ভারতে প্লেনের যাত্রীকে চড়ের ভিডিও ভাইরাল, যা ঘটেছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  ০২ আগস্ট ২০২৫, ২০:০৯

ভারতীয় আকাশ পরিবহন সংস্থা ইন্ডিগোর মুম্বাই থেকে কলকাতাগামী প্লেনের এক যাত্রীর বিরুদ্ধে তার সহযাত্রীকে থাপ্পড় মারার অভিযোগ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা চলছে। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল রয়েছে। সেখানে দেখা যায়, প্লেনের এক যাত্রী একজন মুসলিম সহযাত্রীকে থাপ্পড় মারছেন।
যাকে আঘাত করা হয়েছে, সেই যুবকের নাম হুসেন আহমেদ মজুমদার। ৩২ বছর বয়সী মজুমদার আসামের বাসিন্দা হলেও বর্তমানে মুম্বাইয়ে কর্মরত।
ঘটনাটি ঘটেছে গত ৩১ জুলাই, ইন্ডিগোর ৬ই ১৩৮ ফ্লাইটে। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরই এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা তৈরি হয়েছে।
বিবিসির প্রতিনিধির সঙ্গে হুসেন আহমেদ মজুমদারের বাবা আবদুল মান্নান মজুমদারের কথা হয়েছে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে যে যুবককে আঘাত করা হয়েছে, তাকে নিজের ছেলে বলে শনাক্ত করেছেন তিনি।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, প্লেনের ভেতর মজুমদারকে অসুস্থ দেখাচ্ছিল এবং কেবিন ক্রুরা তাকে সাহায্য করছিলেন। এরই মাঝে অন্য এক যাত্রী তাকে থাপ্পড় মারেন।

ভিডিওতে যা দেখা গেছে
সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন কেবিন ক্রু এক ব্যক্তিকে সামলানোর চেষ্টা করছেন। সেই সময় হঠাৎই অপর এক যাত্রী ওই ব্যক্তিকে থাপ্পড় মারেন।
ঘটনার পর বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন ওই ব্যক্তি। কাঁদতেও দেখা যায় তাকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে পড়েন সবাই। ভিডিওতে শোনা যায়, যিনি থাপ্পড় মেরেছেন তাকে অন্য এক যাত্রী বলছেন, ‘আপনি মারলেন কেন? কাউকে মারার অধিকার আপনার নেই।’
যাকে উদ্দেশ্য করে এই প্রশ্ন, তিনি পাল্টা ওই ( হুসেন আহমেদ মজুমদার) ব্যক্তির আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বলেন, ‘ওর জন্য অসুবিধা হচ্ছিল।’
এর জবাবে সেই সহযাত্রীকে (যিনি প্রশ্ন করেছিলেন) বলতে শোনা যায়, ‘সমস্যা সবার হচ্ছিল। কিন্তু তাহলেও আপনার গায়ে হাত তোলা ঠিক হয়নি। কেন মারলেন আপনি?’
এসময় পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেন কেবিন ক্রুরা। যিনি সহযাত্রীর ওপর হাত তুলেছেন তাকে উদ্দেশ্য করে এক কেবিন ক্রু বলেন, ‘দয়া করে এরকম করবেন না, স্যার।’
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওতে দেখা যায়, হুসেন আহমেদ মজুমদারের জন্য প্লেনের ক্রুদের পানি আনার অনুরোধ করা।
সহযাত্রীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘ওনার প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে, দয়া করে ওনাকে একটু পানি দেন।’
প্লেন অবতরণের পর অভিযুক্তকে বিমানবন্দরে মোতায়েন নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স (সিআইএসএফ) তদন্তের জন্য ওই ব্যক্তিকে নিজেদের হেফাজতে নেয়।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে একটি বিবৃতি দিয়েছে ইন্ডিগো এয়ারলাইনস। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ প্রকাশিত সেই বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সহযাত্রীর ওপর হাত তুলে নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন যে ব্যক্তি, তার বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের পক্ষে বলা হয়, ‘আমাদের একটা ফ্লাইটে ফিজিক্যাল অল্টারকেশনের (বিবাদ বা মারামারির) যে ঘটনা ঘটেছে, সে সম্পর্কে আমরা অবগত। এ ধরনের অবাধ্য আচরণ একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং আমাদের যাত্রী ও ক্রুদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে আপস করে এমন যে কোনো কর্মকাণ্ডেরই আমরা তীব্র নিন্দা জানাই।’
‘আমাদের ক্রুরা প্রতিষ্ঠিত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি অনুসারে কাজ করেছেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে আনরুলি (যিনি নিয়ম কানুন মানেন না) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং প্লেন অবতরণের পর তাকে নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
‘প্রোটোকল অনুসারে সব উপযুক্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এ ঘটনা সম্পর্কে যথাযথভাবে জানানো হয়েছে। আমরা আমাদের সব ফ্লাইটে নিরাপদ এবং সম্মানজনক পরিবেশ বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ,’ বলা হয় ওই বিবৃতিতে।
এয়ারলাইনসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এরই মধ্যে ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। যার বিরুদ্ধে নিয়মভঙ্গের অভিযোগ, তাকে ‘নো-ফ্লাই’ তালিকায় রাখা উচিত কি না তা নির্ধারণের জন্য একটা কমিটি ওই ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখবে বলেও জানানো হয়েছে।
এদিকে, বিধাননগর পুলিশের এক পদস্থ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে সহযাত্রীকে থাপ্পড় মারার অভিযোগ তাকে প্রথমে আটক করা হলেও পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দার ঝড়
ঘটনার ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই নিয়ে এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। একদিকে যেমন একজন প্লেনযাত্রীর সঙ্গে তার সহযাত্রীর আচরণের নিন্দা হচ্ছে, তেমনই এয়ারলাইনসের ওপরও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ লিখেছেন, ইন্ডিগো একটা দুর্বল প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। যিনি সহযাত্রীকে মেরেছেন, তাকে কি নো-ফ্লাই লিস্টে রাখা হয়েছে? যদি ওই যাত্রীকে সিআইএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তাহলে আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে কি?
সহযাত্রীর সঙ্গে এমন আচরণেরও নিন্দা করেছেন অনেকে। কেউ আবার এর সঙ্গে ধর্মের বিষয়ও যোগ করেছেন।
এক্স হ্যান্ডেলে একজন লিখেছেন, ‘আর কতদিন এভাবে মার খেতে থাকবেন? ইন্ডিগোর প্লেনের এ ঘটনা অত্যন্ত লজ্জাজনক। সময় থাকতে এই জাতীয় মানসিকতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নিলে তা সমাজের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশজুড়ে ইসলামোফোবিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
সামাজিক মাধ্যমে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিবরাজ যাদব নামে আরেকজন ব্যক্তি। তিনি লিখেছেন, ইন্ডিগো প্লেনের ভিডিও দেখে অবাক হয়েছি! একজন অসুস্থ মুসলিম যাত্রীকে এয়ার হোস্টেস যখন নিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই সময় এক ব্যক্তি তাকে চড় মারেন! থাপ্পড়টা কি শুধু দাড়ি এবং টুপি দেখেই মারা হয়েছিল, নাকি বিবাদও হয়েছিল? আমরা সত্য প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করবো, তবে এটা ভুল হয়েছে।
ডা. শীতল যাদব নামে একজন ইন্টারনেট ইউজার লিখেছেন, ইন্ডিগোর প্লেনে যা ঘটেছে তা অত্যন্ত লজ্জাজনক। ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য করাটা ভুল। ইসলামোফোবিয়া এখন একটা বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আবার অনেকেই এই ঘটনার প্রসঙ্গে ধর্মীয় রঙ আনার বিরোধিতা করেছেন অনেকে।
ফ্যাক্ট চেকার এবং অল্ট নিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ জুবায়ের দ্য হিন্দু সংবাদপত্রের এভিয়েশন সাংবাদিক জাগৃতি চন্দ্রকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে ওই যুবককে মারার অভিযোগ, তারা দুজনেই একই সম্প্রদায়ের।
মোহাম্মদ জুবায়ের এক্স-এ লিখেছেন, যে যাত্রী অস্থির হয়ে পড়েছিলেন এবং প্লেন থেকে নামতে চেয়েছিলেন। সেই সময় একজন সহযাত্রী তাকে চড় মারেন, দুজনেই একই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত (মুসলিম)। অভিযুক্তকে নিয়ম বিরুদ্ধ আচরণের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা