‘নো কিং ডে’— আমেরিকার গণতন্ত্রের নবজাগরণ !

ডেস্ক রিপোর্ট
  ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১৪:১৩


আমেরিকা জুড়ে এক অনন্য দিন ছিল গত শনিবার। যে দিনটি শুধু প্রতিবাদের নয়, বরং আত্মপরিচয়ের পুনরুদ্ধারেরও দিন বলে মনে হয়েছে। শনিবার দেশজুড়ে লাখো মানুষের অংশগ্রহণে পালিত হলো ‘নো কিং ডে’। নামটি শুনতে যেন সরল এক প্রতীকী প্রতিবাদ।  কিন্তু এর ভেতরে লুকিয়ে আছে গভীর রাজনৈতিক বার্তা—আমেরিকা কোনো রাজতন্ত্র নয়, এখানে জনগণই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। এই বার্তাই উচ্চারণ করেছে দেশজুড়ে রাস্তায় নেমে আসা মানুষদের কণ্ঠস্বর।
‘নো কিং ডে’–এর পটভূমি নতুন নয়। কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতির ভিতর যে এক ধরনের একনায়কতন্ত্রের ছায়া দেখা দিয়েছে, তারই প্রতিবাদে এই আন্দোলনের জন্ম। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর পর থেকে প্রশাসনের কঠোরতা, অভিবাসনবিরোধী অভিযান, সংবাদমাধ্যমের প্রতি তীব্র আক্রমণ, এবং বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ—সব মিলিয়ে আমেরিকার গণতন্ত্র যেন ধীরে ধীরে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ছে।
জনগণ এ বাস্তবতা দেখছে, অনুভব করছে, আর তাই তারা বলেছে—“আমরা রাজা মানি না।” এ কথার ভেতরে শুধু এক ব্যক্তির বিরোধিতা নয়, বরং পুরো এক শাসনদর্শনের প্রত্যাখ্যান নিহিত আছে। রাজা মানে একক ক্ষমতা, জবাবদিহিহীন শাসন, এবং জনগণের উপর প্রভুত্ব। এই ধারণাটির বিপরীতে আমেরিকার জন্ম হয়েছিল স্বাধীনতা, সমতা ও জনগণের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে। আজ সেই ভিত্তি কেঁপে উঠেছে বলেই মানুষ আবার সেই প্রাচীন স্লোগানে ফিরে গেছে—“No Kings.”
আমেরিকান রাজনীতিতে গত এক দশকে যে পরিবর্তন এসেছে, তা মূলত ব্যক্তিপূজার উত্থান। ট্রাম্প নামের রাজনৈতিক ঘটনাটি শুধু এক নেতা নয়, বরং এক মানসিকতা তৈরি করেছে। যেখানে নেতা আইন, সত্য ও ন্যায়ের ঊর্ধ্বে। এই মানসিকতা থেকেই জন্ম নেয় এক ধরনের আধুনিক রাজতন্ত্র। যেখানে রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের প্রতিনিধি নয়, বরং জনগণের নিয়ন্তা।
‘নো কিং ডে’-এর মাধ্যমে নাগরিকরা সেই নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দাও, রাষ্ট্রকে করো নাগরিকমুখী, স্বৈরতন্ত্র নয়, সংবিধানই হোক সর্বোচ্চ আইন। নিউইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন, শিকাগো থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস—সব শহরেই মানুষ রাস্তায় নেমেছে এই এক দাবিতে: “আমরা শাসিত হতে চাই না, আমরা শাসক গণতন্ত্র চাই।”
এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তরুণ প্রজন্ম। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পেশাজীবী সংগঠন থেকে শুরু করে সাধারণ শ্রমজীবী তরুণ–তরুণীরাও এতে যুক্ত হয়েছেন। তাদের চোখে আমেরিকার ভবিষ্যৎ, তাদের মুখে সত্যের আহ্বান। তারা রাজনীতির ভাষা বদলে দিয়েছে—ধর্ম, বর্ণ, দল নয়। তারা কথা বলছে নাগরিক অধিকার, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়ের।
এই প্রজন্মই বলেছে, “আমরা রাজা চাই না, আমরা ন্যায় চাই।” তারা বুঝতে পেরেছে যে, রাজনীতি যখন ক্ষমতার খেলা হয়ে যায়, তখন গণতন্ত্র নিঃশেষ হয়। তাই তাদের প্রতিবাদ আসলে এক পুনর্জাগরণের বার্তা—আমেরিকার সংবিধানের প্রতি এক নব আস্থা।
রিপাবলিকান দল ও ট্রাম্পপন্থী রাজনীতিকেরা এই আন্দোলনকে ‘অ্যান্টি–আমেরিকান’ বলে অভিহিত করেছেন। তাদের বক্তব্য, এই বিক্ষোভ দেশবিরোধী ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, সংগঠিত ও নাগরিকচেতনা–নির্ভর। এতে কোনো দলীয় পতাকা ছিল না, ছিল কেবল নাগরিক অধিকারের পতাকা।
এই প্রতিক্রিয়া আসলে মার্কিন রাজনীতির গভীর বিভাজনের প্রতিফলন। একদিকে তারা, যারা মনে করে রাষ্ট্রপ্রধান সর্বশক্তিমান। অন্যদিকে তারা, যারা বিশ্বাস করে জনগণের ওপরেই রাষ্ট্রের ক্ষমতা ন্যস্ত। এই বিভাজনই এখন আমেরিকার সবচেয়ে বড় সংকট। আর ‘নো কিং ডে’ সেই সংকটের মুখে এক নৈতিক প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি হয়ে উঠেছে।
আমেরিকাকে বলা হয় বিশ্ব গণতন্ত্রের প্রতীক। তাই আমেরিকার ভেতরের এই আন্দোলন বিশ্বজুড়েও প্রতিধ্বনি তুলেছে। লন্ডন, বার্সেলোনা, প্যারিস, মাদ্রিদ—সব জায়গায় দেখা গেছে সংহতির বিক্ষোভ। এর মানে একটাই—গণতন্ত্রের প্রশ্ন আজ আর কোনো একটি দেশের সীমায় আবদ্ধ নয়, এটি এক বিশ্বজনীন আহ্বান।
বিশ্বের যেসব দেশে স্বৈরশাসন, দুর্নীতি, এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ চলছে, তাদের জন্য এই আন্দোলন এক শিক্ষা। জনগণকে চুপ করিয়ে রাখা যায় না। রাজনীতি যখন নাগরিকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখনই জনগণ উঠে দাঁড়ায়। আমেরিকার ‘নো কিং ডে’ সেই জাগরণের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বিক্ষোভে বড় ভূমিকা রেখেছেন নারী ও অভিবাসী সমাজ। তাঁরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিমালা তাঁদের জীবনে ভয়, অনিশ্চয়তা ও বৈষম্য বাড়িয়েছে। এই নারীরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল—সব মানুষ সমান। সেই সমতার স্বপ্নই আজ বিপন্ন। তারা বলেছে, “গণতন্ত্র কেবল শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের জন্য নয়, এটি সকল মানুষের অধিকার।” এই উচ্চারণ কেবল সামাজিক সমতার নয়, নৈতিক শক্তিরও প্রতিফলন। নারীর কণ্ঠে যখন গণতন্ত্রের সুর বাজে, তখন তা সমাজের হৃদয়কে নাড়া দেয়।
‘নো কিং ডে’-এর সবচেয়ে উজ্জ্বল দিক ছিল এর মানবিক আবেদন। কেউ চিৎকার করেনি, কেউ সহিংস হয়নি। বরং নাগরিকরা শান্তভাবে, সংগীত, কবিতা ও শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে প্রতিবাদ। কেউ হাতে লিখেছে, “অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরব থাকা অপরাধ।” কেউ বলেছে, “গণতন্ত্র মানে সবার মর্যাদা।” এই মানবিকতাই আসলে আমেরিকার আসল শক্তি। রাজনৈতিক দল নয়, সামরিক শক্তি নয়—মানবতার উপর দাঁড়িয়ে থাকা এক সমাজই আমেরিকার সত্য পরিচয়।
‘নো কিং ডে’ হয়তো এক দিনের আন্দোলন, কিন্তু এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে। এটি আমেরিকার নাগরিকদের মনে এক নতুন উপলব্ধি জাগিয়েছে—গণতন্ত্র রক্ষা কোনো রাজনীতিবিদের কাজ নয়, এটি জনগণের নিজস্ব দায়িত্ব। যদি জনগণ নীরব থাকে, তবে রাজা তৈরি হয়; যদি জনগণ কথা বলে, তবে রাজা বিলুপ্ত হয়।
এখন আমেরিকার সামনে দুটি পথ—একটি হলো ক্ষমতার কেন্দ্রিক রাজনীতি, অন্যটি নাগরিক চেতনার নবজাগরণ। ইতিহাস বলছে, আমেরিকা সবসময় দ্বিতীয় পথটি বেছে নিয়েছে। ‘নো কিং ডে’–এর এই আন্দোলন  এক ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ। এটি এক নব সূচনা। এটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে—গণতন্ত্র কোনো উপহার নয়, এটি অর্জনের নাম; আর জনগণের কণ্ঠই রাষ্ট্রের প্রকৃত রাজা।
আমেরিকার এই জাগরণে লুকিয়ে আছে বিশ্ব গণতন্ত্রের নতুন বার্তা—যে যেখানে থাকি না কেন, অন্যায়ের সামনে মাথা নোয়ানো নয়। সত্যের পাশে দাঁড়ানোই মানবতার শপথ। “নো কিংস”—এই উচ্চারণ এখন কেবল আমেরিকার নয়, এটি সমগ্র বিশ্বের স্বাধীন কণ্ঠের প্রতিধ্বনি।