এক মাস আগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু। জীবনের শেষ কয়েক বছর তিনি একটি আক্ষেপের কথাই বলেছেন বারবার। দেখে যেতে চেয়েছিলেন ১৯৭১ সালে ফুটবল মাঠে যুদ্ধ করা স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
ব্যক্তিগতভাবে জাকারিয়া পিন্টু পেয়েছিলেন স্বাধীনতা পুরস্কার। নিজে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক এই পুরস্কার পেলেও তার দল কিছুই পায়নি। এ নিয়ে জাকারিয়া পিন্টু অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছেন। কোনো কাজ হয়নি। না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে জাকারিয়া পিন্টু পরপারে চলে গেছেন গত ১৮ নভেম্বর।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। দিন, মাসের হিসাবে পেরিয়ে কেটে গেছে ৫৩ বছর। এখনো স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের বেঁচে থাকা সদস্যদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে এই ভেবে যে, তাদের দল রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি।
৫৩ বছর আগে যখন স্বাধিকার আন্দোলনে ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলার জমি হয়েছিল রক্তাক্ত, তখন একদল ফুটবলসেনা ভারতে গিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরি ও অর্থ সংগ্রহের জন্য ভারতের বিভিন্ন শহরে খেলেছিলেন প্রীতি ম্যাচ। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো দেশের স্বাধীনতার জন্য ফুটবল দল গঠনের ঘটনা একটাই।
প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস এলে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যরা গল্প বলেন সেই ঐতিহাসিক দিনগুলোর। অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুকে নিয়ে টানাটানি পড়তো গণমাধ্যমে। সাক্ষাৎ নিতে চাইতেন সবাই। সেই পিন্টু নেই এবার বিজয় দিবসে। বুকের ভেতর একটা হাহাকার নিয়ে তিনি চলে গেছেন পরপারে।
বীরদের মৃত্যু নেই। জাকারিয়া পিন্টুসহ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের যে সদস্যরা চলে গেছেন তাদের মৃত্যু নেই। তারা বেঁচে থাকবেন স্বাধীনতার ইতিহাসে, মানুষের হৃদয়ে।
বাফুফে ভবনে ঢুকতেই চোখে পড়ে পাথরে খোদাই করা দুটি তালিকা। একটি বাংলায়, অন্যটি ইংরেজিতে। সেখানে লেখা রয়েছে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ৩৬ জনের নাম। সে নামগুলোর অনেকেই চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। সর্বশেষ ফজলে সাদাইন খোকন মারা গেছেন গত ৮ ডিসেম্বর।
আইনুল হক, আলী ইমাম, সাইদুর রহমান প্যাটেল, মেজর জেনারেল (অব.) খন্দকার নুরুন্নবী, এ কে এম নওশেরুজ্জামান, শেখ মনসুর আলী লালু, অমলেশ সেন, বিমল কর, শেখ আবদুল হাকিম, লুৎফর রহমান, দেওয়ান মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন সিরু, আবদুস সাঈদ, মনিরুজ্জামান পেয়ারা, আমিনুল ইসলাম সুরুজ, মাহমুদুর রশিদ ও আবদুল খালেকরা অনেক আগেই হয়ে গেছেন স্মৃতির পাতার অ্যালবামে।
প্রাকৃতিক নিয়মে তালিকা থেকে খসে পড়বে এক একটি নাম। এক সময় শুধু তালিকা থাকবে, কেউ আর বেঁচে থাকবেন না।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর ঐতিহাসিক সেই ফুটবল দলকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে বাফুফে।
সোমবার বাফুফে ভবন সংলগ্ন টার্ফে বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত লাল ও সবুজ দলের প্রীতি ম্যাচ দেখতে এসে বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়াল বলেন, ‘আমরা ১৯৭১ সালে যখন বিজয় অর্জন করেছি, তখন ৮ কোটি মানুষেরই বিজয় ছিল। সে বিজয়ে বড় একটা অবদান রেখেছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। তারাই বাংলাদেশের পতাকা প্রথম তুলেছিলেন। তাদের মাধ্যমেই যুদ্ধের তথ্যগুলো পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই দলের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। তবে দল হিসেবে তাদের যে অবদান ছিল সেই স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আমরা সরকারের কাছে একটা আবেদন করেছিলাম। আশা করি, সরকার একটা বিবেচনায় এনে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে স্বীকৃতি দেবে।’