সহজ ছিল না আমাদের স্বাধীনতা। ৯ মাসব্যাপী রক্তস্নাত সংগ্রামে জড়িয়ে আছে লাখ লাখ মানুষের ব্যথা-বেদনা ও সীমাহীন দুর্ভোগের আখ্যান। সবুজ-শ্যামল মায়াভরা পলল মাটির এ বদ্বীপকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যত প্রাণ দিতে হয়েছে, যত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে ও যত দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে; সভ্যতার ইতিহাসে এমন নজির বেশ কম।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে শুরু করে বাঙালি নিধন মিশন। ওই রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, তা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য শহর ও গ্রামগঞ্জে। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয় তাদের দেশীয় দোসর আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী। একযোগে শহর থেকে গ্রাম; দেশব্যাপী নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর চালায় গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, নির্যাতন।
জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচাতে লাখ লাখ মানুষ হন্যে হয়ে ছোটে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। মাইলের পর মাইল নৌকা করে, পায়ে হেঁটে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতারা ছুটেছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কারও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, শেষ সম্বল বলতে তেমন কিছু নেই। কোনো মতে জীবনটা হাতে নিয়ে পালিয়েছে, কারও মাথায় ছোট ট্রাঙ্ক, কোলে-কাঁধে অবুঝ শিশু, পুরুষ কিংবা শিশুর গায়ে কাপড় আছে কিংবা নেই। নারীরা এক কাপড়ে ঘর থেকে হয়তো বের হতে পেরেছে। কারও কাছে শুকনো খাবার, টিনের জারে অল্প চিড়া-মুড়ি। পিঁপড়ার সারির মতো শুধু ছুটছে আর ছুটছে। মার্চের শেষের দিক থেকে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আগ পর্যন্ত ছিল শরণার্থীর ঢল।
বাস্তুহারা, প্রিয়জনহারা সহায়-সম্বলহীন লাখ লাখ বাঙালির গন্তব্য হয়ে ওঠে প্রতিবেশী ভারত। ভারত ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘ যে সীমান্ত, দিশেহারা বাঙালিরা যে যেভাবে পেরেছে ওই সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেছে। মূলত পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম, মধ্যপ্রদেশ, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং ভারতের অন্যান্য স্থানে আশ্রয় নেয় তারা। সীমান্ত এলাকায় স্থানীয়দের চেয়ে এ সময় শরণার্থীরাই হয়ে উঠেছিলেন সংখ্যাগুরু।
জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) হিসাব মতে, ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫। এর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল হিন্দু। ইউএনএইচসিআরের প্রধান প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান তখন এ শরণার্থী সমস্যাকে জাতিসংঘের সামনে সমসাময়িক কালে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
১৯৭১-এ ভারতে আশ্রয় নেওয়া ১ কোটি শরণার্থীর প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় ‘অক্সফাম’ ওই বছরের অক্টোবরে ‘দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি’ নামে প্রচারপত্র তৈরি করে। সেখানে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘মানুষের অন্তহীন স্রোত। এরা সব শরণার্থী। আমরা ৫০০ গরুর গাড়ি গুনলাম। গাড়ির দুই পাশে হেঁটে চলা মানুষ। তারা দ্রুত হাঁটতে চেষ্টা করছে। হাত ওপরে তুলছে এবং চিৎকার করতে শুরু করেছে। মনে হলো, তাদের দুরবস্থার কথা আমাদের জানাতে তারা উদগ্রীব। কয়েকজন দৌড়ে আমাদের কাছে এসে যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে আঙুল তুলে বলতে শুরু করল। যদিও আমরা কেউ বাংলাভাষী নই। তবুও তাদের কথা বুঝতে আমাদের সমস্যা হলো না। যে গ্রাম ছেড়ে তারা আসতে বাধ্য হয়েছে, তা আগুনে পুড়ছে। সাদা চুলের একজন বুড়ো মানুষ আকাশের দিকে হাত তুলে কেঁদে উঠল। অঙ্গভঙ্গিতে আমাদের জানাল, তার ৮টি সন্তানের সবকটি নিহত হয়েছে।’
শরণার্থী শিবিরে রোগে-শোকে-ক্ষুধায় প্রাণ হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহাদুজ্জামান এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটারএইডের আঞ্চলিক পরিচালক খায়রুল ইসলাম যৌথ এক গবেষণায় দেখান, ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১ কোটি শরণার্থীর মধ্যে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ৩ লাখ, যার মধ্যে ২ লাখ ৩৭ হাজারেরও বেশি ছিল ৫ বছরের কম বয়সী শিশু।
পাঁচ দশক পেরিয়ে এলেও মুক্তিযুদ্ধের গৌরব, অহংকার ও বেদনামাখা স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস এখনও আমরা সঠিকভাবে তুলে আনতে পারিনি। গৃহহীন, সহায়-সম্বলহীন ১ কোটি শরণার্থীর মানবিক বিপর্যয়ের করুণ আখ্যান ঠিকমতো লিপিবদ্ধ করা যায়নি। একে কোটি মানুষের জীবন-যন্ত্রণার দগদগে ক্ষত স্বাধীনতা ইতিহাসেরই অমূল্য অর্ঘ্য। বিশ্বজুড়ে নানা প্রান্তে দেশ হারানো কিংবা দেশ ছাড়া হওয়া মানুষের অসংখ্য গল্প আছে। তবে এই বাংলার শরণার্থী হওয়া কোটি মানুষের জমাট বেদনার মতো তা আর এত বড় নয়।
২৪-এর গণঅভ্যুত্থান সামনে রেখে পেছন ফিরে আমাদের অহংকার ও গৌরবের একাত্তরের নির্মম বাস্তবতাকে তার প্রাপ্য সম্মান বুঝিয়ে দিতে যেন আমরা পিছপা না হই।
সূত্র : সমকাল