ইয়েমেনের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ জামে আল জানাদ

ধর্ম ডেস্ক
  ২৩ আগস্ট ২০২৫, ২৩:২৪

ইয়েমেনের তায়িজ শহরের প্রায় ২০ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরদিকে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এক মসজিদ, জামে আল জানাদ—যার ইতিহাস ইয়েমেনে ইসলামের ইতিহাসের সমান পুরনো।
ষষ্ঠ হিজরিতে (৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে) আল্লাহর রসুল (সা.) ইসলাম প্রচারের জন্য সম্মানিত সাহাবি মুয়াজ ইবনে জাবালকে (রা.) এই অঞ্চলে প্রেরণ করেন। তিনি এখানকার মানুষের মাঝে ধর্মীয় শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রথম যে কাজটি করেন, তা হলো একটি মসজিদ নির্মাণ। স্থানীয় গোত্র বনু আসওয়াদের নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং তাদের সহযোগিতায় এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। ষষ্ঠ হিজরির রজব মাসের প্রথম শুক্রবারে ইয়েমেনের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই মসজিদে জুমার নামাজ আদায় হয়। সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত রজবের প্রথম শুক্রবার জামে আল জানাদে এই দিনটিকে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়।
যে কাঠামোতে মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন, তা আজ আর নেই। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধ, দুর্যোগ ও রাজনৈতিক পালাবদলে এই মসজিদ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও পুনর্নির্মিত হয়েছে। ৩১৭ হিজরিতে হুসাইন ইবনে সালামা মসজিদটির পুনর্নির্মাণ করেন। ৫৫৮ হিজরিতে হামদি বংশীয় মাহদি কর্তৃক মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে ৫৭৫ হিজরিতে আইয়ুবি শাসক সাইফউদ্দিন আতাবেক একে আবার নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করেন। মসজিদটির সবচেয়ে বেশি সংস্কার করেন নাসির আইয়ুব ইবনে সাইফুল ইসলাম। ৬০৩ হিজরিতে (খ্রিষ্টীয় ১২০৬ সাল) তিনি মসজিদের দুই পাশে গ্যালারি নির্মাণ করেন, ইট ও চুন দিয়ে ছাদ পুনর্নির্মাণ করেন, এবং অলংকরণে যুক্ত করেন সোনা ও নীল পাথর। তখনকার সময়ে এই মসজিদের দৃষ্টিনন্দন ছাদ বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল, লোকজন বলত—ছাদ যদি বানাতে হয়, জানাদ মসজিদের মতো বানাও।
বর্তমানে মসজিদটির আয়তন ৬৫.৫ মিটার লম্বা এবং ৪৩ মিটার চওড়া। চারপাশে ঘিরে আছে ১৪৪টি দাঁতাকাটা শিরোভাগ, যা একে খেলাফত আমলের দুর্গের মতো গম্ভীর ভাব এনে দিয়েছে। মসজিদের ভেতরে রয়েছে একটি খোলা উঠান, যার মাঝখানে স্থাপিত একটি প্রাচীন সূর্যঘড়ি। কেবলার দিকে দেয়ালে চার সারিতে সাজানো খিলান, দুটি মেহরাব, এবং একটি দৃষ্টিনন্দন কাঠের মিম্বর রয়েছে। মিম্বরটির খোদাই করা নকশা ও সূক্ষ্ম কারুকাজ মধ্যযুগীয় ইয়েমেনি শিল্পরীতির অনন্য নিদর্শন।
মসজিদের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সুদৃশ্য মিনার। এটির নীচের অংশ গোলাকার, মধ্যভাগ অষ্টভুজ এবং উপরের অংশ ষড়ভুজ, আর মাথায় আছে এক সুন্দর গম্বুজ। অলংকরণের মধ্যে রয়েছে আরবি ক্যালিগ্রাফি, নীল রঙের লাজাওয়ার পাথর, এবং সোনালি নকশা। মিনারের এই বৈচিত্র্যময় রূপ দর্শনার্থীদের বিস্মিত করে। প্রাচীন কারিগররা কীভাবে এত নিখুঁতভাবে কাজ করেছিল—আজও তা স্থাপত্যবিশারদদের জন্য বিস্ময়ের বিষয়।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছাড়াও এই মসজিদটি ছিল দীনি শিক্ষা, ফতোয়া প্রদান, আলাপ-আলোচনার কেন্দ্র। বর্তমানে যদিও আগের অবস্থা নেই, কিন্তু এখনও স্থানীয় কারও সন্তান জন্ম নিলে এখানে দোয়ার জন্য আসে, কেউ নতুন ব্যবসার শুরুতে এখানে সদকা দেয়। সাধারণ মানুষের চোখে এই মসজিদ এক জীবন্ত ঐতিহ্য।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে মসজিদটি সারাবছর দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। স্থানীয় প্রশাসন এবং প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ মাঝে মাঝে সংস্কার কাজ চালালেও এখনও পূর্ণাঙ্গ সংরক্ষণ প্রকল্প অনুপস্থিত। তবে স্থানীয় জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই মসজিদের তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত, প্রতিদিনের নামাজ থেকে শুরু করে বড় জমায়েতে তাদের আন্তরিক অংশগ্রহণ চোখে পড়ে।
মসজিদে জামে আল জানাদ শুধুমাত্র ইয়েমেনের নয়, বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের এক অমূল্য সম্পদ। মুয়াজ ইবনে জাবালের (রা.) হাতে যার সূচনা, সেই মসজিদ আজ হাজার বছরের ইতিহাস ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইমান, আত্মিক সিলসিলা ও মুসলমানদের নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে।