বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ ঘিরে প্রতিবাদ-পাল্টা প্রতিবাদ বেড়েই চলেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী ভারতের মধ্যে তর্কযুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে।
৫ আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান (তিনি এখন দিল্লিতে)। তার পর থেকে প্রতিবেশী ও এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্রের মধ্যে দেশটির কূটনৈতিক সম্পর্ক অস্বস্তিকর পর্যায়ে আছে।
গত সপ্তাহে একজন হিন্দু সাধুকে গ্রেপ্তার করার মধ্য দিয়ে উত্তেজনায় নতুন কারণ যুক্ত হয়। এ ঘটনায় ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সদস্যসহ হিন্দু সংগঠনের কর্মী ও অন্যান্য রাজনীতিবিদ বিক্ষোভ করেছেন। সোমবার ভারতের জন্য এক বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয়। ডজন খানেক বিক্ষোভকারী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর আগরতলায় বাংলাদেশের কনস্যুলেটে জোর করে ঢুকে পড়ে এবং ভাঙচুর চালায়। কয়েক ঘণ্টা পর কনস্যুলেটে হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় শত শত ছাত্র ও কর্মী বিক্ষোভ করে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ঘটনাটি ‘অত্যন্ত দুঃখজনক’। এই বলে ভারত সরকার নিজেদের হামলা থেকে দূরে রাখতে চেয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘কূটনৈতিক ও কনস্যুলার সম্পত্তি কোনো অবস্থাতেই লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়। সেই সঙ্গে বলা হয়, তারা বাংলাদেশের কূটনৈতিক ভবনের নিরাপত্তা জোরদার করছে। এ ঘটনায় ভারতের পুলিশ সাতজনকে আটক করলেও ঢাকা এখনও উত্তাল।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই হামলা ‘জঘন্য’ বলে মন্তব্য করেছে। আর দিল্লিকে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে ‘বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের বিরুদ্ধে আর কোনো ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ করার’ আহ্বান জানিয়েছে। ‘এটি অত্যন্ত নিন্দনীয় ও অগ্রহণযোগ্য ঘটনা... হিন্দু উগ্রপন্থিরা ভেতরে ঢুকে পতাকা টেনে নামিয়ে দেয় এবং বাংলাদেশের পতাকা অপবিত্র করে। এতে আমাদের কর্মকর্তা ও অন্যান্য কর্মী অত্যন্ত আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে।’ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বিবিসিকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, বেশ কয়েকটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের বিভ্রান্তিকর ও উত্তেজনা উস্কে দেওয়া খবরে ভারতে বিক্ষোভ দেখা দেয়। কিছু বিক্ষোভ দুটি দেশের সীমান্ত এলাকায়ও ঘটেছে। তবে ভারতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের উত্তেজনা প্রতিবেশী দেশে প্রভাব ফেলবে। এটাই স্বাভাবিক।
ভারতের জন্য বাংলাদেশ শুধু প্রতিবেশী দেশ নয়। এটি এক কৌশলগত অংশীদার এবং ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত সম্পর্কও রয়েছে। বাংলাদেশের মোট ১৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে হিন্দু জনগোষ্ঠী ১০ শতাংশেরও কম। এই জনগোষ্ঠীর নেতারা দীর্ঘদিন ধরে ইসলামপন্থি ও কিছু রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও বিদ্বেষমূলক হামলার অভিযোগ করে আসছেন। ৫ আগস্টে হাসিনার বিশৃঙ্খলভাবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাঁর অনেক সমর্থককে নিশানা করা হয়েছিল, যার মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও আছেন, যাদের ঐতিহ্যগতভাবে তাঁকে সমর্থনকারী হিসেবে দেখা যায়।
তুলনামূলক গত কয়েক সপ্তাহ শান্ত থাকার পর হিন্দু নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের পর পরিস্থিতি আবার উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অক্টোবর মাসে চট্টগ্রামে সংখ্যালঘুদের অধিকারের দাবিতে বিক্ষোভের পর তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ওপরে একটি গেরুয়া পতাকা, রংটি হিন্দু ধর্মের সঙ্গে জড়িত– তোলার অভিযোগ আনা হয়েছিল।
গত সপ্তাহে চট্টগ্রামের আদালতে তাঁর জামিন নাকচ হয়। তখন সংঘর্ষে একজন মুসলিম আইনজীবী নিহত হওয়ার পর হত্যা ও সহিংসতার ঘটনায় কয়েক ডজন লোককে গ্রেপ্তার করা হয়। মঙ্গলবার কোনো আইনজীবী তাঁর প্রতিনিধিত্ব করতে না আসায় চিন্ময়ের শুনানি ২ জানুয়ারি নির্ধারিত হয়।
চিন্ময় দাস এর আগে ধর্মীয় সংগঠন ইসকনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে ঢাকার ইসকনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, ভিক্ষুকে এই বছরের শুরুতে আইনশৃঙ্খলাজনিত কারণে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। চিন্ময় দাস কারাগারে রয়েছেন। একজন সমর্থক চিন্ময়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অসম্মানের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাঁর গ্রেপ্তারের ঘটনা বাংলাদেশের উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশকে আরও ঘোলা করেছে। ইসকনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা ‘আতঙ্কে বসবাস করছে’। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মতে, তারা স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে সচেতন এবং সরকার সব সম্প্রদায়ের প্রতি সমান আচরণ করে। তবে ধর্মীয় উত্তেজনা এই অঞ্চলে নতুন নয় এবং উভয় পক্ষের কর্মীরা উদ্বিগ্ন। যদি উত্তেজক বক্তৃতা ও প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে, তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
ভারতে হাসিনার অবস্থান ইতোমধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় ঝামেলার কারণ হয়ে উঠেছে এবং উভয় দেশেই ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশ প্রতিবেশী। এখন সময় এসেছে দেশ দুটির উত্তেজনা নিরসন করে একে অপরকে কাছে টেনে নেওয়ার।
আনবারাসান এথিরাজান: বিবিসির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সম্পাদক; বিবিসি নিউজ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম