আওয়ামী লীগের আচমকা জেগে ওঠা ও একচক্ষু রাজনীতি

মাহবুব আজীজ
  ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১৪:০০

আশির দশকের শেষভাগে, ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ২৪ বছরের যুবক নূর হোসেন তাঁর উদোম বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে এরশাদবিরোধী মিছিলে অংশ নেন। মিছিলটি রাজধানীর জিরো পয়েন্টে পৌঁছুলে পুলিশ সরাসরি গুলি চালায়। গুলি নূর হোসেনের বুক-পিঠ ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়, শহীদ হন নূর হোসেন; সেই ঘটনা স্বৈরাচারী সরকার পতন আন্দোলনকে তুঙ্গে তুলে দেয়। তিন বছর পর ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিন জোটের নেতৃত্বে গণআন্দোলনে এইচএম এরশাদের পতন ঘটে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। এরপর থেকে দেশের রাজনীতিতে বিভাজন স্পষ্ট হতে থাকে। পরবর্তী তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় এবং যথাক্রমে আওয়ামী লীগ (১৯৯৬, ২০০৮) ও বিএনপি (২০০১) বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। 
রাজনীতিতে বিভাজনের পরিণতিতে পতিত স্বৈরাচার এরশাদ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন; তাঁর জাতীয় পার্টিকে দুই প্রধান রাজনৈতিক দল– আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের সঙ্গে রাখবার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। বিশেষত ২০০৬ সালে নির্ধারিত নির্বাচনের আগে এরশাদ একবার বিএনপির পক্ষে, আরেকবার আওয়ামী লীগের পক্ষে নিজের অবস্থান জারি রাখার ঘোষণা দেওয়ায় ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়।
রাজনীতিতে ধূম্রজাল সৃষ্টি, অনৈতিকতা, অস্পষ্টতা ও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করার ক্ষেত্রে এরশাদ ও তাঁর জাতীয় পার্টির বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। ২০১৪ থেকে এক দশক শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে আওয়ামী লীগের ছলছুতোর ভোটারবিহীন নির্বাচন আয়োজনের প্রধান সহযোগী এই দল। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাইরে রেখে জাতীয় সংসদে পোষ্যবিরোধী হিসেবে আবির্ভূত হয় জাতীয় পার্টি।
এরশাদের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ ও ভাই জি এম কাদেরের মধ্যে যতই সংঘাত থাকুক, শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্র বজায় রাখতে তারা দু’জনেই বিদূষকের ভূমিকা পালন করেন। তুলনারহিত ঘটনার জন্ম দিয়ে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতারা সরকারের মন্ত্রী পদে আসীন হন। সব মিলিয়ে ভোটারবিহীন নির্বাচন ও বিরোধী দলশূন্য সংসদে ‘অনবদ্য’ গণতন্ত্রের নমুনা তৈরি করে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ও ‘আশি দশকের স্বৈরাচার’ জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি। 
গত দেড় দশক আওয়ামী লীগ আদৌ গুরুত্বের সঙ্গে ১০ নভেম্বর পালন বা শহীদ নূর হোসেনের নাম স্মরণ করেনি। জাতীয় পার্টির সঙ্গে গাঁটছড়ার কারণে শহীদ নূর হোসেনের নাম-নিশানা কার্যত ভুলে গিয়েছিল। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে গণতন্ত্রের যে আকাঙ্ক্ষায় নূর হোসেন নিজের বুকে-পিঠে স্লোগান লিখে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জনগণের সেই গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকেই লুণ্ঠন করে এরশাদের সঙ্গে আঁতাত করে যেনতেনভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখে। অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখবার পরিণতি চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। গণঅভ্যুত্থান রুখতে শেখ হাসিনার পুলিশ ও ক্যাডার বাহিনী ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। মানুষ হত্যা করে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী কার্যত নিঃশব্দ, অধিকাংশ আত্মগোপনে, অনেকে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে।
আওয়ামী লীগের এই বিপর্যস্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে যৌক্তিক আচরণটি হতে পারত দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা। তা হয়নি, বরং পুরো গণঅভ্যুত্থানের ঘটনা ও হত্যার দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। শেখ হাসিনার কয়েক দফা ফাঁস হওয়া ফোনালাপে সেটা স্পষ্ট। যদিও এসব ফোন আলাপ নিয়ে কোনা আপত্তি বা এসব আলাপ যে শেখ হাসিনার নয়– এরকম কোনো বিবৃতি আওয়ামী লীগ দেয়নি। শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়সহ কয়েকজন নেতার কথাবার্তাও প্রকাশ্যে এসেছে। সর্বশেষ ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবসের আগের দিন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে নেতাকর্মীর প্রতি দিবসটি পালনের আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দেন। দেশের ‘লুণ্ঠিত গণতন্ত্র’ উদ্ধারে পরদিন দুপুরে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সবাইকে সমবেত হওয়ার জন্য আহ্বান জানান তিনি। ওই বিবৃতিতে রীতিমতো জেগে ওঠে ‘পালিয়ে থাকা’ আওয়ামী লীগ।
এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে! শহীদ নূর হোসেন দিবস, লুণ্ঠিত গণতন্ত্র! গণতন্ত্রের গর্বিত ধারক ও বাহক হিসেবে আচমকা জেগে ওঠা আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা– আপনারা এতদিন কোথায় ছিলেন? নূর হোসেনের বুকে গুলি ছোড়া এরশাদের সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতার সিংহাসনের ওম পাওয়ার সময় কোথায় ছিল এই চেতনা? নাকি সবই কেবল ক্ষমতার প্রয়োজনে! যে-ই সিংহাসনচ্যুত হয়েছেন, অমনি মনে পড়েছে স্বৈরচারবিরোধী উত্তাল রাজপথের শহীদ নূর হোসেনকে। হায়!   
২.
আওয়ামী লীগ রাজপথে জনসাধারণের যে রক্ত ঝরিয়েছে, তার দাগ এখনও টাটকা। এ অবস্থায় দলীয় প্রধানের অজ্ঞাত স্থানে থেকে নেতাকর্মীকে সমবেত হয়ে প্রতিরোধ গড়বার আহ্বান প্রকৃত অর্থে অন্তঃসারশূন্য আস্ফালন। কিন্তু একচক্ষু হরিণের মতো এ দেশের ‘একচক্ষু রাজনীতি’ অন্ধ মহিষের মতো দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বিএনপি, জামায়াত, শিবিরসহ উৎসুক জনতা ১০ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে যেভাবে রাজধানীর নানা প্রান্তে পাহারার তোড়জোড় শুরু করে তাতে মনে হয়, আওয়ামী লীগের লাখ লাখ কর্মী সারাদেশ থেকে ঢাকায় আসতে শুরু করেছে! ১০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউসহ বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ সন্দেহে অনেককে মারধর ও লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে। রীতিমতো ‘মবতন্ত্র’ যাকে বলে– ওই যে লীগ যায়! বেশ; তাকে ধরে কয়েকজন মিলে আচ্ছামতো ধোলাই। সভ্য সমাজে আইন কেন এভাবে নিজের হাতে তুলে নিতে হবে? প্রতিটি অপরাধের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন এ দেশে আছে। যথাযথ আইন প্রয়োগের দায়িত্ব সরকারের। অপরাধীকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। এটাই সভ্যতা।
৩.
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ‘মব’ তৈরির অপচেষ্টা চোখে পড়ছে। শিল্পকলা একাডেমিতে দেশ নাটকের ‘নিত্য পুরাণ’ প্রদর্শনী বন্ধের প্রতিবাদে গত সপ্তাহে নাট্যকর্মীদের প্রতিবাদী সমাবেশে হামলার চেষ্টা করে উচ্ছৃঙ্খল জনতা। বলা হয়, গত পনেরো বছর নাট্যকর্মীরা ফ্যাসিবাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কাজেই নাটক করবার আগে তাদের ক্ষমা চাইতে হবে! যে কোনো একজন ঘোষণা দিয়ে দিচ্ছেন– নাট্যকর্মীরা সব ফ্যাসিবাদী। ব্যস, হয়ে গেল! সেই লোক নিজেই ওঝা। নিজেই সাপ। নিজেই কামড়ে দেবে। আবার নিজেই চিকিৎসা করবে। বাহ!
যা ইচ্ছা তা-ই বলবার নাম গণতন্ত্র নয়। ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বলে সমাজের নানা স্থানে যে বিভাজন তৈরির অপচেষ্টা চলছে; এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কী? দেশে আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী সংখ্যা কত? বড় দুটি দল– আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অন্ততপক্ষে ৫০ লাখ করে সক্রিয় কর্মী আছে বলে আমাদের ধারণা। আরও আছে সরব ও নীরব সমর্থক। রাজনৈতিক দল হিসেবে বড় ব্যর্থতার পরও বহু মানুষ এখনও আওয়ামী লীগের সমর্থক। দেশ থেকে এদের সবাইকে বের করে দেওয়ার প্রস্তাবও কি আগামী দিনে আসবে? এটি আদৌ সম্ভব নয়। সব মত ও পথের মানুষ নিয়ে সচল ও সমৃদ্ধ হয় সমাজ। কাউকে কোনো ‘ট্যাগ’ দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার চেষ্টা অতীতে যেমন সফল হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। মাঝখান দিয়ে একচক্ষু রাজনীতির অন্ধ মহিষের ছোটাছুটিতে সমাজে তৈরি হবে অস্থিরতা, মব আতঙ্ক, অবিশ্বাস। গণতান্ত্রিক উদার সমাজ তৈরিতে যুক্তিহীন ‘একচক্ষু রাজনীতি’ সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক 
[email protected]