১৮৫৩ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিলার্ড ফিলমোরের আদেশে মার্কিন নৌবাহিনীর কমোডর ম্যাথিউ পেরি চারটি যুদ্ধজাহাজ নিয়ে জাপানে অভিযান চালিয়েছিলেন।
জাপান ২০০ বছর ধরে পশ্চিম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার যে নীতি অনুসরণ করে আসছিল, সেই নীতি থেকে জাপানকে সরে আসতে বাধ্য করাই ছিল এই অভিযানের মূল লক্ষ্য।
ম্যাথিউ পেরি টোকিও উপসাগরে পৌঁছানোর পর জাপানের তৎকালীন তোকুগাওয়া শোগুনেতকে (সে সময়কার জাপানি সেনা সরকার) আলটিমেটাম দেন: হয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য জাপানকে উন্মুক্ত করে দিন, নয়তো কঠোর পরিণতির মুখোমুখি হন।
যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘কালো জাহাজ’ (কয়লাচালিত জাহাজগুলো থেকে কালো ধোঁয়া নির্গত হওয়ার কারণে সেগুলোকে ‘কালো জাহাজ’ বলা হতো)-এর আগমন জাপানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল।
প্রযুক্তিগত দক্ষতার এই চমকে দেওয়া প্রদর্শনী মুখে পড়ে শোগুনেত একান্ত অনিচ্ছায় পেরির দাবি মেনে নিতে রাজি হয়েছিল।
পেরির ধমকের মুখে ১৮৫৪ সালের কানাগাওয়া চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর এক বছর পরে শোগুনেত তার প্রথম বাষ্পীয় ইঞ্জিনচালিত যুদ্ধজাহাজ ডাচদের কাছ থেকে বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে পেয়েছিল।
এরপর বহু বছর কেটে গেছে। প্রযুক্তিতে সভ্যতা এগিয়ে গেছে। এনার্জি গ্রিড, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন এবং এখন কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা চ্যাটবটের মতো প্রযুক্তি আজ একক ব্যক্তিকেও প্রতিষ্ঠিত করতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।
পেরির অভিযান দেখিয়েছিল, প্রযুক্তি রাষ্ট্রীয় সামরিক সার্বভৌমত্বের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করতে পারে। তার ধারাবাহিকতায় প্রযুক্তিগত আধিপত্যের সুবাদে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের সেই চিত্র দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের টিকে থাকার সুবাদে আমেরিকার আর্থিক সার্বভৌমত্ব এখনো অক্ষুণ্ন আছে বটে, কিন্তু দেশটির অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব চীনের দ্বারা দিন দিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাচ্ছে।
ক্রয়ক্ষমতা সমতার দিক বিবেচনায় চীন ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। চীন এখন ১২০টির বেশি দেশের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার।
এই দুটি পরাশক্তি বর্তমানে সেমিকন্ডাক্টর, এআই, সিন্থেটিক বায়োলজি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং ব্লকচেইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির নকশা, বিকাশ ও উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করতে তুমুল প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে অচিরেই এমন একটি অবস্থা তৈরি হবে, যখন বিশ্বের বাকি দেশগুলো এই দুটোর যেকোনো একটি পক্ষকে বেছে নিতে বাধ্য হবে। এটি প্রযুক্তিগত ঔপনিবেশিকতার একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।
অবাক করা বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র বা চীন—কেউই এখন পর্যন্ত সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি।
এর কারণ হলো পাঁচ ন্যানোমিটারের ছোট আকারের সেমিকন্ডাক্টর তাইওয়ানের তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি) এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং ছাড়া আর কেউ উৎপাদন করতে পারে না।
এ অবস্থা বদলে ফেলার জন্য উভয় পরাশক্তি এমন একটি ‘প্রযুক্তি সার্বভৌমত্ব বলয়’ গড়ে তুলতে চাইছে, যেখানে অন্যান্য দেশকেও তাদের সঙ্গে শরিক হতে হবে।
পুরোনো ঔপনিবেশিকতার বিপরীতে নতুন এই প্রযুক্তি-উপনিবেশবাদ ভূখণ্ড দখলে বিশ্বাসী নয়। এই উপনিবেশবাদ বিশ্ব অর্থনীতি ও আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে এমন প্রযুক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়।
চীন অতিগুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের সরবরাহ শৃঙ্খলব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, যা দেশটিকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বৈদ্যুতিক যানবাহন উৎপাদনকারী হতে সক্ষম করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ক্যাডেন্স ডিজাইন সিস্টেম এবং সিনোপসিসের মতো সংস্থাগুলোর সুবাদে চিপ ডিজাইন সফটওয়্যারের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে। সব মিলিয়ে বিশ্ব এখন প্রযুক্তি ঔপনিবেশিকতার দিকে এগিয়ে চলেছে।
এই ক্ষমতা অর্জনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ক্রমবর্ধমানভাবে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের সবচেয়ে উদ্ভাবনী এবং জটিল বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
চীন অতিগুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের সরবরাহ শৃঙ্খলব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, যা দেশটিকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বৈদ্যুতিক যানবাহন উৎপাদনকারী হতে সক্ষম করেছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ক্যাডেন্স ডিজাইন সিস্টেম এবং সিনোপসিসের মতো সংস্থাগুলোর সুবাদে চিপ ডিজাইন সফটওয়্যারের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে।
সব মিলিয়ে বিশ্ব এখন প্রযুক্তি ঔপনিবেশিকতার দিকে এগিয়ে চলেছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে অনূদিত
হারম্যান হাউসার অ্যামাডেউস ক্যাপিটাল পার্টনার্সের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও হাজেম
ড্যানি নকিব ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের একজন জ্যেষ্ঠ গবেষক