রাজনীতিতে পরজীবীদের দৌরাত্ম্য

সাইদুর রহমান
  ৩১ অক্টোবর ২০২৩, ২০:৩১

যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী, রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট রিচার্ড এস কিনিক ফ্রিডম্যানের বিখ্যাত উক্তি, ‘পলিটিকস’ শব্দের ‘পলি’র অর্থ একাধিক এবং ‘টিকস’ অর্থ ‘রক্তচোষা পরজীবী’। অর্থাত্, পলিটিকসের মধ্যে যে রক্তচোষা পরজীবী শ্রেণির অস্তিত্ব রহিয়াছে, তাহা চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া গিয়াছেন বিখ্যাত ডিটেকটিভ ফ্রিডম্যান। প্রশ্ন হইল, কাহারা এই রক্তচোষার দল? চক্ষু বন্ধ করিয়াই বলিয়া দেওয়া যায়, ইহারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে অনুপ্রবেশ করিয়া ঘাপটি মারিয়া থাকা এমন এক গোষ্ঠী, যাহাদের লালনপালন, ভরণপোষণ করিয়া থাকেন একশ্রেণির নেতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ আমলাদের কেহ কেহ। রাজনীতিতে এই ধরনের চিত্র অধিক লক্ষণীয়, বিশেষ করিয়া উন্নয়নশীল বিশ্বে। আমাদের দেশের চিত্রও অতি প্রকট। রাজনীতি এবং নির্বাচনের মাঠে হানাহানি-সংঘাত-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে ইহাদের হাত রহিয়াছে—এমন কথা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। প্রতিটি রাজনৈতিক দলে ইহাদের অবাধ বিচরণ রহিয়াছে এবং ইহারাই সুযোগ বুঝিয়া নির্বাচনের মাঠকে উত্তপ্ত করিয়া তোলে অতি উত্সাহীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়া। ইহাদের কর্মফলে রাজনৈতিক দলগুলির যে কী পরিমাণ অপূরণীয় ক্ষতি হইতে পারে, কী ধরনের ট্র্যাজেডি ঘটিতে পারে, তাহার জলজ্যান্ত নজির রহিয়াছে বইকি। প্রয়াত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এই অশনিসংকেতের ভবিতব্য সম্পর্কে বারবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন অত্যন্ত কড়া ভাষায়। তথাপি অনুপ্রবেশের করাল গ্রাসের শিকার রাজনৈতিক দলগুলির শীর্ষ মহলের কর্ণকুহর পর্যন্ত তাহা পৌঁছাইয়াছে বলিয়া মনে হয় না।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অতি সন্নিকটে। ইহা লইয়া দেশে স্বভাবসুলভ নির্বাচনি উত্তাপ বহিয়া যাইতেছে; কিন্তু অধিক লক্ষণীয়, বিশেষ করিয়া ক্ষমতাসীন দলে অনুপ্রবেশ করা উঠতি বা পাতিনেতাদের দৌরাত্ম্যে বিভিন্ন অঞ্চলে পরিস্থিতি ক্রমশ ‘অরাজক’ হইয়া উঠিতেছে। দলের নাম ভাঙাইয়া মাদক ব্যবসায়, চাঁদাবাজিসহ অবৈধ সকল উপায়ে অর্থ ও সুবিধা হাসিল করিয়া রাতারাতি নেতা বনিয়া যাওয়া এই পরজীবীদের দাপটে সুস্থধারার রাজনৈতিক নেতারা কেবল কোণঠাসাই হইতেছেন না, বাধ্য হইতেছেন অত্যাচার-অনাচারে ঘর ও এলাকাছাড়া হইতে। পুলিশ-প্রশাসন এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিচার বিভাগের একশ্রেণির কর্মকর্তাকে অর্থের বিনিময়ে ‘ম্যানেজ’ করিয়া হেন কোনো অপরাধ, অপকর্ম নাই, যাহা তাহারা করিতেছে না। অতি নগণ্য, বানোয়াট অভিযোগ দেখাইয়াই জেলে ভরা হইতেছে অন্য দলের নেতাকর্মীকে। নির্বিচার জেল-জুলুমের শিকার হইয়া শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সম্মুখীন গ্রামগঞ্জের বহু নেতাকর্মী। এমনও পরিলক্ষিত হইতেছে, থানায় জিডি থাকিলেই পুলিশ তুলিয়া লইয়া যাইতেছে নেতাকর্মীকে। ইহা সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিপন্থি।
নির্বাচনের মাঠে সকল দলের নেতাকর্মী নির্বিঘ্নে কাজ করিবার সুযোগ-সুবিধা পাইবে—নিয়ম ইহাই। অথচ ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙাইয়া পুলিশ প্রশাসনকে অবৈধভাবে ব্যবহার করিয়া তাহাদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন চালানো হইবে এবং তাহাদের থামাইবার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হইবে না—ইহাকে কি রাজনীতির অংশ হিসাবে গণ্য করা যায়? দুঃখজনক সত্য হইল, টাকা খাইয়া অযাচিতভাবে মামলা দিতেছে পুলিশ, আর কোর্ট তাহাদের জামিন আটকাইয়া দিতেছে—ইহা তো অসুস্থ ব্যবস্থার লক্ষণ! নির্বাচনকালীন এহেন পরিস্থিতিতে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিতে কতক্ষণ? এইরূপ পটভূমিতে দাঁড়াইয়া ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ ব্যক্তির উদ্দেশে আমরা বলিতে চাহি, অন্তত একবার হইলেও খোঁজ লইয়া দেখুন, ঐ সকল অঞ্চলে কী চলিতেছে। নিরপেক্ষ জায়গায় দাঁড়াইয়া অনুধাবন করুন, কতটা আগ্রাসি হইয়া উঠিয়াছে দলে অনুপ্রবেশকারীরা।
উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য দুঃখ হইল, এইখানকার রাজনীতিতে ইহারা একেবারে শিকড় অবধি বিস্তার লাভ করিলেও সময় থাকিতে সতর্ক হন না, বিশেষত সরকারি দল। ফলে একটা সময়ে আসিয়া বরণ করিতে হয় বিজ্ঞানী ফ্রাংকেনস্টাইনের ন্যায় পরিণতি—তিনি যাহাকে গড়িয়া তুলিলেন, তাহার কারণেই খুয়াইলেন সর্বস্ব। সুতরাং, প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে অনুপ্রবেশকারী, সুবিধাভোগীদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করিতে হইবে। ক্ষমতাসীন দলের জন্য ইহা অধিক প্রযোজ্য—যদিও সময় চলিয়া গিয়াছে বেশ খানিকটা! দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নাই—এই ধরনের কথা যখন উঠিতেছে, তখন স্বভাবতই ভাবিতে হইবে, কাহাদের অপকর্মের কারণে নির্বাচনি পরিবেশ বিনষ্ট হইতেছে? নিরপেক্ষতার জায়গায় দাঁড়াইয়া বিচার করিলেই ইহার সত্যাসত্য খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে।