রাজনীতিতে ইউরেনিয়াম ও তেজস্ক্রিয় রসিকতা

সাইফুর রহমান তপন
  ১২ অক্টোবর ২০২৩, ১২:১৪
সেতুমন্ত্রী ওবায়েদুল কাদের ও মির্জা ফখরুল ইসলাম

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কি ইদানীং একটু ‘রসিক’ হওয়ার চেষ্টা করছেন? নাকি রূপপুর পরমাণুকেন্দ্রের জন্য সদ্য আসা ইউরেনিয়ামের গর্ব তাঁকে উত্তপ্ত ও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাঁর রসকষের প্রমাণ দিতেই কিনা সম্প্রতি বলেছেন, ‘দুই চালান ইউরেনিয়াম এসেছে। বেশি লাফালাফি করলে কিছু মির্জা ফখরুল, কিছু মঈন খান, কিছু মির্জা আব্বাস এবং কিছু রিজভীর মাথায় দিয়ে দেব। এখন ডান্ডা মেরে নয়, ইউরেনিয়াম দিয়ে ঠান্ডা করে দেব।’ (সমকাল, ১০ অক্টোবর, ২৩)। কথাটা শুনে মানুষ অবাক হয়েছে। সোমবার রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশে তিনি এমন কথা বলেন।
গত ৫ অক্টোবর রাশিয়া থেকে আসা পরমাণু চুল্লির জ্বালানি ইউরেনিয়াম রুশ কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করে। এ প্রসঙ্গে একই দিন কুমিল্লার এক সমাবেশে বলতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইউরেনিয়ামকে একটা ‘কেমিক্যাল’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, পারমাণবিক চুল্লিতে বিস্ফোরণ ঘটলে মাইলের পর মাইল ধ্বংস হয়ে যাবে। এর আগের দিন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খানও রাজধানীতে দলের এক অনুষ্ঠানে পারমাণবিক কেন্দ্রের বিপজ্জনক দিক সম্পর্কে বলে রূপপুর কেন্দ্র নিয়ে সরকারের গর্ব করার কড়া সমালোচনা করেছিলেন। রাজনীতিতে সমালোচনা ঠিকও হয়, আবার বেঠিকও হয়। হয়তো বিএনপি নেতাদের আশঙ্কা পুরোপুরি ঠিক নয়। তাই বলে সমালোচকদের মাথায় ইউরেনিয়াম ‘ঢেলে’ দেওয়ার হুমকি কি গ্রহণযোগ্য?
প্রথমত, মির্জা ফখরুলের মতো ওবায়দুল কাদেরও সম্ভবত ভুল করে ইউরেনিয়ামকে ধাতুর বদলে নিছক একটা কেমিক্যাল ভেবেছেন, যে কারণে ঢেলে দেওয়ার কথা বলেছেন। ইউরেনিয়াম একটা সলিড বা কঠিন পদার্থ, কোনো তরল নয়; অতএব তা হয়তো ছুড়ে দেওয়া যায়, ঢেলে দেওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, ইউরেনিয়াম একটা অত্যন্ত তেজস্ক্রিয় পদার্থ। তেজস্ক্রিয় রশ্মি প্রতিরোধক বিশেষ পোশাক ছাড়া এর কাছে যাওয়া যায় না। কারণ কারও শরীরে এ রশ্মি ঢুকলে তা ওই দেহে প্রাণনাশী ক্যান্সারের কারণ ঘটাতে পারে, যার পরিণাম ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু। এখন একজন সমালোচনা করেছেন বলে তাঁকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হবে? ধুঁকে ধুঁকে মরার মতো কোনো কোনো কষ্ট আছে, যার সম্মুখীন হওয়ার পর অনেককেই প্রার্থনা করতে শোনা যায়– আল্লাহ, আমার অতি বড় শত্রুকেও এমন কষ্ট দিও না। এই সামাজিক সংস্কৃতিও কি আজ রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে লোপ পেতে চলেছে?
এর আগে গত ৩ অক্টোবর মঙ্গলবার সরকারের ওপর মার্কিন চাপ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সাভারের আমিনবাজারের এক সমাবেশে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘তলে তলে আপস হয়ে গেছে। আমেরিকার দিল্লিকে দরকার। দিল্লি আছে, আমরাও আছি। শেখ হাসিনা সবার সঙ্গে ভারসাম্য করে ফেলেছেন। আর কোনো চিন্তা নেই। যথাসময়ে নির্বাচন হবে।’ (সমকাল, ৪ অক্টোবর, ২৩)। তাঁর এ ‘তলে তলে’ কথাটা অনেকেরই কানে বাজে। এ ধরনের কথা সাধারণত একজন আরেকজনের সঙ্গে রসিকতা বা ইয়ার্কি করতে গিয়ে ব্যবহার করে। যেমন কেউ কোনো বিষয়ে কারও দ্বিচারিতা বোঝাতে বলে– ও তুমি তাহলে ‘তলে তলে টেম্পো চালাও’! ষড়যন্ত্র বোঝাতেও কিন্তু এ কথাটা আকছারই ব্যবহৃত হয়।
দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদের মুখে এমন বচন শুনতে মানুষ তাই খুব একটা অভ্যস্ত নয়। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপসের কথা বলতে গিয়ে যে দুই ঘটনার প্রসঙ্গ তিনি টেনেছেন, তাতে যুক্ত ছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওবায়দুল কাদের দিল্লিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সেলফির কথা বলেছেন এবং সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন শেষে প্রধানমন্ত্রীর ওয়াশিংটনে অবস্থানকালে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসে তাঁর সঙ্গে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের বৈঠকের কথা বলেছেন। আর যা হোক, অন্তত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো ঘটনা প্রসঙ্গে একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও নেতা এ ভাষায় কথা বলতে পারেন বলে মনে হয় না। স্বাভাবিকভাবেই পরদিন অর্থাৎ ৫ অক্টোবর সচিবালয়ে সাংবাদিকরা ওবায়দুল কাদেরের কাছে বিষয়টি জানতে চান। তখন তিনি বলেছেন, জনসমাবেশে ‘পাবলিক খায়’ বলেই তিনি এমন কথা বলেছেন। তাঁর বহুলচর্চিত ‘খেলা হবে’ স্লোগানের নেপথ্যেও নাকি একই কারণ।
জনসভা-জমায়েতে রাজনৈতিক নেতারা নানা ধরনের সত্য-মিথ্যা গল্প ফাঁদেন; অনেক সময় এমনকি আদি রসাত্মক কৌতুকও বলে থাকেন। যদি তা কারও জন্য অপমানজনক বা বড় কোনো ক্ষতির কারণ না হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ ওই গল্প ও কৌতুকের রসটা নিয়ে ছোবড়াটা ফেলে দেয়। রসিকতার ছলে এমন কথা সরকার সম্পর্কে জনতাকে ভুল বার্তা দেয়। আসলে রাজনীতিতে যখন অতিকথন বা পাবলিককে ‘খাওয়ানো’র রোগ বিস্তার লাভ করে, তখনই নেতাদের মধ্যে এমন সব প্রবণতা প্রাধান্য পায়। কিন্তু তা যদি চলতেই থাকে, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অপূরণীয় ক্ষতিই শুধু হবে না, তাঁদের অনুসারীরা অতি উৎসাহী হয়ে রেষারেষির মাত্রাটা আরও বাড়িয়ে দেবেন। তাতে দেশটা আরও রসাতলেই যাবে। 
সাইফুর রহমান তপন