প্রতি বছর ২১শে সেপ্টেম্বর বিশ্বজুড়ে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস পালিত হয়, যা ব্যক্তি, সমাজ ও জাতিকে শান্তি ও সৌহার্দ্য গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। এই দিনটি জাতিসংঘের প্রাথমিক মিশনকে স্মরণ করিয়ে দেয়: শান্তির প্রচার, সংঘাত প্রতিরোধ এবং জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করা, যাতে বৈশ্বিক শান্তি স্থাপন করা যায়।
১৯৮১ সালে এ দিবসটি প্রথম প্রবর্তিত হয়েছিল এবং সময়ের সাথে সাথে এটি বিশ্বব্যাপী একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, যেখানে শান্তি, ন্যায়বিচার ও মানব মর্যাদার মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।
আন্তর্জাতিক শান্তি দিবসের ইতিহাস ১৯৮১ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রথম গৃহীত হয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল শান্তি ও ঐক্যের আদর্শ উদযাপন করা। প্রথমদিকে, দিনটি সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনের শুরুতে পালন করা হতো, যা সাধারণত সেপ্টেম্বরের তৃতীয় মঙ্গলবারে হতো।
তবে, ২০০১ সালে সাধারণ পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে ২১ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস হিসেবে স্থির করার সিদ্ধান্ত নেয়, দিনটি পালনের জন্য একটি নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করে এবং এটিকে অ-হিংসা ও যুদ্ধবিরতির দিন হিসেবে ঘোষণা করে। এ সিদ্ধান্ত বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে বাড়তে থাকা সচেতনতা প্রতিফলিত করেছিল যে, শান্তি শুধু যুদ্ধের অনুপস্থিতি নয়, বরং এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যা সক্রিয় অংশগ্রহণ, আলোচনা এবং সহযোগিতা প্রয়োজন।
প্রতি বছর জাতিসংঘ একটি থিম নির্বাচন করে, যা বর্তমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ এবং আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ২০২৪ সালের জন্য থিমটি হলো ‘শান্তির সংস্কৃতি চর্চা’ (Cultivating a culture of peace), যা গভীর তাৎপর্য বহন করে।
চলমান সংঘাত, রাজনৈতিক বিভাজন ও সামাজিক অস্থিরতার মুখোমুখি থাকা একটি বিশ্বে, এই থিমটি দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে শান্তির গুরুত্ব তুলে ধরে। এটি মানুষকে সহানুভূতি, সহনশীলতা এবং বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য উৎসাহিত করে এবং সবার জন্য শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়বিচারমূলক সমাজ গড়ে তোলার জন্য সচেতন পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়, যেখানে প্রতিটি মানুষ সম্মানের সাথে বাঁচতে পারে।
‘শান্তির সংস্কৃতি’ ধারণাটি ১৯৮০-এর দশকে প্রথম বিকশিত হয়েছিল, যেখানে শিক্ষা, টেকসই উন্নয়ন, মানবাধিকার, সমতা এবং সংলাপের মাধ্যমে শান্তির প্রসার ঘটানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। জাতিসংঘ ১৯৯৯ সালে শান্তির সংস্কৃতি সম্পর্কিত ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচি গ্রহণ করে, যা শান্তি কেবল সরকারগুলোর মধ্যে চুক্তি বা শত্রুতার অবসান নয়, বরং এটি সমাজের সব স্তরে-পরিবার, বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে লালন করতে হবে বলে উল্লেখ করে। ২০২৪ সালের থিমটি এই দৃষ্টিভঙ্গিকে পুনরুজ্জীবিত করে, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে শান্তির বীজ বপনের আহ্বান জানায়।
‘শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা’ থিমের মূলকথা হলো শান্তি প্রতিটি মানুষের মধ্যে থেকে শুরু হয়। জাতিসংঘ মানুষকে তাদের আচরণ ও অন্যদের প্রতি মনোভাব নিয়ে ভাবতে এবং হিংসাত্মক ভাষার পরিবর্তে সহনশীলতাপূর্ণ কথোপকথন চর্চার অনুরোধ জানায়।
শান্তির এই থিমটি শিক্ষার ক্ষমতা তুলে ধরে, যা শান্তির সংস্কৃতি গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিন্তাভাবনা ও মূল্যবোধকে রূপান্তরিত করে। শান্তি শিক্ষার মাধ্যমে তারা তরুণদের সংঘাত নিরসনের কৌশল, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা এবং গঠনমূলক সংলাপে অংশ নেওয়ার দক্ষতা প্রদান করতে পারে। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন শ্রেণীকক্ষে আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস উপলক্ষে শিশুদের সহানুভূতি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের গুরুত্ব সম্পর্কে শেখানো হয়।
শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলার মাধ্যমে, আমরা এমন একটি ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারি যেখানে সকল মানুষ ভয় ও সহিংসতা থেকে মুক্ত, সম্প্রীতিতে বসবাসের সুযোগ পাবে এবং যেখানে ন্যায়বিচার, সমতা এবং মর্যাদা সবার জন্য সমুন্নত থাকবে।
শিক্ষার পাশাপাশি, ‘শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা’ সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য এবং অবিচারের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরে। যে পরিবেশে বৈষম্য, নিপীড়ন ও বঞ্চনা বিদ্যমান সেখানে শান্তি স্থাপন সম্ভব নয়। জাতিসংঘ সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলিকে দরিদ্রতা দূরীকরণ, বৈষম্য হ্রাস এবং সকলের মানবাধিকারের সুরক্ষার জন্য কাজ করার আহ্বান জানায়।
এর মধ্যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদাগুলোর নিশ্চয়তা অন্তর্ভুক্ত। সংঘাত ও নিরাপত্তাহীনতার মূল কারণগুলো মোকাবিলা করার মাধ্যমে সমাজগুলো এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, যেখানে শান্তির বীজ বপন করা সম্ভব।
২০২৪ সালের থিমটি সংঘাত নিরসনে সংলাপ ও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তাকে নির্দেশ করে। একটি ক্রমবর্ধমান আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে, জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি এবং স্থানচ্যুতি সম্পর্কিত বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং বোঝাপড়া প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক শান্তি দিবসটি দেশগুলির জন্য একটি মঞ্চ হিসেবে কাজ করে, যেখানে তারা অর্থপূর্ণ সংলাপে অংশ নিতে পারে, মতপার্থক্য মেটাতে পারে এবং অভিন্ন লক্ষ্যে একসাথে কাজ করতে পারে। শান্তি আলোচনা ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সংঘাতপূর্ণ এলাকায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু শান্তি গড়ে তোলার জন্য স্থানীয় পর্যায়েও প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যেখানে সম্প্রদায়গুলো একত্রিত হয়ে স্থানীয় বিরোধগুলো মেটাতে এবং পুনরায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে।
শান্তির সংস্কৃতির ধারণাটি শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি ব্যক্তির পরিবেশ এবং গ্রহের সাথে সম্পর্কের প্রতিফলনও করে। পরিবেশগত স্থিতিশীলতা শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি অপরিহার্য উপাদান, কারণ প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে সংঘাত প্রায়শই সম্প্রদায় ও জাতিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়ায়।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) প্রতি প্রতিশ্রুতি পরিবেশ রক্ষা এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও টেকসই পৃথিবী নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তাকে আরও দৃঢ়ভাবে তুলে ধরে। দায়িত্বশীল ভোগ, বর্জ্য হ্রাস এবং প্রতিবেশ ব্যবস্থাগুলোর সুরক্ষা প্রচার করে, মানুষ পরিবেশগত রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে শান্তি গঠনে অবদান রাখতে পারে।
২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস এমন এক সময়ে উদযাপিত হচ্ছে, যখন বিশ্ব উল্লেখযোগ্য ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন ও মানবিক সংকটের মুখোমুখি। ফিলিস্তিন, ইউক্রেন, সুদান এবং ইয়েমেনসহ বিভিন্ন অঞ্চলের চলমান সংঘাত লক্ষ লক্ষ মানুষকে স্থানচ্যুত করেছে এবং শরণার্থী সংকট সৃষ্টি করেছে।
এদিকে, উগ্রবাদের উত্থান, রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং বিদ্বেষমূলক বক্তব্য সমাজের বন্ধন ছিন্ন করার হুমকি দিচ্ছে। "শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা" থিমটি বিশ্ব সম্প্রদায়কে এই সমস্ত বিভাজনমূলক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান জানায়, যাতে সংলাপের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন করা হয় এবং সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার মূল কারণগুলোকে মোকাবিলা করা যায়।
জাতিসংঘের সদর দপ্তরে নিউইয়র্কে শান্তি ঘণ্টার বাজনা এই দিবসটির অন্যতম প্রতীকী প্রতিফলন। বিশ্বের সকল মহাদেশের শিশুদের প্রদত্ত কয়েন দিয়ে তৈরি এই ঘণ্টাটি একটি শক্তিশালী প্রতীক, যা শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য আমাদের সম্মিলিত দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রতি বছর ২১শে সেপ্টেম্বর যখন এই ঘণ্টাটি বাজে, এটি মানুষকে তাদের ব্যক্তিগত ভূমিকা সম্পর্কে চিন্তা করতে অনুপ্রাণিত করে—তা হয় ছোটখাটো সহানুভূতির কাজের মাধ্যমে হোক বা ন্যায়বিচার ও সমতার জন্য বৃহত্তর প্রচেষ্টা।
যদিও আন্তর্জাতিক শান্তি দিবসটি বিভিন্ন ইভেন্ট, যেমন শান্তি মিছিল, কনসার্ট, সম্প্রদায়গত সংলাপ এবং শিল্প প্রদর্শনীর মাধ্যমে উদযাপিত হয়, এর প্রকৃত প্রভাব এর দ্বারা অনুপ্রাণিত স্থায়ী অঙ্গীকারের মধ্যে নিহিত। "শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলা" মানে দৈনন্দিন জীবনে পরিবর্তন আনা, যেখানে মানুষ একে অপরের প্রতি যত্নবান, পরিবেশের প্রতি সচেতন এবং বৈশ্বিক নাগরিকত্বের মূল্যবোধকে সম্মান করে।
শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলার মাধ্যমে, আমরা এমন একটি ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারি যেখানে সকল মানুষ ভয় ও সহিংসতা থেকে মুক্ত, সম্প্রীতিতে বসবাসের সুযোগ পাবে এবং যেখানে ন্যায়বিচার, সমতা এবং মর্যাদা সবার জন্য সমুন্নত থাকবে।