যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন কেন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় রঙ্গমঞ্চ

ইয়ান বুরুমা
  ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০:১০

শিকাগোতে মাত্রই ডেমোক্রেটিক পার্টির কনভেনশন তথা বিশাল এক জমকালো শো বা প্রদর্শনী হয়ে গেল। এই শোতে সবই ছিল: চোখধাঁধানো মনরাঙানো গানবাজনা ছিল। রক্ত গরম করা বক্তৃতা ছিল। ভক্তিপূর্ণ ধর্মীয় আচার ছিল। অশ্রুর বন্যা ছিল। আশা মোড়ানো প্রতিশ্রুতি ছিল। আনন্দময় মুহূর্ত ছিল। অপরাহ উইনফ্রে (বিশ্বখ্যাত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব) ছিল। আর ছিল অগণিত রংবেরঙের বেলুন।
কনভেনশনে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস যেভাবে নিজেকে ‘উপস্থাপন’ করেছেন, টেলিভিশন ভাষ্যকারেরা তার বিস্ময়কর বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁদের সেই বর্ণনায় সব ছিল। কমলার হাসি, তাঁর শারীরিক ভাষা, তাঁর কণ্ঠ মাধুর্য, এমনকি তাঁর পোশাকের রুচিজ্ঞান পর্যন্ত বাদ পড়েনি।
তো স্বৈরশাসন বা গণতন্ত্র—যেখানকার কথাই বলুন, রাজনীতিতে আসলে সব সময়ই প্রদর্শন প্রবণতা বা দেখনদারির বিষয়-আশয় থাকে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির সঙ্গে বিচিত্র বিনোদন দীর্ঘদিন থেকে অবিচ্ছেদ্য ব্যাপার হয়ে আছে।
বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক এইচ এল মেনকেন রাজনীতিবিদদের বলা যায় ঘৃণা করতেন। তিনি মনে করতেন, বেশির ভাগ আমেরিকান রাজনীতিকের রাজনীতি-জ্ঞান নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মেলনের একজন দুর্দান্ত পর্যবেক্ষক ছিলেন তিনি। সেই মেনকেন ১৯২৭ সালে লিখেছিলেন, ‘আমার চোখে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও অতুলনীয় প্রদর্শনী মঞ্চ হলো যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন’।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, নির্বাচনে দাঁড়াতে হলে কি প্রার্থীদের তাঁদের পরিবারের প্রতি থাকা ভালোবাসাও মঞ্চে গিয়ে দেখাতে হবে? মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বামী-স্ত্রী বা স্বজনদের আলিঙ্গন করা ও চুমু খাওয়ার সঙ্গে রাজনীতির কী সম্পর্ক? ভোটারদের মন জয় করার জন্য ব্যক্তিগত আন্তরিকতার বাজারি প্রদর্শন কি আদতেই জরুরি?
হ্যাঁ, আমেরিকায় তো তাই দেখা যাচ্ছে।
গণতন্ত্রে ভোটাররা তাঁদের পছন্দের রাজনৈতিক দল এবং তাঁদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করা প্রার্থীকে ভোট দিয়ে থাকেন। নির্বাচনে ব্যক্তির ক্যারিশমা একধরনের ভূমিকা পালন করে—এটি সত্য। কিন্তু বেশির ভাগ রাজনীতিবিদের মধ্যে একক ব্যক্তিগুণ দিয়ে ভোটার আকৃষ্ট করার ক্ষমতার অভাব আছে।
সাধারণত এশীয় ও ইউরোপীয় রাজনীতিবিদেরা আমেরিকান রাজনীতিবিদদের মতো ভোটের সময় নিজেদের উষ্ণ ও রোমান্টিক মেজাজের মানুষ হিসেবে জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করে আত্মবিক্রয়ে আগ্রহী হন না।
ঐতিহ্যগতভাবে জনগণ রাজা-রানিদের কাছে এ ধরনের ব্যক্তিগত প্রদর্শন প্রবণতা আশা করে। কিন্তু ভোটে নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিজীবনের প্রদর্শনী নিয়ে তাঁদের আগ্রহ খুব একটা থাকে না।
ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যরা নিজেদের উচ্চ স্তরের তথা সাধারণ মানুষের কাতারের বাইরের মানুষ হিসেবে দেখতেন। মানুষও তাঁদের সেইভাবে দেখত।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ বিবিসিকে তাঁর গার্হস্থ্যজীবনের খুঁটিনাটি বিষয় দেখানোর অনুমতি দিয়েছিলেন। বিবিসি রানির ফুলবাগিচার বারবিকিউ থেকে শুরু করে বাচ্চাদের সঙ্গে তাঁর চা খাওয়া পর্যন্ত দেখিয়েছে। রানি সম্ভবত মনে করতেন, জনপ্রিয়তার প্রতীক হিসেবে পৃথিবীতে তাঁর জন্ম হয়েছে।
১৭৭৬ সালে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র থেকে আমেরিকা মুক্ত হলেও হোয়াইট হাউস সেই ব্রিটিশরাজের অনেক আড়ম্বর এখনো ধরে রেখেছে। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্স আরেকটু এগিয়ে আছে। সেখানকার প্রজাতন্ত্র এখনো রাজকীয় জাঁকজমকে মোড়া।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের গদিতে বসার জন্য একজন প্রার্থীকে আধা রাজতান্ত্রিক কায়দায় ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যদের মতো আচরণ করতে হয়। তাঁকে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার-আপনার মতো সাধারণ কোনো লোকের সঙ্গে বিয়ার পান করে সেই দৃশ্যের একটি দুর্দান্ত বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হয়।
যাঁরা প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে আছেন, তাঁরা ভালো করেই জানেন, তাঁরা আমাদের মতো নন। কিন্তু তাঁরাও আমাদের মতো সাধারণ মানুষ—এই ভান তাঁদের করে যেতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের দলীয় কনভেনশন মঞ্চে পরস্পরকে আলিঙ্গন করা, চুমু খাওয়া এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভালোবাসা বিনিময়ের মতো নানা ধরনের আবেগোচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়। একই ধরনের ব্যাপার অন্যান্য আমেরিকান অনুষ্ঠানেও ঘটে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের দলীয় কনভেনশন মঞ্চে পরস্পরকে আলিঙ্গন করা, চুমু খাওয়া এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভালোবাসা বিনিময়ের মতো নানা ধরনের আবেগোচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়। একই ধরনের ব্যাপার অন্যান্য আমেরিকান অনুষ্ঠানেও ঘটে থাকে।
অস্কার পুরস্কার অনুষ্ঠানের কথা ধরা যাক। সেখানে পুরস্কারজয়ী বিদেশি শিল্পীরা দু–এক কথা বলেই তাঁদের বক্তৃতা শেষ করেন। কিন্তু আমেরিকান তারকাদের বেলায় সেটি দেখা যাবে না।
পুরস্কার পাওয়ার পর ট্রফি হাতে মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমেরিকান তারকাদের ছল ছল চোখে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক থেকে বাড়ির পোষা কুকুরকে পর্যন্ত ধন্যবাদ জানাতে হয়; মানবতার প্রতি তাঁদের গভীর ভক্তি প্রকাশ করতে হয়।
প্রেম, দুঃখ, আশা এবং আনন্দের মতো ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলো সাধারণত ব্যক্তিগত পরিসরে প্রকাশের বিষয়। সেগুলো যখন মঞ্চ পরিবেশনার বিষয় হয়ে ওঠে, তখন তা সংবেদনশীলতার ভুল প্রকাশ হয়ে জনমনে ধরা দেয়।
হলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মতো রাজনীতিও আসলে একটি নির্মম প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা, যেখানে ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলোকে বিক্রি করা হয়। উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য হলিউডে এবং দলীয় কনভেনশনের প্রকাশ্য মঞ্চে প্রিয় স্বামী–স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রতি প্রেম–ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয়।
আমেরিকানদের ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে ‘একে অপরের খোঁজখবর নেওয়া’, ‘প্রতিবেশীদের ভালোবাসা’ এবং ‘দরিদ্র ও অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো’র মতো অনেক ভালো ভালো কথা বলা হয়।
অনেক আমেরিকানের ক্ষেত্রে এই সব বর্ণনা মানানসই হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র একটি অনেক বেশি নির্মম প্রতিযোগিতামূলক সমাজ এবং এখানে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের তুলনায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা অনেক বেশি। এখানে সফল হওয়ার জন্য ‘সেলসম্যানশিপ’ প্রয়োজন। এ কথাটি বিশেষত সেই পুরুষ ও নারীর ক্ষেত্রে সত্য, যাঁদের অবশ্যই জনসাধারণের কাছে নিজের সেল ভ্যালু বা ‘বিক্রয়মূল্য’ বাড়াতে হবে (যেমনটি চলচ্চিত্র অভিনেতা বা রাজনীতিবিদেরা করে থাকেন)। সেই দিক থেকে এখানে রাজনীতিবিদেরা আসলে পারফরমার।
এ কারণে সাধারণ মানুষ অভিনেতা-অভিনেত্রী ও রাজনীতিকদের আসল জীবন আগ্রহী থাকেন। তাঁরা চান রাজনীতিকেরা তাঁদের আসল রূপ নিয়ে তাঁদের সামনে আসবেন।
এ কারণেই আমরা তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে গল্পগুজব করি। এ কারণেই আমরা দেখাতে চাই, একজন রাজনীতিক তাঁর স্বামী বা স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসেন। এ কথায় আমরা তাঁদের বিশ্বস্ত স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে দেখতে চাই।
এ জন্যই অস্কারের মঞ্চে অভিনয়শিল্পীদের এবং দলের কনভেনশনে রাজনীতিকদের নিজেদের বিশ্বস্ত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার ‘পারফরম্যান্স’ দেখতে পাই। যেমনটা দেখলাম, সদ্য শেষ হওয়া শিকাগোর অনুষ্ঠানে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট : অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
ইয়ান বুরুমা রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক
* সূত্র: প্রথম আলো