মানুষের উদ্বেগ দূর করতে হবে

মোনায়েম সরকার
  ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪:৫৪

আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচারের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করতে হলে, বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা নিশ্চিত করতে হবে। একদিকে, আদালতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; অপরদিকে, বিচারপ্রার্থীদের এবং সংশ্লিষ্টদের প্রতি ন্যায্য ও অবিচল সেবা প্রদান একে অপরকে পরিপূরক করে।
প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে এমন একটি বিবৃতি খুব জরুরি ছিল। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ তা করেছেন। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এবং তার অঙ্গনের নিরাপত্তা ও মান নিয়ে বিভিন্ন মহলে কিছু সংশয় যে দেখা দিয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না।
সুপ্রিম কোর্টে নজিরবিহীন ঘটনা ও জেলা আদালতে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতি ২৭ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যে নজিরবিহীন অনভিপ্রেত ঘটনাবলি সংঘটিত হয়েছে এবং দেশের জেলা আদালতসমূহে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে— সেসব বিষয় সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। দেশের আদালতসমূহ যাতে বিচারপ্রার্থীদের নির্বিঘ্নে বিচারসেবা দিতে পারে, সে লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট সামগ্রিক বিষয়াবলি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সুপ্রিম কোর্ট এই মর্মে আশ্বস্ত করছে যে, সব প্রতিকূলতা ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সত্ত্বেও দেশের আদালতসমূহে বিচারসেবা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। প্রধান বিচারপতি দেশের আদালতগুলোতে এরূপ পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি রোধ করতে ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং দেশের সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালকে তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রেখে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বিচারপ্রার্থী জনগণকে বিচারসেবা দেওয়ার ধারা অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন।

প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে এমন একটি বিবৃতি খুব জরুরি ছিল। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ তা করেছেন। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এবং তার অঙ্গনের নিরাপত্তা ও মান নিয়ে বিভিন্ন মহলে কিছু সংশয় যে দেখা দিয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না।


প্রধান বিচারপতির বিবৃতিতে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংকেত দেওয়া হয়েছে। উদ্বেগ প্রকাশের মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণসহ দেশের জেলা আদালতগুলোতে ঘটে যাওয়া নজিরবিহীন ঘটনা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির প্রতি গভীর মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। গত ২৭ নভেম্বর, হাইকোর্ট বেঞ্চে ঘটে যাওয়া ডিম নিক্ষেপের ঘটনা এবং বিচারকদের বেঞ্চ থেকে সরে যেতে বাধ্য করা, চট্টগ্রামে আদালত এলাকায় একজন আইনজীবীকে প্রকাশ্যে হত্যা খারাপ পরিস্থিতির দুটি উদাহরণ। এসব ঘটনা শুধু আইনজীবী বা বিচারকদের জন্যই নয়, বরং আদালতের সর্বস্তরের কর্মচারী এবং সাধারণ জনগণের জন্যও উদ্বেগজনক।
প্রধান বিচারপতির দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্ট ও দেশের প্রতিটি আদালতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যা বিচারপ্রার্থীদের নির্বিঘ্নে বিচার সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অঙ্গ, এবং এর সুষ্ঠু কার্যক্রম এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আইনের শাসন বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত জরুরি। তার নির্দেশনায় বিচারকদের এজলাস, বাসভবন এবং আদালত প্রাঙ্গণের নিরাপত্তা রক্ষা করার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা আদালতের ভাবমূর্তি এবং জনগণের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচারের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করতে হলে, বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা নিশ্চিত করতে হবে। একদিকে, আদালতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; অপরদিকে, বিচারপ্রার্থীদের এবং সংশ্লিষ্টদের প্রতি ন্যায্য ও অবিচল সেবা প্রদান একে অপরকে পরিপূরক করে। সুতরাং, প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা শুধু একটি জরুরি পদক্ষেপই নয়, বরং বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে আরও দৃঢ়, সুশৃঙ্খল এবং শক্তিশালী করার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
দুই.
গত কয়েক দিনে দেশে একের পর এক এমন সব সংঘাতময় ঘটনা ঘটে চলেছে, যা জনমনে আশঙ্কা এবং হতাশা তৈরি করেছে। পুরান ঢাকার রাস্তাগুলো কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়া থেকে শুরু করে চট্টগ্রামে সহকারী সরকারি কৌঁসুলি সাইফুল ইসলামের নৃশংস হত্যাকাণ্ড— এসব ঘটনা কেবল বিচ্ছিন্ন নয় বরং একটি বৃহত্তর অস্থিরতার অংশ বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক ।
সরকারের একাংশ মনে করে, এগুলো পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল। অথচ এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসনের এক ধরনের শৈথিল্য ও গোয়েন্দা তৎপরতার ব্যর্থতার অভিযোগ সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষীদের পক্ষ থেকেও তোলা হচ্ছে। প্রশাসনের দুর্বল পদক্ষেপ, আগাম সতর্কতার অভাব এবং সঠিক সময়ে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা দিচ্ছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নমনীয় নীতিমালা হয়তো সংঘাত এড়ানোর জন্যই হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে নমনীয়তার নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, কিন্তু এর ফলে সরকার দুর্বল বলেও জনমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। সরকার ও প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো নিজেদের ‘দুষ্ট’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সক্রিয় হচ্ছে বলে মনে করা স্বাভাবিক। চট্টগ্রামের আইনজীবী হত্যা কিংবা বা শাহবাগে সারাদেশ থেকে ঋণ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে লোক জমায়েতের মতো ঘটনাগুলোতে গোয়েন্দা ত্রুটি স্পষ্ট।
জনগণের সচেতনতা ও রাজনৈতিক নেতাদের উদ্যোগী ভূমিকাই পারে যে কোনো নাজুক পরিস্থিতি সামাল দিতে। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ এবং বিভিন্ন শক্তির ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করাই হবে স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে বড় গ্যারান্টি।
তিন.
দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি করতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। বিএনপি মহাসচিব উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, দেশে পরিকল্পিতভাবে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা চলছে, যার ফলস্বরূপ ফ্যাসিবাদের ফিরে আসার আশঙ্কা বেড়ে গেছে। তার এই মন্তব্যের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অস্থিরতা, বিভাজন এবং সংকটের নানামুখী চিত্র ফুটে উঠেছে ।
মাত্র সাড়ে তিন মাস আগে ছাত্র- জনতার সাহসী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ এক চরম দু্র্নীতিবাজ ও কর্তৃত্ববাদী শাসকের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে। বৈষম্য মুক্ত একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এখনো উজ্জ্বল ছাত্র-জনতার চোখে মুখে। এই অবস্থায় দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের অন্যতম প্রধান নেতা যখন ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তখন রাজনীতি সচেতন মানুষ নড়েচড়ে না বসে পারেন?
ফ্যাসিবাদ ও একনায়কতন্ত্রের আশঙ্কা শুধু রাজনৈতিক দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি দেশের জাতীয় সুরক্ষা ও গণতন্ত্রের জন্যও একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হতে পারে। মির্জা ফখরুলের ভাষায়, রাজনৈতিক সহিংসতা, যুদ্ধ এবং রক্তপাতের পরিস্থিতি ঘোরালো ও অশান্ত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করছে, যেখানে জনগণের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা সংকুচিত হতে পারে। এর সঙ্গে, নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে, যেখানে তিনি নির্বাচনকে গণতন্ত্রের সূচক হিসেবে নয়, বরং একটি প্রক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
সবাইকে এটা মনে রাখতে হবে যে, বর্তমান সময়টা অত্যন্ত সংবেদনশীল। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিভাজন থেকে রক্ষা পেতে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং একনায়কতন্ত্রের পুনরাবর্তন রোধ করার জন্য সতর্কতা ও সহমত প্রতিষ্ঠা করা এখন অত্যন্ত জরুরি । এটাও মনে রাখতে হবে যে অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে পরাজিত শক্তির পুনরুত্থানের পথ মসৃণ হবে। আমাদের দেশের রাজনীতিতে এক পক্ষের ব্যর্থতা অন্য পক্ষের সফলতার কারণ হয়।