রাশিয়া থেকে তেল কেনার ‘অপরাধের’ শাস্তি হিসেবে ভারতের রপ্তানিকৃত পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ শতাংশ শুল্ক ও অনির্দিষ্ট জরিমানার ঘোষণা ‘অন্যায্য ও অযৌক্তিক’ বলে বর্ণনা করল ভারত। গতকাল সোমবার রাতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলা হয়, জাতীয় স্বার্থ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ভারত সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
রাশিয়া থেকে তেল কেনায় ভারতের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসন অনেক দিন থেকেই অসন্তুষ্ট। অনেকবার এ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক ঘোষণার পাশাপাশি অনির্দিষ্ট জরিমানার কথা গত মাসের শেষ দিনে তিনি জানিয়েও দেন। ৭ আগস্ট থেকে তা কার্যকর হওয়ার কথা। এ পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গতকাল আরও একবার ভারতকে হুঁশিয়ারি দিলেন। তিনি বলেন, রাশিয়া থেকে তেল কিনে ভারত তা আন্তর্জাতিক খোলাবাজারে বিক্রি করে মুনাফা লুটছে। সেই অপরাধে ভারতের ওপর আরও শুল্ক চাপানো হতে পারে। ট্রাম্পের ওই হুঁশিয়ারির পরেই গতকাল রাতে ভারতের ওই বিবৃতি; যদিও বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
আত্মপক্ষ সমর্থন করে বিবৃতিতে ভারত বলেছে, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তেল কেনার দরুন ভারতকে নিশানা করা হচ্ছে। রাশিয়া থেকে ভারত তেল কিনতে বাধ্য হয়, কারণ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারের যাবতীয় সরবরাহ ইউরোপমুখী হয়ে গিয়েছিল। সে সময় জ্বালানি বাজারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখার জন্য রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানিকে যুক্তরাষ্ট্র উৎসাহও জুগিয়েছিল।
ওই বিবৃতিতে ভারত বলেছে, যেসব দেশ ভারতের সমালোচনা করছে, দেখা গেছে, তারাও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছে। তাদের সেই বাণিজ্য ভারতের মতো জরুরি বা বাধ্যবাধকতামূলক ছিল না।
কারা সেই বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে, সেই খতিয়ানও ভারত ওই বিবৃতিতে দিয়েছে। যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শুধু ২০২৪ সালেই ইইউ ও রাশিয়ার মধ্যে ৬৭ হাজার ৫০০ কোটি ইউরোর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয়েছে। এর এক বছর আগে ২০২৩ সালে পরিষেবার ক্ষেত্রে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ২০০ কোটি ইউরো। ভারত ও রাশিয়ার মোট বাণিজ্যের চেয়ে ইইউর বাণিজ্যের পরিমাণ অনেক বেশি। ২০২৪ সালে রাশিয়া থেকে ইইউ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করেছে ১৬ কোটি ৫০ লাখ টন, যা কিনা ২০২২ সালের আমদানির চেয়েও বেশি। শুধু জ্বালানিই নয়, রাশিয়া থেকে ইইউ সার, রাসায়নিক, লোহা, ইস্পাত, মেশিন, পরিবহন যন্ত্রাংশ ও খনিজ পদার্থও আমদানি করে।
যুক্তরাষ্ট্র–রাশিয়া বাণিজ্যিক বহরের কথাও ওই বিবৃতিতে ভারত উল্লেখ করেছে। কোনো রকম মন্তব্য না করে বলা হয়েছে, রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার পারমাণবিক শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লোরাইড, ইলেকট্রিক গাড়ি শিল্পের জন্য প্যালাডিয়াম, নানা ধরনের সার ও রাসায়নিক কিনেই চলেছে। এরপরই ভারত জানায়, তার ওপর এই ধরনের আক্রমণ অন্যায্য ও অযৌক্তিক। পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর মতো ভারতও তার জাতীয় স্বার্থ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
গতকাল ভারতীয় সময় রাত সাড়ে আটটা নাগাদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সমাজমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে নতুনভাবে ওই হুমকি দেন। তাতে তিনি লেখেন, ভারত যে রাশিয়া থেকে শুধু তেল কিনছে তা নয়, সেই তেল আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে মুনাফাও লুটছে। রাশিয়ার আক্রমণে ইউক্রেনে কত মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, তার পরোয়াও করছে না। এ কারণে ভারতের পণ্যের ওপর আরও শুল্ক চাপানো হবে।
রাশিয়া থেকে তেল কেনা ও সেই তেলের কিছুটা খোলাবাজারে বিক্রির অভিযোগ এর আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করেননি। ভারতের বিবৃতিতে ট্রাম্পের নীতি নিয়ে এত কিছু বলা হলেও রাশিয়ার তেল খোলাবাজারে বিক্রি নিয়েও কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র মারফত এর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। সেই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, রাশিয়া থেকে কেনা অশোধিত তেল ভারত বিশ্বের খোলাবাজারে বিক্রি করে না। সেই তেল শোধন করে যে জ্বালানি তৈরি হয়, যেমন পেট্রল, ডিজেল বা বিমানের জ্বালানি, ভারত তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে থাকে।
ট্রাম্পের নতুন হুমকির পরিণাম কী হয়, ভারতে আপাতত চলছে সেই প্রতীক্ষা। শুল্ক আরও বৃদ্ধি হয় কি না, সেই শঙ্কার পাশে রয়েছে জরিমানার পরিমাণ কত হয়। ট্রাম্পের আগের ঘোষণায় সেই পরিমাণ জানানো হয়নি।