ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত থাকে, যা সময়কে অতিক্রম করে চিরন্তন হয়ে ওঠে। হিজরতের দশম বছর, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে এমনই এক গৌরবময় দিন এসেছিল, যেদিন আরাফার প্রান্তরে এক লক্ষেরও বেশি মানুষ জড়ো হয়েছিল ইসলামের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ডাকে সাড়া দিয়ে। তিনি আদায় করছিলেন তার জীবনের শেষ হজ। আল্লাহর হুকুমে এটিই ছিল তার জীবনের একমাত্র ও শেষ হজ। আর তাই ইতিহাসে এ হজকে বলা হয় হজ্জাতুল বিদা—বিদায় হজ।
এই হজে আরাফার ময়দানে তিনি যে ভাষণ দেন, সেটিই ইতিহাসে বিদায় হজের ভাষণ নামে প্রসিদ্ধ। সেদিন নবীজির কণ্ঠে যে বাণী উচ্চারিত হয়েছিল, তা জাত-পাত, বর্ণ-শ্রেণি, ভাষা ও সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে মানুষ হিসেবে এক সারিতে দাঁড় করিয়েছিল। সেদিন তিনি শুধু মুসলমান নয়; বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য এক চিরন্তন পথনির্দেশনা রেখে যান।
তিনি তাঁর কথা শুরু করেন মানবজাতির প্রতি সম্বোধন করে:
‘হে মানুষ!’
এটি ছিল একটি সর্বজনীন বার্তা—মুসলমানদের প্রতি নয় কেবল; বরং সমগ্র মানবজাতির প্রতি।
তিনি বলেন:
‘হে মানুষ, তোমাদের প্রভু একজন। তোমরা সবাই আদমের সন্তান। আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে। কোনো আরবের ওপর অনারবের কিংবা অনারবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই; বরং তাকওয়ার ভিত্তিতেই শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত।’
এই এক ঘোষণায় তিনি ভেঙে দেন জাতি, বর্ণ, ভাষা ও শ্রেণির বিভেদ; স্থাপন করেন চূড়ান্ত মানবিকতার ভিত্তি। সেদিন তিনি নারীদের সম্মান, অর্থনৈতিক শোষণের নিষেধ, রক্তপাতের অবসান এবং আমানতের গুরুত্ব—সব কিছুই স্মরণ করিয়ে দেন।
নারীদের অধিকারের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করে তিনি পুরুষদের উদ্দেশে বলেন:
‘তোমরা নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। তারা তোমাদের জীবনের অংশীদার এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত আমানত।’
এই ঘোষণা ছিল নারীসমাজের প্রতি সম্মান, ভালোবাসা এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে জীবন গঠনের এক অপরিহার্য নির্দেশ।
আর্থিক নিরাপত্তা এবং অন্যায়ের প্রতি নিষেধাজ্ঞা প্রদানে তিনি বলেন:
‘আজ থেকে জাহিলিয়াত যুগের সকল সুদ আমি বাতিল করলাম। প্রথম যে সুদ আমি বাতিল করলাম, তা হচ্ছে আমার চাচা আব্বাসের সুদ।’
রক্তপাত আর প্রতিহিংসার অবসান ঘটান এই বলে:
‘আজ আমি জাহিলিয়াত যুগের সকল রক্তের প্রতিশোধ বাতিল করে দিলাম। প্রথম যে রক্ত আমি মাফ করলাম, তা হলো রাবি ইবনে হারিসের পুত্রের রক্ত।’
এছাড়াও দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার প্রতি গুরুত্বারোপ করে সেদিন নবীজি বলেন:
‘তোমরা আমানত রক্ষা করবে। কারো ওপর জুলুম করবে না। অন্যায়ের পথে চলবে না।’
তাঁর কণ্ঠে সেদিন বারবার ধ্বনিত হয়, ‘হে মানুষ!’—তিনি যেন কেবল মুসলমানদের নয়; সমগ্র মানবজাতিকে পথ দেখাচ্ছিলেন।
এই হজের সময়ই ধর্মের পূর্ণতা ঘোষণা করে কোরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত অবতীর্ণ হয়:
‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।’ (সুরা মায়েদা: ৩)
এই আয়াত শুধু ইসলামের পরিপূর্ণতা নয়; বরং নবুয়তের সমাপ্তির এক ঐশী ঘোষণা।
তোমরা কি সাক্ষ্য দিচ্ছ? নবিজির (সা.) অশ্রুসিক্ত সমাপ্তি
বিদায় হজের ভাষণের শেষদিকে নবীজি (সা.) সাহাবাদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি?
সাহাবারা সম্মিলিতভাবে বলেন, হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি।
তখন তিনি আকাশের দিকে তর্জনী তুলে তিনবার বলেন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন।
এভাবে নবিজি (সা.) তার উম্মতের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন—ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে ইসলামের আমানত পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব। এই ছিল তার শেষ হজ। এরপর তিনি আর হজ করেননি। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি ইন্তেকাল করেন। কিন্তু রেখে যান এমন এক বার্তা, যা কালের সীমানা পেরিয়ে আজও প্রতিটি প্রাণকে আলোকিত করে।
আজ যখন জাতি-ধর্ম-ভাষার নামে বিভেদ ও হানাহানি ছড়িয়ে পড়েছে, তখন বিদায় হজের সেই ভাষণ আবারও আমাদের অন্তরে উচ্চারিত হওয়া প্রয়োজন। বিভক্ত ও অবিচারপীড়িত বর্তমান পৃথিবীতে বিদায় হজের ভাষণ আবারও নতুন করে শোনা দরকার—প্রত্যেক হৃদয়ে, প্রত্যেক জাতিতে, প্রত্যেক মানবপ্রাণে।
সে বার্তাই—তোমাদের রব একজন এবং তোমরা সবাই ভাই ভাই—এ যুগের ঘোলাটে বাস্তবতায় এক পশলা নির্মল বাতাস।