিভিন্ন ঘোষণা দিত, নিজেদের মধ্যে সংযোগ গড়ে তুলত। টেলিগ্রাম চ্যানেলের মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসূচি ও ঘটনা ছড়িয়ে দেওয়া হতো। প্রথম দফায় সরকার ফেসবুক বন্ধ করলেও টেলিগ্রাম বন্ধ করেনি। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় ইন্টারনেট চালুর পর যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্লক করা হলো, তখন সে তালিকায় টেলিগ্রামও যুক্ত হয়। সাইবার জগতে এ রকম দমনরীতি চালাতে গিয়ে সরকারে পক্ষ থেকে এমন সব ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, যেগুলো ন্যূনতম প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের কাছে হাস্যকর মনে হয়। সহজেই মিথ্যাচারগুলো ধরা পড়ে যায়। তাই তো সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের বয়ানের সঙ্গে মিলে যায় পাকিস্তানের মন্ত্রী শাজা ফাতিমার ব্যাখ্যা। সাধারণ মানুষও সহজে বুঝে যায়, অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে এখন পাকিস্তানের রোল মডেল বাংলাদেশ।