সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে সরকারের নতুন বিধিনিষেধ আরোপ 

সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ৬৩ শতাংশ

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৩৬

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজারভিত্তিক করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহার আগের চেয়ে কিছুটা কমানো হয়েছে, যা গতকাল ১ জুলাই থেকেই কার্যকর করা হয়েছে। এরপর চলতি অর্থবছরের শুরুতেই দেশের সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে অস্বাভাবিক ধস নেমেছে। জুলাই ও আগস্ট প্রথম দুই মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ৬৩ শতাংশ। 
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে যেখানে ৪ হাজার ২২৩ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল, চলতি অর্থবছরে তা নেমে এসেছে মাত্র ১ হাজার ৫৭২ কোটিতে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। সেই সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের সুদহারও কমানো হলো। ফলে সামগ্রিকভাবে নতুন অর্থবছরের শুরু থেকে মধ্যবিত্তের ওপর চাপ কিছুটা বেড়েছে। বিশেষ করে যাদের পারিবারিক খরচের বড় একটি অংশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে আসে, তারা চাপে পড়েছেন। শুধু তাই নয়, সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ কমায় সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যবস্থাপনায়ও নতুন ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে। কারণ সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সরকার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করে থাকে। বিক্রি কমে যাওয়ায় সরকার এখন ব্যাংক খাতের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এতে একদিকে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট বাড়ছে, অন্য দিকে সুদের হারও ঊর্ধ্বমুখী।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার পেছনে রয়েছে কয়েকটি কাঠামোগত ও নীতিগত কারণ। প্রথমত, সম্প্রতি ব্যাংকে আমানতের ওপর সুদের হার বেড়েছে। আগে ব্যাংকে জমা রাখলে তুলনামূলকভাবে কম সুদ পাওয়া যেত, ফলে মানুষ সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকত। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের সুদের ব্যবধান কমে যাওয়ায় অনেকেই ব্যাংকে টাকা রাখাকে নিরাপদ ও সহজ মনে করছেন।
দ্বিতীয়ত, সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে সরকার নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এখন জাতীয় পরিচয়পত্র, ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) ও ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই বাধ্যতামূলক। এতে অনেকে, বিশেষ করে গ্রামীণ ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত বিনিয়োগকারীরা প্রক্রিয়ার জটিলতায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
তৃতীয়ত, দেশে চলমান উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের প্রবণতা কমিয়ে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতেই হিমশিম খাচ্ছে, ফলে সঞ্চয়ের সক্ষমতা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়া সরকারের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। এটি শুধু ঋণ সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলছে না, বরং সাধারণ মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা ও আর্থিক আস্থারও পতন নির্দেশ করছে। সরকার সাধারণত অভ্যন্তরীণ ঋণের বড় অংশ সংগ্রহ করে সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় সরকার এখন তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যয়বহুল ব্যাংক ঋণের দিকে ঝুঁকছে। এতে সুদ ব্যয়ের চাপ বাড়ছে এবং ব্যাংক খাতে ঋণের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের মতে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়া দেশের সঞ্চয় সংস্কৃতি ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। জনগণের ক্ষুদ্র সঞ্চয় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগে ব্যবহারের সুযোগ কমে গেলে সরকারকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর আরও নির্ভর করতে হবে, যা সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করবে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে বিনিয়োগ, মজুরি এবং শ্রমবাজার কোথাও খুব বেশি সুখবর নেই। শুধুমাত্র রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় বাদে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির কোনো খাতেই আয় বাড়ছে না। অন্যদিকে স্থিতিশীল রয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। অর্থাৎ মানুষের আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়ছে। এ অবস্থায় নতুন করে সঞ্চয় করার মতো সক্ষমতা অধিকাংশ মানুষেরই নেই। তার ওপর সুদের হারও বেশ কিছুটা কমে গেছে।’ 
এমন পরিস্থিতিতে সরকার তাহলে কেন সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমিয়েছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সরকার সঞ্চয়পত্রে যে সংস্কার করেছে সেটি মূলত সুদহার বাজারভিত্তিক করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। সুদহার কমানোর জন্য নয়। কারণ সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ না নিতে আইএমএফেরও পরামর্শ রয়েছে।’
জানা গেছে, মূলত আইএমএফের পরামর্শে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদহারের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ছয় মাসের গড় ট্রেজারি বিলের সুদহারের ভিত্তিতে সঞ্চয়পত্রের সুদহার নির্ধারিত হবে। ট্রেজারি বিলের সুদহার বাড়লে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়বে। আর ট্রেজারি বিলের সুদহার কমলে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমবে।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। 
তবে বিক্রিতে নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকায় সংশোধিত বাজেটে সেটি কমিয়ে ১৪ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ঋণাত্মক হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকার যে ঋণ পেয়েছে, তার চেয়ে এ পরিমাণ অর্থ বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে।
এ বিষয়টিকে মাথায় রেখেই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা আরও কমানো হয়েছে। এর আগে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। যদিও অর্থবছর শেষে নিট বিক্রি হয়েছিল ঋণাত্মক প্রায় ৩ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।  
সঞ্চয়পত্র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অতিমাত্রায় মুনাফা পরিশোধ কমাতে গত দুই অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নানা শর্ত দেওয়া হয়। ফলে এ খাতে বিনিয়োগ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি বাজেটে ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্রের নির্ভরতাও কমিয়ে ফেলেছে সরকার।