বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ‘বড় বড় ভুল’ নিয়ে যে আলোচনা দিল্লিতে

ডেস্ক রিপোর্ট
  ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৩:২৫
আপডেট  : ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৩:৩৮

ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক মানস ঘোষ (৮২) কলকাতার বিখ্যাত ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার হয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কভার করেছিলেন, তখন অবশ্য তিনি একেবারেই তরুণ। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তার পত্রিকা তাকে ঢাকায় পোস্টিং দেয় এবং সেই সময় টানা তিন বছর (১৯৭২-৭৪) স্বাধীন বাংলাদেশের শৈশবের পর্বটা এবং অবশ্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন।
মানস ঘোষ সম্প্রতি তার সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লিখেছেন, যার নাম ‘মুজিব’স ব্লান্ডার্স– দ্য পাওয়ার্স অ্যান্ড দ্য প্লট বিহাইন্ড হিজ কিলিং’। মানে বাংলায় বললে– ‘মুজিবের বড় বড় ভুল– তার হত্যার পেছনে যেসব শক্তি ও যে ষড়যন্ত্র ছিল!’
দিল্লির নামি প্রকাশনা সংস্থা নিয়োগী বুকসের প্রকাশিত এই বইটি এখন ভারতে আলোচনার কেন্দ্রে – গত মাসের (জুলাই) শেষ দিকে এই বইটি নিয়ে রাজধানী দিল্লিতে পর পর দু’দিন দুটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভাও অনুষ্ঠিত হল। যার একটি দিল্লিতে বাঙালিদের ‘রাজধানী’ সি আর পার্কের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র চিত্তরঞ্জন অডিটোরিয়ামে, অপরটি দিল্লির ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবে। 
শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের ৫০তম বর্ষপূর্তির ঠিক আগে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তথাকথিত ‘মুজিববাদ’ নিয়েও যখন বিতর্ক চরমে–সেই পটভূমিতে দিল্লির বুকে এই আলোচনাগুলোর গুরুত্বও ছিল অপরিসীম।
বইটির লেখক মানস ঘোষ দুটি সভাতেই উপস্থিত ছিলেন। সি আর পার্কের সভাতে তার সঙ্গেই ছিলেন ঢাকায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী ও রিভা গাঙ্গুলি দাস, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক আইপিএস অফিসার শান্তনু মুখার্জি প্রমুখ। প্রেস ক্লাবের আলোচনায় লেখক ছাড়াও যোগ দেন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট গৌতম লাহিড়ী ও হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার কূটনৈতিক সম্পাদক রেজাউল লস্কর।
কিন্তু বইটিতে শেখ মুজিবের ঠিক কোন কোন ‘ভুলে’র দিকে আলোকপাত করা হলো?
‘চর ও দালালদের চিনতে পারেননি’
লেখক-সাংবাদিক মানস ঘোষ জানাচ্ছেন, আজ যাকে ‘ডিপ স্টেট’ বলা হয়, তার কুশীলবরা কিন্তু একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পরও সক্রিয় ছিল কিন্তু মুজিব তাদের চিনতে পারেননি। বরং পাকিস্তানপন্থি ‘কুইসলিং’-দের তিনি নতুন রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলেন, পরে নিজের জীবন দিয়ে যে সিদ্ধান্তের মাশুল তাকে দিতে হয়েছিল।
ভারত তো বটেই, এমন কী কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রোও নাকি তাকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন  কিন্তু তিনি ভাবতেই পারেননি তার দেশের মানুষের কাছ থেকে কোনও বিপদ আসতে পারে।
‘যেমন ধরুন একজন চেনা পাকিস্তানি চরকে তিনি দেশের ভিজিল্যান্স কমিশনার বানিয়েছিলেন। আমিও তাকে চিনতাম, এবং একাত্তরে তার বিতর্কিত ভূমিকার পরও তিনি কীভাবে ওই পদ পেলেন সেটা ছিল একটা বড় প্রশ্ন!’, বলছিলেন মানস ঘোষ।
বইটিতে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, পাকিস্তান তাদের এসব চরদের মাধ্যমেই মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র রচনা করেছিল এবং একাত্তরে তাদের লজ্জাজনক আত্মসমর্পণের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল।
মুজিবের হত্যাকাণ্ডের ঠিক বছরখানেক আগে (জুলাই ১৯৭৪) ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে রহস্যময় মৃত্যু হয় ভারতের গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফণীন্দ্র নাথ (পিএন) ব্যানার্জির, যিনি শেখ মুজিবেরও খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মানস ঘোষ জানাচ্ছেন, ‘আমি নিশ্চিত ফণীবাবু বেঁচে থাকলে কেউ মুজিবের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারতো না।’
বাকশালের প্রতিষ্ঠা, তাজউদ্দীনকে উপেক্ষা করা
তবে বইটিতে মুজিবের সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে যেটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তা হলো ‘বাকশালে’র নামে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করার চেষ্টা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করার চেষ্টা।
মানস ঘোষের কথায়, ‘তার বিশ্বস্ত লেফটেন্যান্ট তাজউদ্দীন আহমদ কিন্তু মুজিবকে সতর্ক করেছিলেন, এতে ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতির প্রবেশ ঘটবে এবং শেষ পর্যন্ত তা আপনাকেই বিপদে ফেলবে কিন্তু তিনি তাতেও কর্ণপাত করেননি।’
বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের কর্ণধার তাজউদ্দীনকে কোণঠাসা করে ফেলাটা যে শেখ মুজিবের খুব বড় ভুল ছিল, বইতে সেটাও বলা হয়েছে।


আলোচকদের মধ্যে ছিলেন (বাঁ দিক থেকে) : পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী, রিভা গাঙ্গুলি দাস, লেখক মানস ঘোষ ও শান্তনু মুখার্জি

এই বইতে শেখ মুজিবের আরেকটি সিদ্ধান্তেরও সমালোচনা করা হয়েছে– তা হলো ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠা।
লেখক যুক্তি দিয়েছেন, নিজে আপাতমস্তক অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিব এই প্রতিষ্ঠানটির গোড়াপত্তন করেন, যা পরে কার্যত ধর্মীয় মৌলবাদী ভাবাপন্ন লোকজনের কব্জায় চলে যায় এবং তারা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার প্রসার ঘটায়।
‘পাকিস্তানের স্বীকৃতির জন্য মরিয়া ছিলেন’
‘মুজিব’স ব্লান্ডার্স’ বঙ্গবন্ধুর আর একটি ‘ত্রুটি’র দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে– আর সেটি হলো, যে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম, একটা পর্যায়ে তিনি সেই পাকিস্তানের কাছ থেকেই বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন।
মানস ঘোষ যুক্তি দিয়েছেন (যে মতবাদ ভারতে অনেক পর্যবেক্ষকই বিশ্বাস করেন), ১৯৭৪-এর ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে ইসলামিক দেশগুলোর জোট ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে শেখ মুজিবের যোগদানের বড় কারণ ছিল এটাই– পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়া।
‘বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার বদলে পাকিস্তানের শর্ত ছিল, তাদের যে ১৯৫ জন সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছে তা প্রত্যাহার করতে হবে।’
“অথচ বঙ্গবন্ধু কিন্তু নিজের দেশের মানুষকে কথা দিয়েছিলেন, এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তিনি নিশ্চিত করবেন। কিন্তু ভুট্টোর চাপের কাছে নতি স্বীকার করে তিনি নিজের দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ করেছিলেন’, বলছেন মানস ঘোষ।
দিল্লির সি আর পার্কের সভায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীও লেখকের এই বক্তব্যকে সমর্থন জানান।
তিনি বলেন, ‘একদা সোহরাওয়ার্দীর ডান হাত হিসেবে শেখ মুজিবের সম্ভবত পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি একটা গোপন দুর্বলতা ছিল– আর তাই সেই পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেতে তিনি এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন!’
ঢাকাতে নিযুক্ত ভারতের আর একজন সাবেক হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস বলেন, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের গত চুয়ান্ন বছরের যাত্রায় জাতীয় ঐক্য বা সংহতি (‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন’) নিশ্চিত করা সব সময়ই খুব কঠিন হয়েছে– আর তার পেছনে দেশটির জন্মলগ্নে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের খুব বড় ভূমিকা আছে, এমনটা মনে করা যেতেই পারে।
‘মুজিব’স ব্লান্ডার্স– দ্য পাওয়ার্স অ্যান্ড দ্য প্লট বিহাইন্ড হিজ কিলিং’ নামে আলোচিত এই বইটি নিয়ে চলতি মাসে (আগস্ট) কলকাতা-সহ ভারতের অন্যান্য শহরেও অনুরূপ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।